অভিভাবকহীন শিশু: ওদের ঠাঁই হবে কোথায়

অভিভাবকহীন শিশু নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩)

মা–বাবার বিচ্ছেদের পর শিশুরা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে। কখনো অভিভাবকত্ব নিয়ে কাড়াকাড়িতে নতুন সংকটের জন্ম হয়। যেমন জাপানি মায়ের আর বাংলাদেশি বাবার তিন মেয়ে ভুগছে। আবার কখনো কেউই দায়িত্ব না নিতে চেয়ে জটিল সমস্যা তৈরি করে শিশুদের বিপাকে ফেলেন। দাদা-দাদি, নানা-নানি থাকলে, তাঁদের সামর্থ্য আর ইচ্ছা হলে এসব শিশুর একটা গতি হয়। সেখানেও অনেক ঝক্কি আর ঝুঁকি আছে। তবু সেটা মন্দের ভালো।

তৃতীয় একটা পথ ছিল, সরকারি-বেসরকারি এতিমখানা। দুস্থ তালিকায় তাদের সেখানে আশ্রয় দেওয়ার একটা নিয়ম চালু ছিল। বেসরকারি এতিমখানায় শর্ত সাপেক্ষে এতিমপ্রতি সরকারি আর্থিক বরাদ্দ দেওয়ার রেওয়াজ আছে। নথির ভাষায় তাকে ‘ক্যাপিটেশন মানি’ বলে। গত অক্টোবরে কুমিল্লার কয়েকটি বেসরকারি এতিমখানা দেখতে গিয়ে জানলাম, নতুন নিয়মে বরাদ্দের ক্ষেত্রে দুস্থ-অবহেলিত শিশুর কলামটি বাদ দেওয়া হয়েছে। গত বছর থেকেই নাকি দুস্থ-অবহেলিত শিশুশীর্ষক তালিকাটি আর প্রজ্ঞাপনে নেই। ফলে শুধু কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলার ২৭৩টি এতিমখানায় থাকা পাঁচ হাজারের বেশি দুস্থ-অবহেলিত শিশু ক্যাপিটেশন সুবিধা থেকে বাদ পড়ে। সরকারি এ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ‘অবহেলিত’ শিশুদের জন্য এসব এতিমখানার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছবি সারা দেশের।

এতিম ছাড়া অন্য দুস্থ শিশুদের নিয়ে এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে বলা হয়, ‘নতুন যে নিয়ম চালু করা হয়েছে, সেটি নীতিমালা নয়, এটি নতুন একটি ছক। এ ছকে সমাজের দুস্থরা বেসরকারি এতিমখানায় আর ক্যাপিটেশন সুবিধা পাবে না। আমরা জানি, এর ফলে অনেক দুস্থ বিপাকে পড়তে পারে। বিষয়টি নিয়ে অধিদপ্তরে আলোচনা চলছে।’ কে কাকে এ কথা বলেছিলেন, সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। গত অক্টোবর-নভেম্বরে দৈনিক পত্রিকাগুলোতে এসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছিল। বেসরকারি এতিমখানা কল্যাণ পরিষদের কুমিল্লা শাখার সভাপতি তখন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘নতুন নিয়মে আমরা আর দুস্থদের রাখতে পারব না। ফলে অধিকাংশ এতিমখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’

অভিভাবকহীন দুস্থ শিশুরা এতিমখানা ছেড়ে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে, কারা তাদের খাওয়া-পরার দায়িত্ব নেবে? সেটাই এখন মুখ্য প্রশ্ন। দেশে যখন খরচ কমাতে দুস্থ শিশুদের অনুদানের তালিকার বাইরে রাখার ‘ছক’ কৌশল চালু হয়েছে, তখন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সৌদি আরব থেকে অভিভাবকহীন চার শিশুকে দেশে নিয়ে এসেছে। শিশুদের আপাতত রাখা হয়েছে সরকারি শিশু পরিবারে।

শিশুদের বাবার নাম জাহাঙ্গীর আলম, বাংলাদেশের আর মা সাইদাহ বিনতে মুনাওয়ার, ইন্দোনেশিয়ার। জানা যায়, মা সাইদাহ কাউকে কিছু না বলে বছর ছয়েক আগে ইন্দোনেশিয়ায় চলে যান। রেখে যান সদ্যোজাত শিশু সামিয়া জাহাঙ্গীর (যার বয়স এখন ছয় বছর) আর কোলের শিশু জেসমিন জাহাঙ্গীর (এখন বয়স ৭ বছর), ৪ বছরের ছেলে মুজাহিদ জাহাঙ্গীর (এখন ১০ বছর) আর বড় মেয়ে সাত বছরের জামিলা জাহাঙ্গীরকে (এখন ১৩ বছর)। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই চার শিশুর বাবা মারা যান। মৃত্যুর আগে জাহাঙ্গীর আলম দুই বছর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওই সময় এক সৌদি নারী তাদের খাবার ও থাকার জায়গা দেন। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর খবর ওই নারীই বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানান।

এর পর থেকে চার ভাইবোনের জিম্মা নেয় দূতাবাস। তারপর দূতাবাস তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়। শঙ্কার কথা হচ্ছে, শিশুরা নাকি জানত না তাদের ঢাকায় আনা হচ্ছে। তারা জন্ম থেকে সৌদিতে থেকেছে, তারা সেখানেই থাকতে চেয়েছিল। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ শিশুর সেই অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। সৌদি আরব সেই সনদে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। বোঝা যাচ্ছে, দূতাবাস বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে সহজে ঘাড় থেকে ঝামেলা সরিয়েছে।

এখন এই চার শিশুর সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। চার ভাইবোন একসঙ্গে থাকতে চায়। সরকারি-বেসরকারি শিশুনিবাসগুলোতে ছেলে-মেয়ে এক নিবাসে থাকতে পারে না। যা-ই হোক, আপাতত সেই জটিলতাও কাটবে এসওএস শিশুপল্লি ভাইবোনদের একসঙ্গে রাখতে নিজেদের জিম্মায় নিয়েছে। শিশুপল্লিটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, তাঁরা মনেপ্রাণে শিশুদের মনের মতো একটা সমাধানে বদ্ধপরিকর।

এবার মা–বাবার ফেলে যাওয়া শ্রীপুরের তিন শিশুর প্রসঙ্গে আসা যাক। পাঠক জানেন, রুমি (৬), জান্নাত (৩) ও ফাহাদকে (২) নিয়ে শ্রীপুরের এক ভাড়াবাসায় সংসার পেতেছিলেন রুকন মিয়া ও ফাতেমা খাতুন। তাঁদের বাড়ি শেরপুর জেলার কৃষ্ণপুর দড়িপাড়া গ্রামে। মাসদুয়েক আগে প্রথমে মা এবং পরে বাবা শিশুদের ফেলে যান। যাঁর যাঁর মতো নতুন সংসার পেতেছেন। বাড়ির মালিক শিশুদের বের করে দেন। তাদের দেখাশোনার জন্য প্রতিবেশী এক বিধবা নারী আসিফা খাতুনের কাছে তুলে দেন এলাকাবাসী। দীর্ঘ দেড়-দুই মাস তিনি তিন শিশুকে দেখেশুনে রেখেছেন। শেষে আর কুলাতে না পেরে ২ জানুয়ারি শ্রীপুর থানায় তিন শিশুকে নিয়ে হাজির হন। থানা কর্তৃপক্ষ অভুক্ত শিশুদের খাবারের সামান্য ব্যবস্থা করে সমাজসেবা কর্মকর্তাকে সালাম পাঠায়।

অনেক আলোচনার পর ঠিক হয়, স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তিন শিশু আসিফার কাছেই থাকবে। বাবাকে হাজির করার ব্যবস্থা করা হবে। শিশুদের ভরণপোষণের জন্য প্রবীণ নারীটির হাতে চাল, ডাল ও কিছু পোশাকও তুলে দেওয়া হয়।

বলা বাহুল্য, এটা থানা থেকে আপাতত গ্রামের ঝামেলা গ্রামে ফেরত পাঠানোর এক অস্থায়ী বা অ্যাডহক ব্যবস্থা। খাওয়া ছাড়াও শিশুদের বিকাশের নানাবিধ চাহিদা কীভাবে কে মেটাবে? প্রকৃত মা-বাবা যে এই শিশুদের দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত নন, সেটা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। এভাবে ধরেবেঁধে কারও কাছে গছিয়ে দিলে দিন শেষে শিশুদের ভালো হবে কি? এসওএসকে গত সোমবার পর্যন্ত কেউ এ বিষয়ে কোনো অনুরোধ করেননি। অনুরোধ পেলে তারা এই তিন শিশুর বিষয়টি বিবেচনা করতে রাজি আছে বলে জানলাম। সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা কর্মকর্তারা কি এই সালামটা নেবেন, প্লিজ?

Leave a Reply