আকাশমণি থেকে মাফ চাই

আকাশমণি ফুল বছরে দুবার ফোটে । বর্ষার আগে আর বর্ষার পরে । আকাশমণি ফুল নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২২)

অনেকেরই ধুলাবালুর সঙ্গে সঙ্গে ফুলের রেণুতেও অ্যালার্জি আছে। তাই সব ভেবেচিন্তে ফেসবুকে একটা পুষ্পিত একাশিয়ার ছবি দিয়ে লিখেছিলাম, ‘যাঁরা মাস্ক পরা ছেড়ে দিয়েছেন, তাঁরা অন্তত একাশিয়ার (বাংলায় আদর করে যাকে আমরা ‘আকাশমণি’ বলি) ফুল যত দিন থাকে, তত দিন মাস্ক পরুন।

অনেকেরই ধুলাবালুর সঙ্গে সঙ্গে ফুলের রেণুতেও অ্যালার্জি আছে। তাই সব ভেবেচিন্তে ফেসবুকে একটা পুষ্পিত একাশিয়ার ছবি দিয়ে লিখেছিলাম, ‘যাঁরা মাস্ক পরা ছেড়ে দিয়েছেন, তাঁরা অন্তত একাশিয়ার (বাংলায় আদর করে যাকে আমরা ‘আকাশমণি’ বলি) ফুল যত দিন থাকে, তত দিন মাস্ক পরুন।

বিশেষ করে যেসব পার্কে একাশিয়াগাছ আছে, সেখানে শিশু–প্রবীণনির্বিশেষে ‘মাস্ক ইজ মাস্ট’। শ্বাসকষ্ট আর হাঁপানিবর্ধক এই ফুলের রেণু থেকে দূরে থাকুন।’

আকাশমণির ফ্যান ক্লাবের পরিসর আর এর ভিত সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। পটাপট চ্যালেঞ্জ আসতে থাকল, ‘প্রমাণ কই?’ এই সব ‘প্রমাণ চাই, প্রমাণ কই’ মার্কা স্ট্যাটাস দেখে মনে পড়ে যায় অবসরে যাওয়া উচ্চপদস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তার কথা। সকালে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। ভাববাচ্যে আমাদের আলাপ শুরু, ‘এটা কী গাছের নিচে বসা হয়েছে?’

বসে ছিলাম একটা নাগকেশরগাছের নিচে। তিনি আসলে জানতে চাইছিলেন আমার সামনের গাছটার নাম। তখন একটা ভুঁইফোড় সংস্থা সারা দেশে মানুষকে রাতারাতি বড়লোক করে দেওয়ার লোভে পাগল করে নিজেরা টাকার আকাশে উড়ছিল। তারা তখন সারা দেশে কোটিখানেক পাউলোনিয়াগাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। আমি সেই পাউলোনিয়ার একটা নমুনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম।

তখন বলা হতো, পাউলোনিয়া মানে মুক্তি। কেউ যদি বাড়ির আশপাশে মাত্র ১০টি পাউলোনিয়াগাছের চারা রোপণ করেন, তাহলে দুই বছরেই স্বাবলম্বী হতে পারেন। একেকটি চারার দাম ছিল ১০০ টাকা। তার মানে এক হাজার টাকায় দুই বছরের মধ্যে ধনী হয়ে যাবে যে কেউ। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানেই পাউলোনিয়ার একটি চারা মাত্র আট মাসেই ১০ ফুট লম্বা হয়ে ‘দৃশ্যমান’ বিজ্ঞপ্তি ছড়াচ্ছিল। আমি ওই অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বলি, ‘জি এটাকে শেয়ালদস্তানা অথবা রাজকুমারী বা সম্রাজ্ঞীগাছও বলতে পারেন।’

শিশুটির মা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘চিকিৎসকেরা আমাদের ব্যস্ত রাখতে একবার ডায়াপার লাগবে বলে, আরেকবার রক্তদাতা লাগবে বলে। রক্ত না দিয়েও ৪০ হাজার টাকা বিল করে। কত কত অত্যাচার করে শেষ অবধি তারা একমাত্র মেয়েটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল।’

উনি বললেন, ‘ও “পাউলোনিয়া” দ্রুত বর্ধনশীল কাঠ উৎপাদনকারী। (তখন জানতাম না, এক গাছ লাগানো কোম্পানির সঙ্গে তাঁর কনসালটেন্সির ‘পানচিনি’ হয়ে গেছে)। আমি বলি, আগ্রাসী গাছ। তিনি বলেন, ‘এ দেশে বাতিকগ্রস্ত কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা নতুন কিছু নিতে পারেন না। আমি টেলিভিশনের কৃষি অনুষ্ঠানে এই গাছের অনেক তারিফ শুনেছি।’ আমি বলি, দেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা কিন্তু অন্য কথা বলেন। আমি আরও কয়েকটা গাছের কথা বলি। বলি আকাশমণির কথা।

তখন দ্বিজেন শর্মা বেঁচে। রমনায় তিনি মাঝেমধ্যে গাছ চেনাতেন আগ্রহী মানুষদের। একদিন তাঁর কাছে ওই ভদ্রলোককে ধরে নিয়ে গেলাম। শেয়ালদস্তানা বা পাউলোনিয়ার প্রসঙ্গ উঠতেই দ্বিজেন শর্মা প্রায় রেগে গেলেন। বললেন, ‘এসব গাছই আমাদের খেয়ে ফেলবে। জাহাঙ্গীরনগরের ঘটনা জানেন না!’ তখন জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রছাত্রীরা একাশিয়া বা আকাশমণির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলেন।

তাঁদের আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ আকাশমণি অপসারণে রাজি হয়। তখন কোষাধ্যক্ষ ছিলেন বিশিষ্ট উদ্ভিদবিজ্ঞানী এ বি এম এনায়েত হোসেন। তিনি অনেক আগে থেকেই লক্ষ করছিলেন, একাশিয়া ফুল ফুটলেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নানা ধরনের অ্যালার্জির উৎপাত শুরু হয়। চোখ লাল হয়, ঠান্ডা লাগে, হাঁচি হয়, চোখ চুলকায়, শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে যায় ইত্যাদি। ক্যাম্পাসে জন্ম নেওয়া অনেক শিশুরই শ্বাসকষ্টের অভিযোগ সব সময় ছিল।

বাংলাদেশ বন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিএফআরআই) গবেষণা বলছে, ফুল ফোটার সময় আকাশমণির প্রচুর পুষ্পরেণুর সৃষ্টি হয়, যা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। আকাশমণির পুষ্পরেণু অপেক্ষাকৃত ভারী ও আঠালো হওয়ায় বেশি ওপরে যেতে পারে না। মানুষের নাকের নাগালের মধ্যে থাকে। স্বাভাবিক বাতাসে এটা গাছের থেকে ১৫–২০ মিটার দূর পর্যন্ত ভেসে যেতে পারে।

আর আশ্বিন–কার্তিকে বাতাসের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি থাকে। কখনো কখনো বাউলা বাতাসের গতি ঝড়ের গতি পায়। ফলে পুষ্পরেণু ২০ মিটারের সীমায় আর বাঁধা থাকে না। বন গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্বীকার করেছে, বায়ুবাহিত পুষ্পরেণু নিশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে অ্যালার্জি সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে। ফলে সংক্রমিত ব্যক্তির হে জ্বর (হে ফেভার), অ্যালার্জি রাইটিনেজ, আর্টিকারিয়তি, একজিমা, অ্যাজমা ইত্যাদি হতে পারে। বিএফআরআইয়ের তথ্যমতে, মাত্র ৩ থেকে ৫০টি রেণু হে জ্বর ঘটানোর জন্য যথেষ্ট।

১৯৮৩-৮৪ সাল থেকে বন বিভাগ আকাশমণির দুটি জাত দিয়ে বনায়ন শুরু করে। চা-বাগানের মালিকেরা লুফে নেন আকাশমণি। লিগিউমজাতীয় গাছ আকাশমণি বাতাস থেকে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে মাটিকে উর্বর করে। এ জন্যই চা-বাগানে এর কদর বেশি। দুর্বল মাটিতে এই গাছ লাগিয়ে উর্বরতা বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু আকাশমণি আসার পর চা–বাগানের শ্রমিকদের হাঁপানি–অ্যাজমার অবস্থা নিয়ে কেউ কোনো গবেষণা করেননি। সে প্রয়োজনও কেউ বোধ করেননি।

একাশিয়া, ইউক্যালিপটাসগাছসহ বিভিন্ন বিদেশি গাছ রোপণ করা হচ্ছে। এসব বিদেশি গাছ শুধু নগর নয়, গ্রামও দখল করতে শুরু করেছে। এসব গাছের নেতিবাচক প্রভাবে গাছের ডাব পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছে। এসব গাছে কোনো পাখি বসে না।

বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট জাতীয় পর্যায়ের এক কর্মশালায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে আকাশমণি সম্পর্কে কয়েকটি সুপারিশ রেখেছিল, যেমন ১। অ্যালার্জি উৎপাদক উদ্ভিদের তালিকা প্রণয়ন, ২। পরাগরেণু ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে ফুল ফোটার আগেই গাছের ডালপালা ছেঁটে দেওয়া (অস্ট্রেলিয়ায় এটা বাধ্যতামূলক), ৩। রাস্তার পাশে বসতবাড়িতে, দোকানপাটের সামনে বাজারে বা তার কাছে আকাশমণি না লাগানো, ৪। শুধুই আকাশমণির বন সৃজন করা ঠিক নয়। এতে প্রাকৃতিক বন নষ্ট হয়ে যাবে, ৫। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর শরীরে কোন গাছ কী বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে ধারাবাহিক গবেষণা।

এসব সুপারিশের বিষয়ে নীতিনির্ধারকেরা যত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেবেন, ততই মঙ্গল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *