কাইতানে সিত্রাং-আতঙ্ক, এখন করণীয়

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর আতঙ্ক এবং এর ফলে কি কি সংকট হতে পারে তা নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২২)

আশ্বিনে আইতান কার্তিকে কাইতান বাংলা বদ্বীপে ঝড়বৃষ্টি দিনপঞ্জি মেনেই চলে। কার্তিকের অমাবস্যা-পূর্ণিমায় ঝড়বৃষ্টি কোনো নতুন কথা নয়। বর্ষা ঋতু শেষে কার্তিক মাসে একটানা কয়েক দিন বৃষ্টি হয়। এরপরই শীতের বাজনা শুরু হয়। কার্তিকের এ বৃষ্টিকেই কাইতান বলে।

আশ্বিনে আইতান কার্তিকে কাইতান বাংলা বদ্বীপে ঝড়বৃষ্টি দিনপঞ্জি মেনেই চলে। কার্তিকের অমাবস্যা-পূর্ণিমায় ঝড়বৃষ্টি কোনো নতুন কথা নয়। বর্ষা ঋতু শেষে কার্তিক মাসে একটানা কয়েক দিন বৃষ্টি হয়। এরপরই শীতের বাজনা শুরু হয়। কার্তিকের এ বৃষ্টিকেই কাইতান বলে। অঞ্চলভেদে উচ্চারণের রকমফের থাকতে পারে, বাগেরহাটে যেটা ‘ক্যাতেন’, ময়মনসিংহ অঞ্চলে সেটাই ‘কাইতেন’। হুমায়ূন আহমেদের লেখা যাঁরা মনোযোগসহ পড়েছেন, তাঁদের নিশ্চয় শব্দটি নজরে এসেছে। হুমায়ূন আহমেদের বেড়ে ওঠা নেত্রকোনায়। বোধ করি, শৈশবে তিনি কাইতান দেখেছেন নিবিড়ভাবে। তাই তাঁর লেখায় কাইতানের কথা ফিরে ফিরে আসে। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’তেও কাইতানের সন্ধান মেলে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাড়াও সুনামগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুরে কৃষকেরা কাইতান বোঝেন।

কাইতান কিন্তু কালবৈশাখীর মতো স্থানীয় ঝড়ঝঞ্ঝা নয়; একটা জেলার একটা উপজেলার একটা গ্রামে কালবৈশাখী আসতে পারে। কিন্তু কাইতান আসে বড় পরিসরে। উপকূলের কাছের-দূরের অনেক জেলাকে সে ভিজিয়ে দেয়। কৃষকদের হিসাবে কাইতান যেন নাইয়রে আসে; এক-দুই দিনে তার সাধ মেটে না। তিন দিন, পাঁচ দিন বা সাত দিন ধরে ঝরতে থাকে। মাঝেমধ্যে দমকা হাওয়া ছাড়ে, তাতে নাজুক গাছপালা উপড়ে যায়। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বলেন, বর্ষার পানিতে গাছপালার শিকড় নরম মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকে, তাই জোরে দমকা হাওয়া হলেই সে কাবু হয়ে যায়।

চলতি কাইতান নিয়ে আতঙ্ক কেন

কার্তিকের প্রথম অমাবস্যায় মাঝারি এক নিম্নচাপের দোলায় চেপে বেশ বড়সড় মেঘ নিয়ে কাইতানের আগমন ঘটেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সূর্যগ্রহণের তিথি। গত ৩০ এপ্রিল বছরের প্রথম সূর্যগ্রহণ হয়। বছরের দ্বিতীয় ও শেষ সূর্যগ্রহণ হবে কাল ২৫ অক্টোবর। বিকেল ৪টা ২৯ মিনিটে শুরু হয়ে চলবে ৫টা ৪২ মিনিট পর্যন্ত। ভারতের কোনো কোনো অঞ্চল থেকে এটি দেখা যাবে। আমরা দেখতে পাব না। ইউরোপ, আফ্রিকার উত্তর-পূর্বের অংশ, এশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ ও আটলান্টিকে এ গ্রহণ দেখা যাবে। তবে সাগরে এর প্রভাব পড়বে। সব ধর্মেই সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণকে পাত্তা দেওয়া হয়েছে। আমাদের আবহাওয়া অফিস এত নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেছে কি?

কী কী সংকট হতে পারে

নাজুক আর হাফমেরামত বেড়িবাঁধগুলো জোয়ারের তোড়ে ভেঙে গিয়ে আমন ফসলের সর্বনাশ করতে পারে। ভেসে যেতে পারে মাছের শত শত ঘের। সুন্দরবনের ল্যান্ডিং স্টেশনগুলো ভেসে যেতে পারে। নৌকা-লঞ্চ হারিয়ে যেতে পারে।

কলাবাগানগুলো বিধ্বস্ত হতে পারে। শ্যামনগর উপজেলার পাউবো কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উপজেলাকে ঘিরে থাকা প্রায় ১২৭ কিলোমিটার উপকূল রক্ষা বাঁধের মধ্যে ৫০০ মিটারের মতো জায়গা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। সময় থাকতে ঝুঁকিতে থাকা বাঁধ মেরামত করার কথা কেউ ভাবেননি। মোংলার চিলা এলাকার বাসিন্দা কমলা বেগম সে রকম কথাই বলেছেন প্রথম আলোকে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পশুর নদসংলগ্ন বাঁধ সংস্কার না করায় এখন তাঁরা কয়েক হাজার বাসিন্দা ঝুঁকি নিয়ে সেখানে বসবাস করছেন। ঘূর্ণিঝড়ের খবরে তাঁদের ঘুম নেই। শ্যামনগরের পাউবো কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পশ্চিম কৈখালীসহ দাতিনাখালী এলাকার বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে।

দুর্গাবাটি এলাকার ভাঙনকবলিত অংশে প্রায় ১৫০ মিটার বাঁধ জিও শিট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। শবদেহের ওপর কাফনের কাপড়ের মতো সে দৃশ্য সাহস জোগায় না, শঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, আটুলিয়া, কাশিমাড়ীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের পাউবোর বেড়িবাঁধের দুর্বল জায়গাগুলোয় সংস্কার করা হচ্ছে। কিন্তু এখন কেন? কাইতান-সূর্যগ্রহণ অনেক আগেই তাদের আগমনের কথা ঘোষণা করে রেখেছিল।

তারপরও আমরা কেন আমলে নিলাম না? একই বক্তব্য এসেছে পাথরঘাটা থেকে। সেখানে নাকি জলকপাটের মুখ এতই চিপা যে পানি বের করা অনেক সময়সাপেক্ষ কাজ হবে।

শেষ পর্যন্ত জোয়ারের পানি যদি লোকালয়ে ঢুকেই যায়, তাহলে সেটা কম সময়ের মধ্যে বের করে দেওয়ার প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমন বাঁচানোর একটাই উপায়—মাঠ থেকে জোয়ারে লোনাপানি দ্রুত বের করে দেওয়া। সেই সক্ষমতা আমাদের আছে, শুধু দরকার সমন্বয়ের।

বর্ষার শেষে বৃষ্টির পরিমাণ কমে যায়, তাই পুকুরগুলো থেকে লোনাপানি বের করে না দিলে শিশু ও বড়দের মধ্যে খোসপাঁচড়াসহ নানা চর্মরোগ দেখা দেবে। তা ছাড়া, যাঁরা পুকুরের পানি এসএসফি পদ্ধতিতে শোধন করে ব্যবহার করেন, তাঁরাও বিপদে পড়বেন। কাইতানের ঘোর কাটার আগেই উপজেলাভিত্তিক কাইতান পুনর্বাসন কর্মসূচির কথা ভাবতে হবে, যার মূল লক্ষ্য হবে আমন রক্ষা।।

Leave a Reply