ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’

পরিস্থিতি প্রতিবেদন-১১ ১১ মে ২০২৩

ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানার সম্ভাব্য তারিখে (১৪ মে ২০২৩) পূর্ণিমা বা অমাবস্যা নেই ফলে চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলায় জোয়ারের পানি ১০ থেকে ১১ ফুট উচ্চতায় থাকবে।


বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গপোসাগর ও তৎসংলগ্ন আন্দামান সাগর এলাকায় অবস্থিত গভীর নিম্নচাপটি ১১ মে ২০২৩ তারিখে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ পরিনত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটার এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ৬২ কিলোমিটার যা দমকা ও ঝড়ো হাওয়া আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইন্ডিয়ান আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে আগামী ১৪ মে ২০২৩ তারিখে ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় ১৫০ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার বেগে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও মিয়ানমার উপকূলীয় এলাকায় প্রবল শক্তি নিয়ে আঘাত করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর গতিপথ পাল্টে গেলে উপকূলে আঘাত হানার সম্ভাব্য স্থান বদলে যেতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র’ প্রভাবে আগামী ১৩ মে থেকে ১৬ মে এর ভেতরে, চট্টগ্রাম, ও সিলেট বিভাগের অনেক এলাকায় গড়ে ১০০ থেকে ৩৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টি হওয়ার আশংকা রয়েছে বলা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।


টাইড ফোরকাস্টের তথ্য মতে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ সরাসরি দেশের চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে আঘাত করলে ১১ ফুট ও কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে আঘাত করলে ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে আশার কথা আজকে (১১ মে ২০২৩) দেশের তিনটি বিভাগের (ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং সিলেটের) তিনটি জেলায় (ফরিদপুর, নেত্রকোণা এবং সিলেটে) বৃষ্টিপাত হয়েছে যা আরও আগামী দুই দিন দেশের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি এই বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকে তাহলে ঘূর্ণিঝড়ের “মোখা’র” ভয়াবহতা কমে আসবে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানার সম্ভাব্য তারিখে (১৪ মে ২০২৩) পূর্ণিমা বা অমাবস্যা নেই ফলে চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলায় জোয়ারের পানি ১০ থেকে ১১ ফুট উচ্চতায় থাকবে। তবে ঘূর্ণিঝড়টি যদি ১৪ মে আঘাত না ১৯ মে আঘাত হানত তবে অমাবস্যার ফলে ওই এলাকায় ১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা থাকত।


সতর্কতা: চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহে ২ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত দেখানো হয়েছে এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে ও গ্ভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরা নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। সেই সাথে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে তাদেরকে গভীর সাগরে বিচরণ না করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সেই সাথে দেশের চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকা বাসিন্দাদের নিরাপদ অবস্থানে থাকার এবং ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রামে সরাসরি আঘাত করলে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভয়াবহ পাহাড়ধ্বস এর আশংকা রয়েছে।


সরকারীভাবে প্রস্তুতি
কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সূত্রমতে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবিলায় টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু ও কক্সবাজার সদর উপজেলাতে ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য অন্তত ১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণক্ষমতা প্রায় পাঁচ লাখ ছয় হাজার। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে বলে জানায় কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক।
এছাড়াও দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য ১০ লাখ ৩০ হাজার টাকা, ৪৯০ মেট্রিক টন চাল, ১৯৪ বান্ডিল ঢেউটিন, ৫ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটির (সিপিপি) ৮ হাজার ৬০০ জন স্বেচ্ছাসেবী, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রোভার স্কাউট সদস্য, ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও অন্তত দেড় হাজার সদস্যকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উদ্ধার তৎপরতায় নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের রেসকিউ টিম, রেসকিউ বোট, মেডিকেল টিম ও কমান্ডো প্রস্তুত রাখা হবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোয় শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, গর্ভবতী নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।


ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ এর প্রভাবে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে কৃষকদের করণীয় বিষয়ে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে-
১। পাকা ধান (৮০ শতাংশ), পরিপক্ব আম ও অন্যান্য সংগ্রহ উপযোগী ফসল দ্রুত সংগ্রহ করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ প্রদান।
২। কৃষকদের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কার সতর্কতামূলক তথ্য মাঠে ব্যাপক প্রচার প্রচারণার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩। সার্বক্ষণিক কর্মস্থলে থেকে কৃষকদের পরামর্শ প্রদানের জন্য কৃষকের পাশে থাকা।
৪। আবহাওয়া সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য ও পরামর্শের জন্য বিএএমআইএস পোর্টাল অনুসরণ করতে হবে।


ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়াসহ ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এসব নির্দেশনা হল-
১. জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা।
২. খাবার স্যালাইনসহ জরুরি প্রতিরোধ ও প্রতিষেধক ওষুধ ও উপকরণ উপকূলবর্তী জেলায় পর্যাপ্ত মজুত রাখা।
৩. প্রয়োজনীয় সংখ্যক পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং সাপে কাপড় দেওয়া রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক অ্যান্টিভেনম মজুত রাখা।
৪. উপকূলবর্তী এলাকায় মাঠ কর্মীদের (স্বাস্থ্য পরিদর্শক, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক, স্বাস্থ্য সহকারীসহ অন্যান্য) মাধ্যমে উপদ্রুত অঞ্চলে নিয়মিত পরিদর্শন এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
৫. কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনে কর্মকর্তা/কর্মচারীর নৈমিত্তিক ছুটি বাতিলসহ প্রতিষ্ঠান প্রধান ও চিকিৎসকদের কর্মস্থলে অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
৭. স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাম্বুলেন্সগুলো প্রয়োজনীয় জ্বালানিসহ প্রস্তুত রাখতে হবে।
৮. যেসব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স সচল আছে, সেসব ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স মেডিকেল টিম এবং প্রয়োজনীয় জ্বালানিসহ প্রস্তুত রাখতে হবে।
৯. নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু রাখতে হবে।
১০. সর্বোপরি সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও সতর্কতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *