পরিকল্পনামতো কাজ করলে, চুরিদারি বন্ধ থাকলে সব সম্ভব

প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন গওহার নঈম ওয়ারা।

সাক্ষাৎকারটি ০৭ জুলাই, ২০২২ এ প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, প্রকাশের সময়ঃ ১৩: ০২

সিলেট সিটি করপোরেশনের দুবারের নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বর্তমান পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন।

সরাসরি সুনামগঞ্জের দিরাই যাওয়ার নিয়তেই ২৭ জুন ঢাকা ছেড়েছিলাম। হবিগঞ্জে চায়ের দোকানের মালিক বললেন, জয়কলস পর্যন্ত যাওয়া যাবে, তারপর ভাগ্য। সিলেটে কাজ থাকলে সেটা সেরে পরদিন সকালে চেষ্টা করা আক্কেলের কাজ হবে। পথেঘাটে দুর্যোগ–দুর্বিপাকে স্থানীয় মানুষের কথা আমলে নেওয়ার কথা কেতাবে লেখা আছে। আমাদের কেতাব আর গোয়ালের মধ্যে ফারাক বাড়ছে দিন দিন। তারপরও ‘লোকাল নলেজ’কে পাত্তা দিয়ে সিলেটেই ঢুকে গেলাম। স্থানীয় জ্ঞানকে পাত্তা দেওয়া যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বাইরে থেকে যাওয়া ত্রাণ পর্যটকেরা।

বন্যার পানি থেমে থাকার জন্য সিলেট শহরের বিশেষ করে হাওয়াপাড়া, চৌহাটটা ও শিবগঞ্জ মহল্লার বড় বদনাম ছিল। মানুষ এ দিকে বাড়িভাড়া নিতে চাইত না। উপশহরের ভেতর দিয়ে এখন চট করে শিবগঞ্জ হয়ে শাহ্‌পরান তথা খাদিমনগর পৌঁছানো যায়। একসময় এই পথে জলাবদ্ধতা ছিল মানুষের জন্য বড় দুর্ভোগের। এখন সেটা নেই। যে শিবগঞ্জ বৃষ্টির পানিতেই হারিয়ে যেত, সেই এলাকা এখন শতাব্দীর রেকর্ড বন্যায় শুকনা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। সবার আগে পানি সরেছে সেখান থেকে। একই ঘটনা ঘটেছে হাওয়াপাড়া আর চৌহাট্টায়। এ যেন প্রায় অবিশ্বাস্য ঘটনা।

২৯ জুন সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে কথা শুরু হয় শিবগঞ্জ নিয়ে। আরিফুল হক চৌধুরীর জন্ম ২৩ নভেম্বর ১৯৫৯ সালে। ২০১৩ সাল থেকেই তিনি সিলেটের মেয়র। পরপর দুবার প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। তাঁর আগে ২০০৩ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বন্যায় ভাসতে থাকা শহরের একজন সক্রিয় মেয়র যতটা ব্যস্ত থাকেন, তিনি তারচেয়ে অনেক ব্যস্ত। প্রথম আলোর সিলেট প্রতিনিধির বিশেষ চেষ্টায় তিনি এই ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সময় দেন। মেয়রের বাড়ির বারান্দায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। সেখানেই তিনি কথা বলেন অতিথি ও দর্শনার্থীদের সঙ্গে। কেউ তাঁর ত্রাণ তহবিলে টাকা দিতে এসেছেন, অফিসের কাজ নিয়ে এসেছেন পৌর করপোরেশনের সহকর্মীরা। আমরা আর কথা শুরু করার ফুরসত পাই না। পরে আমরা ভেতরের বৈঠকখানায় গিয়ে বসলাম। সেখানেও ফোন আসে। কর্মীরা ঢুকতে চান। ওষুধ নিয়ে আসেন মেয়রের চিকিৎসকের সহকারী। তাঁর ডায়াবেটিস তর তর করে বেড়ে যাচ্ছে, সেটার মাপামাপির তোড়জোড়। করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার জের এখনো কাটেনি। ইনহেলার নিতে হচ্ছে। এসবের মধ্যেই শুরু হয় আমাদের কথাবার্তা।

নঈম: আমি সিলেটে এসেই হাওয়াপাড়া, চৌহাট্টা ও শিবগঞ্জ এলাকা ঘুরতে গিয়েছিলাম। আগের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করেছিলাম, এসব জায়গায় পানি আটকে থাকবে। কিন্তু গিয়ে জানলাম, জলাবদ্ধতার জন্য বহুল পরিচিত এসব মহল্লা থেকে পানি নেমে গেছে সবার আগে। এটা কী করে সম্ভব হলো?

আরিফুল হক চৌধুরী: পরিকল্পনামাফিক আল্লাহর রহমতে ওসব জায়গায় পুরোনো ব্যবস্থা বাতিল করে নতুন পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছি। সেটাই এবার কাজে লেগেছে। সরকারের কাছে আমাদের প্রস্তাব আছে, সারা শহরে শিবগঞ্জ মডেল অনুসরণ করে ড্রেনেজব্যবস্থা বিন্যস্ত করা হোক। সিলেটে এখন ওয়াসা চলে এসেছে। পরিকল্পনামতো কাজ করতে পারলে চুরিদারি বন্ধ থাকলে সব সম্ভব। এই যে ২০০৪ সালে চৌহাট্টা পয়েন্ট থেকে রিকাবিবাজার পর্যন্ত তৈরি রাস্তা টিকে আছে শুধু সৎ ঠিকাদারির জন্য। এ দেশে এখনো অনেক সৎ মানুষ সৎ ব্যবসায়ী আছেন। এঁদের সৎভাবে কাজ করতে দিলে আমরা আমাদের সীমিত সম্পদ দিয়ে অনেক দূর এগোতে পারব। সেই সঙ্গে সৎ বিশেষজ্ঞদের কথা শুনতে হবে। সিলেটের পয়োনিষ্কাশন সুরমা নদীর নাব্যতা ঠিক রাখা নিয়ে আমি অধ্যাপক জামিলুর রেজা স্যারের সঙ্গে সুযোগ পেলেই কথা বলতাম। তাঁর পরামর্শ কানে নিলে আজকের এই দিন আমাদের দেখতে হতো না।

নঈম: তিনি কী পরামর্শ দিয়েছিলেন?

আরিফুল হক চৌধুরী: আজকে যে সবাই ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কথা বলছে, তিনি কখনোই তার পক্ষে ছিলেন না। আমরা সুরমার বুকে সেতুর পর সেতু বানিয়ে নদীটাকে বিনষ্ট করেছি। বড় ধরনের ড্রেজিংয়ে সবার আগে ঝুঁকিতে পড়বে সেতুগুলো। জামিল স্যার বলেছিলেন, শহরের চৌহদ্দিতে হাজার কোটি টাকার ড্রেজিংয়ে না গিয়ে বড় ড্রেজিং করতে হবে দূরের ভাটিতে। তাঁর মতে, শহর এলাকায় নদীর মধ্যে ড্রেজিংয়ের চেয়ে ড্রেন বেশি কাজে আসবে। তিনি সিলেটের ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং অবস্থানের কথা বিবেচনা করে বড় সুয়ারেজ সিস্টেমে না গিয়ে ‘সোক পিটের’ ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। বাংলাদেশের অন্য জেলাগুলো থেকে সিলেট অঞ্চল যে আলাদা, সেটা আমাদের বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে। সুরমা নদীর সঙ্গে যে ছড়াগুলো এসে মিশেছে, তিনি সেগুলো নিয়েও চিন্তা করেছিলেন। বলেছিলেন, বর্ষার পানির ঢল সামাল দেওয়ার জন্য কোন কোন ছড়ার সঙ্গে আমাদের জলাধার গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই জলাধারগুলো শুকনা মৌসুমে সেচের কাজে সহায়তা করবে। এগুলো থেকে বাণিজ্যিকভাবে উন্নত মানের বালু সংগ্রহের সম্ভাবনার কথাও তিনি বলেছিলেন। তাঁর পরামর্শ ছিল, খণ্ডিতভাবে কোনো কাজে হাত না দিয়ে সব ডিসিপ্লিনের মানুষকে নিয়ে সিলেট অঞ্চলের শহর আর গ্রামীণ জনপদের জন্য একটা টেকসই পরিকল্পনা তৈরি। নদী আর হাওরকে যতটা সম্ভব কম বিরক্ত করে সেটা করা সম্ভব।

নঈম: উজান থেকে আসা পলি ছাড়াও সুরমা নদী ক্রমেই ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে, কলকারখানার বর্জ্য, ধানকলের ছাই, মানুষের বর্জ্য, কাঁচাবাজারের উচ্ছিষ্ট—সবই নদীতে ফেলা হচ্ছে। পৌর কতৃপক্ষের কি কিছুই করার নেই?

আরিফুল হক চৌধুরী: অবশ্যই আছে। তবে মেয়ররা অনেকটা ঢাল–তলোয়ারহীন সর্দারের মতো। কলকারখানা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি শিল্প মন্ত্রণালয়ের। এরা মেয়রের অফিসের আওতার অনেক বাইরে। তাদের পরিচালনার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের একটু সচল হতে হবে। আমি মেয়র হিসেবে অনুরোধ করতে পারি, তার বেশি কিছু নয়। তবে মানুষ যাতে নদীতে ময়লা না ফেলে, সে জন্য ওয়ার্ড কমিশনারদের কিছু দায়িত্ব নিতে হবে। মানুষকে বুঝিয়ে বলতে হবে, বারবার বলতে হবে।

নঈম: এই যে বললেন আপনি ‘ঢাল–তলোয়ারহীন সর্দারের মতো’ কিন্তু আপনি তো পদাধিকারবলে নগর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান। সে পদ আর ক্ষমতা তো আমাদের আইন আপনাকে দিয়েছে।

আরিফুল হক চৌধুরী: দিয়েছে, আবার দেয়ওনি। আমি মিটিং ডাকলে কেউ আসে না। আমি উপযাজক হয়ে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মিটিংয়ে গিয়েছি। এই নগরীর গরজেই এটা আমাকে করতে হয়েছে। কে ছোট কে বড়, এটা নিয়ে আমি ভাবি না। কিন্তু অন্যরা ভাবেন। সিটি মেয়র হিসেবে রুলস অব বিজনেসে একটা মর্যাদা দিতে বাধা কোথায়। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী মেয়ররা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী না এমপিদের মর্যাদায় আসন পাবেন, তা নিয়ে মনগড়া জটিলতা আছে।

নঈম: এই বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার সাহেবের একটা বক্তব্য মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘সিটি মেয়রদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কার্পণ্যে তাঁদের মাঝে কিছুটা হতাশা আসতে পারে। এটা সেই নগরের কাজকর্মেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’ আমি কি বলব আপনি হতাশ?

আরিফুল হক চৌধুরী: হতাশার কোনো চিহ্ন কি আপনি আমার কাজে দেখেছেন? হতাশ হলে কি আমি কুমারগাঁও সাবস্টেশন রক্ষার জন্য ছুটে যেতাম? মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ চালু রাখার জন্য সিটি করপোরেশনের জেনারেটর নিয়ে ছুটতাম? সেখানে পানির মধ্যে ট্রাক রেখে জেনারেটর চালিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। আমি প্রটোকল নিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ি না। আল্লাহর রহমতে সিলেটবাসী দু–দুবার আমাকে মেয়র নির্বাচিত করেছে, তাতেই আমি খুশি। সরকার কাকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেবে, সেটি সরকারের বিষয়। এ বঞ্চনা আমার নয়, পুরো সিলেটবাসীর। বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে সিলেটে তৎকালীন মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা পেয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হলেও আমাকে সেটা দেওয়া হয়নি। আমার একজন পিএসও নেই।

নঈম: বন্যার সময় প্রধানমন্ত্রী সিলেট এসেছিলেন। তাঁর সভায় আপনি ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে আপনি কী বলেছিলেন?

আরিফুল হক চৌধুরী: এই প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে চিঠি দিয়ে উপস্থিত থাকতে আর বক্তব্য দিতে বলা হয়েছিল। আমি সিলেট শহর রক্ষা বাঁধের কথা বলেছি। জলকপাট দিয়ে ছড়াগুলো নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছি। ত্রাণসামগ্রীর অপ্রতুলতা নিয়ে অভিযোগ করেছি। তিনি মন দিয়ে শুনেছেন। ফিরে গিয়ে সিলেটের জন্য চালের বরাদ্দ বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা সরকারের একটা ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সিলেট শহরের একটা সার্বিক পরিবেশ সুরক্ষার পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম। সেই রিপোর্টটা আমরা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছি। বলেছেন মেয়র ভালো কাজ করছেন। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর এই উপলব্ধি আমার ভালো লেগেছে।

আমার কাজ আমি করে যাব। আমার প্রতি সিলেটের মানুষের আস্থা আর বিশ্বাসের কোনো অমর্যাদা আমি হতে দেব না।

Leave a Reply