পরীক্ষার ফলাফল যেন শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঝুঁকিতে না ফেলে

সতর্কবার্তা বার্তা, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১

আগামী ২৮ থেকে ৩০ শে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল। প্রতি বছর লক্ষ্য করা যায়, পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। গত বছর, ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ২১ জন কিশোর কিশোরী আত্মহত্যা করে।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০২১ সালে কোভিড মহামারীর কারণে সারা বিশ্বজুড়ে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কিশোর কিশোরীদের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশেও কিশোর কিশোরী শিক্ষার্থীরাও এই ঝুঁকির মধ্যে আছে। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফল না পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে, বিশেষ করে কিশোরীদের মধ্যে।

এই রকম পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের সকলের উচিত শিক্ষার্থীদের সহয়তা করা। পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়, ঘুরে দাঁড়ানোর অনেক উপায় আছে। সন্তানদের অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে, তাদের কাছে টেনে, ভালোবেসে, বোঝানোর মাধ্যমে তাদের এই পরিস্থিতি থেকে বের করে আনতে আমাদের সবাইকে বিশেষ করে বাবা-মা এবং শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা এবং আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য লক্ষণ নিয়ে ২৭ ডিসেম্বর ২০২১ সালে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় জনাব গওহার নঈম ওয়ারার একটি তথ্যমূলক এবং বিশ্লেষনধর্মী লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
নিচে পত্রিকার লিংক এবং লেখাটি সংযুক্ত করা হলো

এই বিষয়ে সচেতনতামূলক তথ্য প্রচারের মাধ্যমে শ্রোতা বিশেষ করে অভিভাবক ও শিক্ষক শিক্ষিকাদের সচেতন করার পদক্ষেপ গ্রহনের অনুরোধ জানাচ্ছি।
https://www.prothomalo.com/opinion/column/%E0%A6%8F%E0%A6%B8%E0%A6%8F%E0%A6%B8%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%AB%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B6%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%BE-%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%AD%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%B9%E0%A7%9F

এসএসসির ফলাফলে আত্মহত্যার শঙ্কা যেন ভুল হয়
গওহার নঈম ওয়ারা
লেখক ও গবেষক
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮: ০০

পরীক্ষায় ফেল–পাসের চেয়ে জীবনটা অনেক বড়। পরীক্ষার্থী, অভিভাবক সবার এই উপলব্ধি জরুরি
এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল এ মাসের শেষে প্রকাশিত হবে। সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, ডিসেম্বরের শেষের দিকে (২৮–৩১ ডিসেম্বর) যেকোনো দিন জানা যাবে সফলতা আর ব্যর্থতার নিকাশ। চাপ বাড়বে মিষ্টির দোকানে, ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে। ‘সফল’ শিক্ষার্থীদের বাবা–মায়ের সচিত্র দোয়া প্রার্থনা আর শুকরিয়ার মিছিলে ভাসবে দেশ। নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস আর শিক্ষক–অভিভাবকদের সংলাপ, সাক্ষাৎকারে ভরে যাবে সংবাদপত্রের পাতা, আর ‘বোকা বাক্স’-এর পর্দা। প্রতিবছর ফলাফল প্রকাশের ২৪ ঘণ্টা না যেতেই ‘অসফল’ পরীক্ষার্থীদের আত্মহত্যা আর আত্মহত্যাচেষ্টার খবর আসতে থাকে। নানা কারণে, এবারও সে রকম ঘটার আশঙ্কা বেশি বৈ কম নয়।
করোনার কারণে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। মৌলিক বিষয়গুলো বাদ দিয়ে শুধু বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা দিতে হয়েছে। সারা দেশে সব মিলিয়ে ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এদের অনেকেরই অকালে বিয়ে হয়েছে, কেউ সন্তান কোলে পরীক্ষা দিতে এসেছে। চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে এসেছিল অনেকে। ছুটি না পেয়ে চাকরি ছেড়ে এসেছে কেউ কেউ। ইচ্ছা আর আশা থাকলেও সবার আশা পূরণ হবে না। অনেকের নাম ফলাফলের তালিকায় থাকবে না। থাকবে না প্রত্যাশিত বা আশানুরূপের তালিকায়। শঙ্কা এই আশাহত পরীক্ষার্থীদের নিয়ে।
অনেকেই কথিত ‘অনলাইন’ শিক্ষণ ধরতে পারেনি। মা–বাবা কিনে দিতে পারেননি কার্যকর আর বেশি দামের মুঠোফোন। ‘অ্যাসাইনমেন্টের’ ঘোর প্যাঁচ বুঝতে পারেনি অনেকে। তবু আশায় বুক বেঁধে পরীক্ষা দিয়েছে দলে দলে। যারা আশাহত হবে, তাদের অনেকেই ঝরে যাবে। করোনাকাল থেকেই লেখাপড়ার খরচ বেড়ে যাওয়ায় কেউ আর হয়তো দ্বিতীয়বার চেষ্টার কথা ভাববে না। চাকরি, সংসার, সন্তান পালনে ডুবে যাবে। পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের অনেকের মধ্যে জীবন থেকে ডুবে যাওয়ার মানে, আত্মহত্যার প্রবণতা নতুন কিছু নয়।
পরীক্ষার ফলাফলের পর আত্মহত্যার খতিয়ান
২০১৮ সালে এসএসসিতে ২০ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৪ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেবার অকৃতকার্য হয় ৪ লাখ ৫০ হাজার ৪৭০ জন। আগের নয় বছরের মধ্যে এই হার ছিল সব থেকে বেশি। ফলাফল প্রকাশের সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২২ জন কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এদের মধ্যে ১০ জন মারা যায়।
মাধ্যমিক পরীক্ষা ২০২০–এর ফলাফল প্রকাশ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২১ জন কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এদের মধ্যে ১৯ জনই ছিল কিশোরী। একই বছর জানুয়ারি মাসে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও নিম্ন মাধ্যমিকের (জেএসসি) সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে ১৭ জন শিশু আত্মহত্যা করে। এখানেও আনুপাতিক হারে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। ১৭ শিশুর ১০ জনই ছিল মেয়ে।
চলতি বছরে (২০২১) পরীক্ষা, ফলাফল ইত্যাদির ঝামেলা না থাকলেও শিশু–কিশোরদের আত্মহত্যা বন্ধ ছিল না।
গত ৫ অক্টোবর ২০২১ জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই মর্মে সতর্ক করা হয়েছিল যে শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সার্বিক সুস্থতার ওপর কোভিড-১৯–এর প্রভাব অনেক বছর ধরে থাকতে পারে। প্রতিবেদনে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, সারা দুনিয়ায় ১০-১৯ বছর বয়সী প্রতি ৭ জন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে ১ জনেরও বেশি মানসিক সংকট নিয়ে জীবন যাপন করছে। প্রতিবছর প্রায় ৪৬ হাজার কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করে। ১০-১৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান পাঁচটি কারণের একটি হচ্ছে আত্মহত্যা।
এ সময় বয়স ও লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কোভিড-১৯ মহামারি। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন গত ১৩ মার্চ ২০২১ জানায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যা ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। তারা তুলনা করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত বছরের এ-সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের সঙ্গে। সংগঠনটির হিসাবে, এক বছরে আত্মহত্যার সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০১৯ সালে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। আত্মহত্যার ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের সংখ্যা ছিল ৩৫ শতাংশ। বলা বাহুল্য, এদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী।
গবেষণায় আত্মহত্যার যেসব কারণ
গত ৫ অক্টোবর ২০২১ জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই মর্মে সতর্ক করা হয়েছিল যে শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সার্বিক সুস্থতার ওপর কোভিড-১৯–এর প্রভাব অনেক বছর ধরে থাকতে পারে। প্রতিবেদনে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, সারা দুনিয়ায় ১০-১৯ বছর বয়সী প্রতি ৭ জন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে ১ জনেরও বেশি মানসিক সংকট নিয়ে জীবন যাপন করছে। প্রতিবছর প্রায় ৪৬ হাজার কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করে। ১০-১৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান পাঁচটি কারণের একটি হচ্ছে আত্মহত্যা।
২০১৮ সালে প্রকাশিত লন্ডনের কিংস কলেজের একটি গবেষণায় দেখা যায়, যেসব কিশোর–কিশোরী অবহেলা, কটূক্তি, পারিবারিক সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার, তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। আমাদের দেশে পরীক্ষায় খারাপ করা শিক্ষার্থীদের প্রতি অভিভাবক, শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন, এমনকি ‘সফল’ সহপাঠী বন্ধুবান্ধবের নীরব-সরব অবহেলা, কটূক্তি, সহিংসতা ও নিপীড়নের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়।
তবে কৈশোর বয়সে এমন সব সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তাদের আত্মহত্যার প্রবণতাও বন্ধ করা যেতে পারে। উল্লেখিত গবেষণায় সে কথাও বলা হয়েছে।
অনেক সংবেদনশীল অভিভাবক, শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে তাঁরাও বেশ চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। আত্মহত্যা ঘটে যাওয়ার পর অনেক কথা হয়, কিন্তু আগে বিষয়টি আঁচ করে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা কেউ ভাবে না।
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, যদি পরীক্ষার্থীর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আগে থেকেই অনুভব করতে পারে যে কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আছে, তাহলে তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর চেষ্টা করে জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে।
আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের চেনার উপায় কী
অনেকে ধীরে সুস্থে চিন্তাভাবনা করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তাঁদের ক্ষেত্রে ইঙ্গিত পাওয়া সহজ, কিন্তু হঠাৎ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আগাম আলামত আঁচ বা অনুমান করা সহজ নাও হতে পারে। তবে কাছের মানুষ, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের পক্ষে টের পাওয়া সহজ বলে মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন। সাধারণত যেসব আলামত দেখা যায় বলে গবেষকেরা মনে করেন, সেগুলো হলো—
১. আত্মহত্যা বা মৃত্যু নিয়ে কথা বলা বা লেখা; অনেক সময় কথাবার্তাতেও ইঙ্গিত মেলে। যেমন ‘আমার মরণই ভালো’ বা ‘আমি সব শেষ করতে যাচ্ছি’ অথবা ‘বেঁচে থাকার মানে কি? ’, ‘শিগগিরই তোমাকে আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না’ অথবা ‘আমি মারা গেলে কে চিন্তা করবে?’ ইত্যাদি।
২. চেহারা ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির প্রতি অবহেলা।
৩. নিজেকে বন্ধু ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা।
৪. নিজের প্রিয় বস্তু বা মূল্যবান জিনিস অন্যকে দিয়ে দেওয়া।
৫. স্কুল বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান, খেলাধুলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া।
৬. এই মনমরা হয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে, আবার পরক্ষণে খুব উৎফুল্ল হয়ে সবার সঙ্গে মিশছে।
৭. প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ সংগ্রহের চেষ্টা।
এসব আলামতের একটিও দেখা না গেলে মন খারাপের চাপে যেকোনো শিশু–কিশোর আত্মহত্যার ঝুঁকি নিতে পারে। তাই ঘনিষ্ঠদের উচিত হবে এ ধরনের মানুষের সঙ্গে আন্তরিক আচরণ করা। একা থাকতে না দেওয়া। ‘সফল’ বাবা–মায়েদের লাগামহীন আর লোকদেখানো আনন্দ–উল্লাস থেকে বিরত রাখা। সর্বোপরি সংকটে থাকা শিশু–কিশোরদের মনে সাহস জোগানো। পরীক্ষায় ফেল–পাসের চেয়ে জীবনটা অনেক বড়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *