ফলনের খুশবু চালের দামে নেই

দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২২)

চারদিকে আমনের ব্যাপক ফলনের সুখবর। ব্যাপক বলে স্বাদ মেটে না। তাই বলছে বাম্পার ফলন। কিন্তু বাম্পারের সুবাতাস চালের বাজারে পৌঁছাচ্ছে না। দাম কমার কোনো আলামত কোনো বাজারেই নেই। মোটা চালের দাম পাইকারিতে সামান্য কমতির দিকে থাকলে খুচরা বাজারে তার প্রতিফলন নেই। পাবনার বাজারে মোটা চাল হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে।

সেখানে গত আগস্টে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি প্রায় দশ টাকা বেড়েছিল। সেই বাড়তি দাম আর কমেনি। সাধারণত নভেম্বরের শেষে বা ডিসেম্বরের শুরুতে নতুন আমন ধানের চাল বাজারে আসতে থাকে। ফলে তখন থেকেই চালের দামে চড়াভাব কমতে থাকে। তবে এবার তেমনটি ঘটেনি। খুচরা বাজারে বাড়তি দামেই হাঁকা হচ্ছে। সরবরাহে কোনো সংকট নেই। আড়তে আড়তে চালের বস্তার কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু দাম যেই কার, সেই।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, চালের উৎপাদন প্রতিবছর বাড়ছে। বাজারে চালও আছে ‘পর্যাপ্ত’। কিন্তু দাম কমছে না। বলা বাহুল্য, সেই পরিস্থিতির কোনো রকমফের ঘটেনি। আজকাল প্রায়ই আরও এবং দ্রুততার সঙ্গে উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য রোডম্যাপ প্রণয়নের কথা শোনা যাচ্ছে। বাড়তি উৎপাদন কি চাল-ডালকে মানুষের নাগালের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে পারবে? যদি সেই বিষয়ে ‘কবি’ নীরব থাকেন, তা হলে এ রোডম্যাপ দিয়ে কী হবে? এ রকম মুশকিল প্রশ্ন করার হিম্মত আমজনতার নেই। তাদের শুধু শুনেই যেতে হবে। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির রোডম্যাপ চালের দাম কমাতে কীভাবে ভূমিকা রাখবে, সেটি পরিষ্কার হওয়া দরকার। যেখানে চালের কোনো কমতি নেই, সেখানে দাম কমানোর জন্য উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করলেই যে দাম কমে যাবে, এমন তত্ত্ব পাঁড় তাত্ত্বিকরাও নিমক ছাড়া গ্রহণ করতে নিমরাজি হবে। এ ধরনের ছেলে ভোলানো বক্তব্য থেকে মালুম হয়, আমাদের কোথায় যেন একটা গা-ছাড়া ভাব আছে। আমরা সমস্যার মূলে যেতে আন্তরিক নই, সিরিয়াস নই। মূল সমস্যায় হাত দেওয়ার সদিচ্ছা, ক্ষমতা বা তাকদ মন্ত্রী-আমলাদের কারোরই আছে বলে মনে হয় না। হয়তো কোনো পর্যায়েই সম্ভবত সেটি নেই। খাদ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী বলেই চলেছেনÑ সরকারি মজুদের কোনো ঘাটতি নেই, তার পরও চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

মজুদ কত?

সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে আমন সংগ্রহ অভিযানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, বর্তমানে সরকারের গুদামে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্যের মজুদ আছে। খাদ্য নিরাপত্তায় এই মজুদ আরও বৃদ্ধি করা হবে। নানা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১০ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। আর গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছিল। সব মিলিয়ে বর্তমানে সরকারের গুদামে ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। এর মধ্যে চাল ১২ দশমিক ৩২ লাখ ও গম ২ দশমিক ৭৬ লাখ টন। উল্লেখিত অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেনÑ কেউ যেন অবৈধ মজুদ করে খাদ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনো কারণ ছাড়া চালের দাম বৃদ্ধি করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব হুঁশিয়ারি কেউ খুব একটা গায়ে মাখে বলে মনে হয় না।

চালের বাজারের মূল নিয়ন্ত্রক কারা?

এই প্রশ্নের উত্তর যে যার মতো করে দেয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই জানে, বড় বড় চালকল মালিক ঘুঁটি চেলে ঘরে বসে। তারাই চালের বাজারের মূল নিয়ন্ত্রক। তাদের শৌখিন নাম মিলার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় মিলারদের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি করা দরকার। সরকার সেদিকে হাঁটছে? মুখে বলছেÑ কারও কারসাজি, মজুদদারি সহ্য করা হবে না। কিন্তু এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নজরে আসে না। খাদ্যমন্ত্রী একবার রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবৈধ মজুদদারি রোধে করণীয় ও বাজার তদারকি সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় বলেছিলেন ‘এবার বোরোয় যেমন বাম্পার ফলন হয়েছে, তেমনি আমনেও বাম্পার ফলন। জাতীয় মজুদে ঘাটতি নেই। এ সময় চালের দাম বাড়ছে। এটা হাস্যকর। এখন চালের দাম বৃদ্ধিটা ভালো ঠেকছে না।’ বছরে শুরুতে (১১ জানুয়ারি ২০২২) চালের দাম কেন কমে না, সেটির কারণ খুঁজে বের করার জন্য এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ এক জলসার আয়োজন করেছিল। সেখানে কেউ কারও সঙ্গে একমত হতে পারেননি। উপস্থিত চারপক্ষ মতান্তরে পাঁচপক্ষ (কৃষক, চালকল মালিক, গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা) সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী বক্তব্য দেয়। মিলাররা বলেছিলেন, বাজারে চালের ঘাটতি আছে (অর্থাৎ সরকারের হিসাবে ভুল)। সময়মতো শুল্ক কমোনার সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় চাল আমদানি করা যায়নি। তাই চালের দাম কমে না।

গবেষকদের মত ছিল, সরকার বাজার তদারকিতে ফেল করে। তাদের গাফলতি আছে ধান উৎপাদনের প্রাক্কলন প্রক্রিয়াতেও। তাই দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। নীতিনির্ধারকরা এর কোনোটাই না মেনে বলেছিলেন, আমাদের হিসাব ঠিক আছে। উৎপাদনের প্রাক্কলন সঠিক ছিল। বাজারে চালের কোনো ঘাটতি নেই।

উল্লেখিত আলোচনায় মাঠের মানুষজনকেও প্রযুক্তির মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছিল। দেশের উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল ও হাওরাঞ্চলের ৯টি জেলা (গাইবান্ধা, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, মেহেরপুর, নীলফামারী, রংপুর, সিরাজগঞ্জ ও কুড়িগ্রাম) থেকে ৪০ কৃষক, কৃষাণী এবং কৃষি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি এই সংলাপে যুক্ত হন। তাদের কথা একটাইÑ মিল মালিকরা আগেই ধান কিনে মজুদ করে রাখেন।

গত দশ মাসে পরিস্থিতির কিছুই পাল্টায়নি, বরং নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এসবের মধ্যে আছে-

১. জ্বালানি তেল তথা ডিজেলের বাড়তি দাম

আগে মোকাম থেকে চাল আনতে যে ট্রাক ভাড়া ছিল ১৭ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা, এখন তা নেওয়া হচ্ছে ২৪ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। এই বাড়তি ভাড়া চালের দামের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে সেচের খরচ বেড়েছে। বৃষ্টি ঠিকমতো না হওয়ায় অনেক জায়গায় এবার আমনেও সেচ দিতে হয়েছে।

২. সারের মূল্যবৃদ্ধি

ডিজেলের পাশাপাশি সব ধরনের সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ধানের উৎপাদন খরচ আর আগের মতো ছিল না। অনেকটাই বেড়ে যায়। ফলে গত বছরের চেয়ে এবার মণপ্রতি ধানের দাম ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেশি। এর প্রভাবও স্বাভাবিকভাবেই চালের দামের ওপর পড়েছে।

৩. বেকায়দা মূল্যস্ফীতি

গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। তা ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অবশ্য নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশে এসেছে। তবে বাজারে এখনো স্বস্তি নেই।

৪. ডলার সংকট

বাজারে চালের দাম বাড়তে থাকায় সরকার কম শুল্কে আমদানির অনুমতি দিয়েছে। তবে ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে গতি নেই। বাড়তি দামে এখন বড় চালানে চাল আমদানি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। এতে খুচরা বা পাইকারিÑ কোনো বাজারেই চালের দামে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি।

৫. আচানক লোডশেডিং

পাইকাররা বলেছেন, লোডশেডিংয়ের কারণে মিল মালিকদের বিকল্প উপায়ে ধান থেকে চাল করতে হচ্ছে। তাতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি যাওয়ায় চালের দাম আরও বাড়তে পারে। এদিকে আমদানি কম হচ্ছে। যেটুকু বাজারে এসেছে, সেটিও দেশি চালের দামের প্রায় সমান। এতে বাজারে প্রভাব নেই।

৬. গমের মূল্যবৃদ্ধি

চালের দাম বৃদ্ধির একটা কারণ গমের দাম বেড়ে যাওয়া। কৃষিমন্ত্রির ভাষ্য অনুযায়ী গমের দাম বাড়লে চালেরও দাম বাড়ে। এখন গমের দাম চালের চেয়েও বেশি। যখন আটার দাম কম থাকে, তখন মানুষ আটা খায়। এখন আটার দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে মানুষ আটা খাওয়া ছেড়ে দিয়ে চাল খাওয়া শুরু করেছে। এ জন্য চালের দাম বেশি।

৭. করপোরেটদের খাদ্য ব্যবসা

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিল মালিক ও আড়তদারদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা দেশি-বিদেশি করপোরেট প্রতিষ্ঠান। অনেকেরই এখন প্রধান লগ্নি খাদ্য ব্যবসায়। এখন চালের গোটা বাজার চলে গেছে তাদের কেনাবেচার কৌশলের অধীন। বাজার আর এখন মৌসুম অনুযায়ী চলছে না, চলছে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও বড় মিল মালিকদের অঙ্গুলি হেলনে। তারা যেভাবে চালায়, সেভাবে চলে।

এসব ছাড়াও তথাকথিত খাদ্য সংকট আর দুর্ভিক্ষের আগাম বাণী প্রচারিত হওয়ায় যে যা পারছে আটকিয়ে রাখছে, বাজারে ছাড়ছে না। বাজারে ছাড়ার মতো ধান কৃষকের হাতে এবার কম আছে। যান্ত্রিকভাবে ধান কাটার সুযোগ যেখানে আছে, সেখানেই পাইকাররা ওরফে কল মালিকদের লোকজন হারভেসটারের সঙ্গে সঙ্গে নগদ টাকা আর বস্তা নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। মাঠ থেকেই নগদ টাকায় ধান কিনে নিচ্ছে তারা।

এসব ডামাডোলের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে ‘কৃষিপণ্য মূল্য কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব। এই কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্ষেপণ ও স্বল্প-মধ্য মেয়াদে দাম নির্ধারণ করা সহজ হতে পারত, বাজার সংকেত পেত, নীতিনির্ধারকরা অবস্থা বুঝে পদক্ষেপ নিতে পারতেন এবং গবেষণাকে কার্যকরভাবে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত করা যেত।

Leave a Reply