শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভিড় বাড়ছে বার্ন ইউনিটেও

শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে যায় অনেকে। এ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ৫ জানুয়ারি ২০২৩)

জানুয়ারি মাসে ঠান্ডা বাড়বে। আবহাওয়াবিদেরা বলে দিয়েছেন এই মাসে শীত কমপক্ষে তিনটা কড়া ঝাঁকুনি দেবে। এসব ঝাঁকুনিকে কাগজে-কলমে শৈত্যপ্রবাহ বলে।

আবহাওয়া দপ্তর ২ জানুয়ারি জানিয়েছে, পুবালি লঘুচাপের বর্ধিতাংশ বাংলাদেশ এবং এর আশপাশে অবস্থান করায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কিছু জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।

এবার একেকটা শৈত্যপ্রবাহ থাকার সময় হবে দুই থেকে তিন দিন। তবে এটা কাগুজে হিসাব। ওমহীন মানুষের জাড় চট করে কাটে না। আবহাওয়া কার্যালয়ের হিসাব আর জাড়ের হিসাব এক হয় না সব সময়। তাই শৈত্যপ্রবাহের আনুষ্ঠানিক তারিখ আসার আগেই মানুষ আগুন তাপানো শুরু করেছে।

ঠান্ডা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আগুনে পোড়া মানুষের মিছিল। তাঁদের বেশির ভাগই পুড়ে যান আগুন পোহাতে গিয়ে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গত এক মাসে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হওয়া ২৮ রোগী ভর্তি হয়েছেন।

মারা গেছে এক শিশু। ঢাকার বাইরের বার্ন ইউনিটগুলোর ক্ষমতা সীমিত হওয়ায় তারা সব রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারে না। শরীরের ৩০ শতাংশের ওপরে পোড়া হলে রোগী ভর্তি করা হয় না, ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে যেতে বলা হয়।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বছরে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ আগুনে পুড়ে আহত হন। চার বছর আগেও বলা হতো প্রতিদিন গড়ে ৫০০ জন হিসাবে বছরে অগ্নিদগ্ধ হন ১ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ জন। হিসাবের এদিক-ওদিক হতে পারে, তবে আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা যে দিন দিন বাড়ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য, আগুনে পোড়া অনেকেই বার্ন ইউনিট বা বার্ন ইনস্টিটিউট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না। তাঁরা হিসাবের বাইরেই থেকে যান।

শয্যা খালি নেই বার্ন ইনস্টিটিউটে


বার্ন ইউনিটে রোগীর চাপ সারা বছরই থাকে, তবে শীতে চাপ থাকে বেশি। এ জন্য প্রস্তুতিও নিতে হয় আলাদা করে। গত বছর শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সেবা নেওয়া মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৬ হাজার ৬২৫। এর মধ্যে প্রায় ৪৫ ভাগ রোগীই ছিলেন শীতকালের (অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ)। শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে বেশি পুড়ছেন নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। শাড়িতে আগুন লাগার মুহূর্তে টের পাওয়া যায় না।

যখন পাওয়া যায়, ততক্ষণে শরীরের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে চাদর বা কম্বলে আগুন লাগে। অন্যদিকে গরম পানিতে শিশুরা পুড়ছে বেশি। অভিজ্ঞতা ও কেস স্টোরি যাচাই করে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি প্রকল্পগুলোর সমন্বয়কারী অধ্যাপক সামন্ত লাল সেন বলেন, দেখা যায়, গোসল করার সময় গরম পানি পাতিলে করে গোসলখানায় নিতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। অথচ পানি বালতিতে করে নিয়ে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটত না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইনস্টিটিউটের ৫০০ শয্যার একটিও এখন খালি নেই। প্রতিদিন গড়ে ৬০ জন রোগী আসছেন জরুরি বিভাগে। আর ২৩০ থেকে ২৫০ রোগী আসেন বহির্বিভাগে। এর মধ্যে খুবই সংকটাপন্ন ১০ থেকে ১২ জনকে ভর্তি করা হয়। অপেক্ষায় থাকছেন অধিকাংশই।

আগুন লাগার পরে তাৎক্ষণিক কী করতে হবে, তা বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারেন না। ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরনে থাকা উলের তৈরি সোয়েটার, লেপ, কাঁথা বা কম্বল—এমন ভারী কাপড়ে অনেক দ্রুত আগুন ছড়ায় এবং তার তীব্রতা বেশি থাকে। ফলে পুড়ে যাওয়ার মাত্রাও তুলনামূলক বেশি হয়। গরম পানির ব্যবহার ও আগুন পোহানোর সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে এ দুর্ঘটনার হার কিছুটা কমানো যাবে।


কী করা যায়?
২০১৮ সালে অধ্যাপক সামন্তলাল সেনকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এ রকম প্রশ্ন করা হলে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, হাসপাতালগুলোতে শয্যা বাড়িয়ে আগুনে পোড়া রোগী সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। দরকার মানুষকে সচেতন করা। মানুষের অভ্যাস বদলানো ও আগুন থেকে দূরে থাকার কথা বলতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার, গণমাধ্যম, চিকিৎসক সমাজ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।

আগুন লাগার পরে তাৎক্ষণিক কী করতে হবে, তা বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারেন না। ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরনে থাকা উলের তৈরি সোয়েটার, লেপ, কাঁথা বা কম্বল—এমন ভারী কাপড়ে অনেক দ্রুত আগুন ছড়ায় এবং তার তীব্রতা বেশি থাকে। ফলে পুড়ে যাওয়ার মাত্রাও তুলনামূলক বেশি হয়। গরম পানির ব্যবহার ও আগুন পোহানোর সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে এ দুর্ঘটনার হার কিছুটা কমানো যাবে।

আগুন পোহাতে সতর্কতা
শীতের সময় সাধারণত গরম পানির ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। এ সময় শিশুদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও প্রতিবন্ধীদের গোসলের পানি বা অন্যদের গোসলের গরম পানি ইত্যাদির কাছাকাছি যেন না যায় তা খেয়াল রাখতে হবে। শাড়ির আঁচলে আগুন লেগে গেলে শীতের তীব্রতার কারণে বোঝা যায় না। আগুন পোহানোর সময় শাড়ি শরীরের সঙ্গে ভালোভাবে পেঁচিয়ে রাখতে হবে।

ইদানীং গ্রামে শাড়ির বদলে ম্যাক্সি পরার হার অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে আগুন পোহাতে গেলে আরও বেশি সাবধান হতে হবে। আগুন পোহানোর সময় গায়ের ওড়নাসহ ম্যাক্সি ভালোভাবে গুছিয়ে নিতে হবে। শীতের মধ্যে এলাকার কিশোর-বালকেরা মিলে খড়ের গাদার পাশে আগুন জ্বেলে তাপ পোহাতে গিয়ে সেই গাদা পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। কৃষকের জন্য এ ক্ষতি অপূরণীয়। কৃষকের খড় যেখানে আছে, তার থেকে দূরে আগুন পোহালে ভালো। সম্ভব হলে আশপাশে কৃষকের খড় বা কারও ঘর নেই এমন স্থানে আগুন পোহানো ভালো।

আগুন পোহানো হয়ে গেলে আগুন ভালোভাবে নিভিয়ে দিতে হবে। অজান্তে কোনো ব্যক্তি বা প্রাণী সেখানে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যঁারা বারবিকিউ পার্টি করবেন, তঁারা যতটা সম্ভব সাবধানে সেটা করবেন। কাজ হয়ে গেলে নিশ্চিত হোন আপনার ফায়ার প্লেসের আগুন পুরোপুরি নিভেছে কি না। আগুনের সামান্য ফুলকি থেকেও বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

চুলার ওপর দড়ি টানিয়ে শীতের কাপড় শুকানোর ব্যবস্থা করা হয়। এই কাজ একেবারেই করা যাবে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *