‘হাত থাকতে মুখে কেন’

প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত মতামতটি লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা।

‘মানুষ ও মানুষ, দুডো কান আর দুডো চোখ/ দেখপা আর শুনবা/ কিন্তু একটা মুক! তো কথা কম কবা…তোমার মেলা ঝামেলা কমে যাবে/ একটু চুপ করে থাকপা…’

গুরুপদ গুপ্তর কথায় আর সুরে লোকসংগীত ঘরানার এই গান ‘মানুষ ও মানুষ’ একসময় বেশ মনে ধরেছিল নগরহীন নাগরিকদের। গানে কবি বারবার কম কথা বলার অনুরোধ করেছেন। তাঁর সহজিয়া যুক্তিতে দুটি করে কান-চোখ থাকলেও মুখ যখন একটা, তখন কথা কম বলাই উচিত। তাতে ঝামেলা কমে যাবে। লোকসংগীতের মর্মকথা আর লেখা কথার মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। গুরুপদ গুপ্তর এই গান এর ব্যতিক্রম নয়। যাঁরা ঝুটঝামেলা এড়াতে চান, তাঁদের জন্য গুরুপদ গুপ্তর বাণী ঠিক আছে। কিন্তু যাঁদের ঝামেলা পছন্দ বা শর্টকাটে ঝামেলা শেষ করতে চান, তাঁদের বিধান ভিন্ন। তাঁরা আজকাল একেবারেই কথা কম বলছেন, বলতে গেলে মূক থাকছেন, কিন্তু হাত-পা বাঙ্‌ময় করে তুলছেন। মুখকে পূর্ণ অবসরে পাঠিয়ে হাত-পা দিয়ে পিটিয়ে, কিল-ঘুষি-লাথি দিয়ে উতরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

সব স্কুলেই এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ঘটা করে বিদায় জানানোর একটা রেওয়াজ আছে। সেদিন তাদের তোয়াজ করে বসানো হয়। প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে স্কুলের অন্য শিক্ষার্থীরা তাদের প্রশংসা করে, শুভকামনা করে। কান্নাকাটি, মাফ চাওয়াচাওয়ি, শিক্ষকদের সঙ্গে একটা গ্রুপ ছবি, অল্পবিস্তর খাওয়াদাওয়া—এসব দিয়েই দিনটি শেষ হয়। এ রকম একটা দিনে রাজধানীর একটা স্কুলে বিদায়ী শিক্ষার্থীদের ওপর বাঁশ নিয়ে চড়াও হয়েছিলেন সেই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক। বেধড়ক পিটিয়ে কয়েকজনকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। পরে পুলিশ এসে প্রধান শিক্ষককে থানায় নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এমন গোল বাধার কারণ নিয়ে নানা মত শোনা গেছে। কেউ বলছেন তবারক বিতরণ নিয়ে ‘কাইজ্যা’র সৃষ্টি। ছেলেরা আগে পাবে, না মেয়েদের আগে দেওয়া হবে—সে প্রশ্নের সমাধান করতেই বলপ্রয়োগ-মারধর। কেউ বলছেন তবারক হিসেবে বিরিয়ানি বিতরণের কথা থাকলেও শুধু মিষ্টি বিতরণ করে কাজ সারতে চেয়েছিলেন স্কুলপ্রধান, তাতেই তেতে ওঠে পরিবেশ। কারণ যা-ই হোক, মারধর কেন হবে? কেন শিক্ষকের হাতের বাঁশ উঠবে শিক্ষার্থীদের গায়ে?

শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের মারপিট করবেন—এটা তাঁদের একটা অধিকার বলে মনে করেন অনেক অভিভাবক। এসব অভিভাবক বুক ফুলিয়েই বলেন, ‘আমার ওস্তাদ, আমার শিক্ষক আমাকে পিটিয়েই মানুষ করেছেন; অতএব পেটানোর লাইসেন্স আমরা উত্তরাধিকারসূত্রেই অর্জন করেছি। এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাই বুরবুকি।

বছর কয়েক আগে ঢাকায় ছাত্রদের শাস্তি প্রদানের ওপর এক গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আয়োজকেরা তাদের এক জরিপের ফলাফলের সূত্র দিয়ে জানায়, ৫৫ শতাংশ অভিভাবক মনে করছেন, স্কুলে শাস্তির মাধ্যমে শিশুকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যায়। আবার ২৭ শতাংশ অভিভাবক মনে করছেন, শাস্তি না হলে শিশুরা বখে যায় এবং ২৫ শতাংশের মতে, শাস্তি দিলে শিশুরা শিক্ষকদের কথা শোনে। আইনি সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ব্লাস্ট পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে, ‘৬৯ শতাংশ মা-বাবা নিয়মানুবর্তিতার জন্য স্কুলে শিশুদের বেত্রাঘাতসহ শাস্তির বিধানের পক্ষে।’

এখন জোয়ার উল্টো বইতে শুরু করেছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলছেন। মনোবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে অনেক আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সহিংসতার মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশুরা মনে করে, সহিংসতা জীবনের চলার পথের একটা পাথেয়। গায়ে হাত তোলা কোনো ব্যাপার নয়। গত এপ্রিলে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে মাদ্রাসাশিক্ষক সামসুল হককে পিটিয়ে আহত করে তাঁর ছাত্র। একা নয়, ছাত্রের সঙ্গে আরও কয়েকজন সহযোগী ছিল। আহত শিক্ষককে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল।

শুধু বর্তমান ছাত্র নয়, প্রাক্তন ছাত্ররাও দল বেঁধে শিক্ষক পেটাচ্ছে। লক্ষ্মীপুরের টুমচর আসাদ একাডেমির ভৌতবিজ্ঞানের এক শিক্ষককে দিনদুপুরে বিদ্যালয়ের প্রবেশমুখেই পিটিয়ে আহত করে (মে ২২, ২০২২)। সেই শিক্ষককেও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।

মারপিট, কিলঘুষি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে

সেই চেয়ারম্যান এবার পেটালেন স্বাস্থ্যকর্মীকে! এবার উপজেলা চেয়ারম্যানকে সংসদ সদস্যের কিলঘুষি! অধ্যক্ষকে পেটালেন এমপি! নেতা-কর্মীদের হাতাহাতি-মারামারি, মুহূর্তেই ভেঙে গেল মঞ্চ! টেলিভিশনের লাইভ প্রোগ্রামে রাজনৈতিক নেতা-সুশীলদের হাতাহাতি! এগুলো ক্রমে প্রতিদিনের সংবাদ শিরোনামের নিয়মিত অংশ হয়ে যাচ্ছে। সভার কথা বলে অফিসে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষকে শারীরিকভাবে ‘সংস্কার’ করে দিচ্ছেন এমপি। ‘হাত থাকতে মুখে কেন, মেরে হাড়গোড় ভেঙে দেব’ দিন কে দিন এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক বুলিতে পরিণত হয়েছে। শুধু বুলি নয়, মুখের চেয়ে হাত-পায়ের ব্যবহার বাড়ছে বৈ কমছে না। টেলিভিশনে টক শোতে মারামারি-হাতাহাতি পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ—সব দেশের দর্শকেরা কমবেশি দেখেছেন, দেখছেন।

মানুষ কেন শারীরিকভাবে আঘাত করে

মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, যখন কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সঙ্গে সহিংস আচরণ করেন, তখন অপর ব্যক্তিটিকে তিনি আর মানুষ জ্ঞান করেন না, বরং একটি অবজেক্ট হিসেবে বিবেচনা করেন। মার্শাল ম্যাকলুহান বলছেন, মানুষ সহিংসতার মাধ্যমে তার আত্মপরিচয় খোঁজে। সব ধরনের সহিংসতাই হচ্ছে মানুষের নিজের পরিচয় খোঁজা। তাঁর কথায়, নিজেকে কেউকেটা প্রমাণের আকাঙ্ক্ষা থেকে একজন লোক অন্য একজনের প্রতি সহিংস আচরণ করার তাড়না অনুভব করে।

এসব তাড়নাকে বশে রাখাটা এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের মানসগঠনের কারিগরদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। মার দেওয়া আর মার খাওয়া—দুই পক্ষকে চা খাইয়ে মিটমাট করার কৌশল আসলে মার দেওয়া পক্ষকেই আশকারা দেয়। অন্য পক্ষ মনের কষ্ট মনে পুষে রেখে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সব সহিংসতাকে স্বচ্ছ আইনের আওতায় আনতে হবে; ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে একসময় দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়ে যাবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *