পশ্চিমবঙ্গে অ্যাডেনোভাইরাস: ভয়ের কিছু নেই, তবে ভাবনার আছে অনেক

পশ্চিমবঙ্গে অ্যাডেনোভাইরাস নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৩)

অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, পশ্চিম বাংলা কোনো ছোঁয়াচে রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বাংলাদেশে তার ছোঁয়া লাগে। তাই প্রতিরোধের পাশাপাশি দেশের হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখার দিকেও আমাদের মনোযোগী হতে হবে।

বাংলাদেশের দুয়ারে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন শিশু মারা যাচ্ছে অ্যাডেনোভাইরাসে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ফেরানো কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। জ্বর ও শ্বাসকষ্টের উপসর্গ দেখা দিলেই আতঙ্কে অভিভাবকেরা বড় হাসপাতালের দিকে ছুটছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একেবারে ছোট আর অন্য অসুখে আগে থেকে ভোগা শিশুদের বাঁচানো যাচ্ছে না। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের লাগোয়া এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ৪২ শিশুর মৃত্যু নিশ্চিত করেছে নানা সূত্র। এরা সবাই অ্যাডেনোভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসার জন্য নানা হাসপাতালে ছোটাছুটি করেছে। মার্চের প্রথম দুই দিনে এ মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছে আরও পাঁচ শিশু।

পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই জানিয়েছেন, অ্যাডেনোভাইরাস অন্যান্য রাজ্যেও রাজ করছে। আতঙ্কের কিছু নেই। আমাদের যত্ন নিতে হবে। এখন শিশুদের নিয়ে বাড়ির বাইরে না বেরোনোই ভালো। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব বলেছেন, ‘আমি অনেক ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরাও বলেছেন, আতঙ্কের কারণ নেই। আমরা প্রথম থেকে পরিস্থিতির ওপর নজর রেখেছি। সব রাজ্যেই এটা হচ্ছে। শিশুদের চিকিৎসার পর্যাপ্ত পরিকাঠামো রয়েছে। সাবধানতা বজায় রাখলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’

বাংলাদেশে কি প্রভাব ফেলতে পারে
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবেশী দেশে যাওয়া-আসার সনাতন আর জনপ্রিয় দরজাগুলোর বেশির ভাগই পশ্চিম বাংলামুখী। আবার এ দেশের একটা বড় অংশের মানুষ চিকিৎসা ও চিকিৎসাপরবর্তী শুশ্রূষা নিতে সে দেশে যান। হাসপাতালে হাসপাতালে ঘোরেন, অন্যরা শপিং মল, পার্ক, সিনেমা হল বা ঠাসা যাত্রী নিয়ে চলাচলকারী যানবাহনে চড়েন। এ কারণে অ্যাডেনোভাইরাসের মতো ছোঁয়াচে ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি আমাদের পুরাদস্তুর আছে। গবেষকেরা বলছেন, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অ্যাডেনোভাইরাসের বিস্তার জনাকীর্ণ পরিবেশে ঘটতে পারে। আপনি যদি কোনো বোর্ডিং, হোটেল বা হোস্টেলে সময় কাটান, তাহলে আপনার ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি হতে পারে। ভাইরাসটি সাধারণত হাসপাতাল ও নার্সিং হোমে থেকেও ছড়ায়।।
অ্যাডেনোভাইরাস কী
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি একটি সাধারণ ভাইরাস, যা ঠান্ডা বা সাধারণ ফ্লুর ভাব নিয়ে সংক্রমিত হতে পারে। এখন পর্যন্ত গবেষকেরা ৫০ কিছিমের অ্যাডেনোভাইরাস খুঁজে পেয়েছেন। অ্যাডেনোভাইরাসের সংক্রমণ বছরজুড়েই ঘটতে পারে, তবে শীত ও বসন্তকালের শুরুতে এগুলো বাড়বাড়ন্ত থাকে। হালকা থেকে গুরুতর সংক্রমণ হলেও গুরুতর অসুস্থতা সব সময় ঘটে না। কিন্তু এবার ঘটছে। সব বয়সের মানুষই অ্যাডেনোভাইরাসের খপ্পরে পড়তে পারে। তবে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। এ বয়সের শিশুরা স্কুলে না গেলেও চাকরিজীবী মা-বাবার শিশুরা দিবাযত্ন কেন্দ্রে যায়। সংক্রমণের জন্য এগুলো আদর্শ জায়গা। এখানে শিশুরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসে। এখানে খেলার ছলে একে অপরের মুখ লাগানো খাবার, পানির বোতল শেয়ার বা বদল করে। এসব জায়গায় শিশুদের ঘন ঘন হাত ধোয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তা ছাড়া মাস্ক তাদের জন্য নয়।

বড়রা কি নিরাপদ
এ ভাইরাস বড়দের চট করে কাবু করতে পারে না। তবে কম্প্রোমাইজড রোগী, মানে অন্য রোগে জেরবার—এমন বড়দের বিপদ আসতে পারে। তাঁদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। করোনাকালে শিশুরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা ছিল বাহন। অ্যাডেনোভাইরাসের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো আলামত দেখা যাচ্ছে। এখন বড়দের মাধ্যমে ঘরে থাকা শিশুরা আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হচ্ছে। তাই চিকিৎসকেরা সাবধান করে দিয়েছেন বড়দের। বলছেন, তাঁরা (বড়রা) সতর্ক হলে শিশুদের সর্বনাশের আশঙ্কা অনেক কমে যাবে। বড়দের জন্য তাঁদের পরামর্শ, বাইরে থেকে এসে জামাকাপড় বদল করে সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে তবেই শিশুদের সংস্পর্শে আসতে হবে। ভিড় এড়িয়ে চলা ভালো। বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। কাশি-হাঁচির সময় রুমাল বা কনুই দিয়ে মুখ ঢাকুন। কফ বা থুতু যেখানে-সেখানে না ফেলাই ভালো। বড়দের কারও জ্বর-সর্দি-কাশি, গলাব্যথা, চোখ লাল হলে অবশ্যই শিশুদের থেকে দূরে থাকতে হবে। কারণ, বড়দের থেকেই এ সংক্রমণ শিশুদের মধ্যে ছড়ায়।

উপসর্গগুলো কী
খালি চোখে উপসর্গগুলো সর্দি-কাশির উপসর্গের থেকে আলাদা করা সহজ নয়। মনে হবে, শিশুটি সাধারণ মৌসুমি সর্দি-কাশির ফাঁদে পড়েছে। অ্যাডেনোভাইরাসে আক্রান্ত হলে সর্দি-কাশি-জ্বরের সঙ্গে চোখ লাল হয়ে যাওয়া, ডায়রিয়া, বমি, পেটব্যথা ও ফুসফুসে সংক্রমণে শ্বাসকষ্টের সমস্যা হতে পারে। সাধারণভাবে ছয় মাস থেকে চার বছরের শিশুর সর্দি-কাশি-জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্টের আলামত থাকলে মনে করতে হবে, এটা সাধারণ মৌসুমি সর্দি-কাশি নয়। শিশুচিকিৎসকেরাও জানাচ্ছেন, অ্যাডেনোভাইরাসে শিশুদের ফুসফুস ও শ্বাসনালি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাধারণ সর্দি-কাশি-শ্বাসকষ্ট বদলে যেতে দুই দিনও সময় লাগছে না।

চিকিৎসা
অ্যাডেনোভাইরাসের সংক্রমণের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা প্রটোকল নেই। বেশির ভাগ সংক্রমণ হালকা এবং শুধু উপসর্গের চিকিৎসা দিয়েই রোগীকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। ব্যথা কমানো বা জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখার ওষুধ দিয়েই লক্ষণগুলো উপশমের চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা এবং যথেষ্ট বিশ্রাম নেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অভিজ্ঞতা থেকে চিকিৎসকেরা জেনেছেন প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকগুলো অ্যাডেনোভাইরাসে কাজ করে না। তা ছাড়া যাদের শরীরে প্রতিরোধ বা ইমিউন ব্যবস্থা স্বাভাবিক, তাদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধগুলো উপযোগী নয়।

তবে যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল, তাদের উচিত দেরি না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। জানি বা না জানি, আমরা সাধারণত বাড়ির কাছের ওষুধের দোকান বা বাড়িতে থাকা পুরোনো ওষুধের পোঁটলা থেকে ওষুধ বের করে নিজের আর শিশুদের চিকিৎসা দিয়ে থাকি। এটা ঠিক নয়, তবে এক দিনে এসব চর্চা যাবে না, খাসলত বদলাবে না। এসব মনে রেখে তাঁদের জন্য এক বন্ধু শিশুচিকিৎসকের পরামর্শ, বুকে যদি কফ থাকে, তবে অ্যান্টিহিস্টামিন আছে—এমন কাফ সিরাপ খাওয়ানো উচিত নয়।

প্রতিরোধে বেশি মনযোগ দরকার
পশ্চিম বাংলার সঙ্গে দেশের অভিবাসন চেকপোস্টগুলোয় বাড়তি সতর্কতার কথা ভাবতে হবে। যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে শিশু থাকলে সতর্ক করে দিতে হবে। দেশের ভেতরে করোনাকালীন প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। যেমন (ক) বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। শিশুদেরও অভ্যাস করানো। (খ) বাইরে থেকে এসে জামাকাপড় বদল করে এবং হাত ধুয়ে তবেই শিশুদের কাছে যাওয়া। (গ) ভিড় থেকে শিশুকে দূরে রাখা। তবু যেতে হলে মাস্ক সতর্কতা অনুসরণ করা। (ঘ) কাশি বা হাঁচির সময় রুমাল বা কনুই দিয়ে মুখ ঢাকা। কফ বা থুতু যেখানে-সেখানে না ফেলা। (ঙ) যেসব শিশুর কোনো গুরুতর জন্মগত অসুখ বা অপুষ্টির সমস্যা আছে, তাদের বিশেষ করে সাবধানে রাখা।

অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, পশ্চিম বাংলা কোনো ছোঁয়াচে রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বাংলাদেশে তার ছোঁয়া লাগে। তাই প্রতিরোধের পাশাপাশি দেশের হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখার দিকেও আমাদের মনোযোগী হতে হবে। শিশুদের জন্য কি আমাদের যথেষ্টসংখ্যক আইসিইউ আছে? কোথায়, কোন হাসপাতালে কতগুলো কার্যকর আছে, সেটা কি সবাই জানে? সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর হাসপাতালগুলোকে কি সতর্ক করা হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর যত তাড়াতাড়ি মিলবে, শিশুরা ততই নিরাপদ থাকবে।

Leave a Reply