অ্যাম্বুলেন্স আর লাশবাহী গাড়ি নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৩)
অ্যাম্বুলেন্সের ফিটনেস, চালকদের বৈধ লাইসেন্স, বিশ্রাম আর চালকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করাটা খুবই জরুরি। স্মার্ট বাংলাদেশে বৈধ অ্যাম্বুলেন্সচালকদের একটা ডেটাবেজ বা তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতে না পারলে আর সবাইকে মঞ্চে উঠতে দিলে লাশ বা রোগী কাউকে রক্ষা করা যাবে না।
লেখক ডা. দীপু মাহমুদ সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এক সহকর্মীর প্রশ্ন ছিল, অ্যাম্বুলেন্সের সামনে পড়েছিল কি? ভেবেছিলাম দাঁড়িয়ে থাকা শহরে কেবল অ্যাম্বুলেন্সই সচল, সে ধারণার বশে ওই সহকর্মীর এ অনুমান। কিন্তু তিনি বললেন অন্য কথা, ‘এরা কাউরে কেয়ার করে না, মানুষের আহা–উঁহু সমবেদনাকে পুঁজি করে ছুটে চলে যেদিক খুশি।’
শিশুসাহিত্যে অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি পুরস্কার পাওয়া দীপু মাহমুদ ঢাকার শ্যামলী থেকে রিকশায় মনসুরাবাদ যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কোথা থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স ছুটে এসে রিকশার পেছনে সজোরে ধাক্কা দেয়। লেখক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘ধাক্কায় আমি ফুটন্ত পপকর্নের মতো উড়ে গিয়ে পড়লাম রাস্তায়।’ আর অ্যাম্বুলেন্সচালকের বক্তব্য, ‘আল্লার কাছে শোকর করেন। আপনি তাল সামলাতে না পেরে রিকশা থেকে উল্টে মাটিতে পড়লে আমি কী করব?
ব্রেক না করলে এতক্ষণ আপনি লাশ হয়ে বছিলায় থাকতেন।’ দীপু মাহমুদ ভেবেছিলেন পথচারীরা এগিয়ে আসবেন। রাস্তায় ততক্ষণে গাড়ি-রিকশার জট লেগে গেছে। দীপু মাহমুদের বর্ণনা শুনে মনে হলো চালক শেরেবাংলা এলাকার অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির পান্ডাদের কেউ হবেন।
তাঁদের কেউ কেউ শেরেবাংলা নগরের বিভিন্ন হাসপাতালে ওয়ার্ড বয় হিসেবে জীবন শুরু করে এখন কালোটাকা সাদা করার মেশিনে পরিণত হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। অ্যাম্বুলেন্স এখন যেন ‘দুবাইয়ের সোনার ব্যবসা’। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স ‘নষ্ট’ থাকার চিরায়ত সমস্যা তৈরি করে তাঁরা এখন অ্যাম্বুলেন্স নবাবে পরিণত হয়েছেন। এটা শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই ঘটছে। সম্প্রতি সন্দ্বীপে গিয়েও দেখলাম একই ব্যবস্থার অন্য সংস্করণ। সেখানেও হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের অসুখ, সুস্থ কেবল হাসপাতাল কর্মীদের ব্যক্তিগত অ্যাম্বুলেন্স।
অ্যাম্বুলেন্স চলে সস্তা চালকে
কাগজের পাতা ওলটালেই নজরে পড়বে অ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনার খবর। সম্প্রতি অ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনার সবচেয়ে মর্মান্তিক শিরোনাম ছিল—মাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরা হলো না লিমার (জানুয়ারি ১৭, ২০২৩)। এ ঘটনায় রোগী নিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে শরীয়তপুরে চালকসহ ছয়জন নিহত হন। পুলিশ জানায়, অ্যাম্বুলেন্সের চালক রবিউল আগের দিন দিবাগত রাত দুইটার দিকে ঢাকা থেকে রোগী নিয়ে ভোলা যান। কিন্তু কোনো বিরতি না দিয়েই পরের দিন রাতে বরিশাল থেকে ঢাকার দিকে রওনা দেন এবং ভোর ৪টা ২০ মিনিটে তাঁর অ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এ দুর্ঘটনায় নিহত যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কম্পিউটার প্রকৌশলী লুৎফুন্নাহার লিমা ও তাঁর মা জাহানারা বেগমকে নিয়ে অনেক আবেগঘন লেখা ছাপা হলেও চালক রবিউলের কথা তেমন ছাপা হয়নি।
খুলনার ছেলে রবিউল স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন ঢাকার খিলগাঁওয়ে। দুর্ঘটনার সময় তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। অনাগত সন্তানের মুখ আর দেখা হয় না রবিউলের। অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী এসব অসহায় চালক। তাঁদের কোনো বেতন নেই। ‘খ্যাপের’(ট্রিপ) ওপর পয়সা।
বিশ্রাম নেই, ঘুম নেই। ছুটতে হয় ক্ষুধার্ত মালিকের চাহিদায়। অ্যাম্বুলেন্সের চালকেরা বেশির ভাগই তরুণ। প্রথম কাজ পাওয়া এসব চালকের অনেকেরই হাতেখড়ি অ্যাম্বুলেন্সের স্টিয়ারিং ধরে। নতুন চালকদের কাগজপত্রের ঘাটতি থাকে, সেটাও মালিকদের সুবিধা। এ রকম চালকদের কম পয়সায় চালানো যায়। কাগজের ঘাটতি নিয়ে গাড়ি চালাতে অন্য গাড়ির চালকদের বুক ধুকপুক করলেও অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষেত্রে সেই ধুকপুকানি থাকে না। অ্যাম্বুলেন্স আর লাশবাহী গাড়ি থামিয়ে চালকের কাগজপত্র পরীক্ষা করার হুজ্জতি কেউ দেখাতে চান না। অ্যাম্বুলেন্স আর লাশবাহী গাড়ির মালিকেরা এ নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে কম পয়সার অদক্ষতাকে প্রশ্রয় দেন।
গত ডিসেম্বরে আমার এক ভাই মারা যান ঢাকার কল্যাণপুরের একটি হাসপাতালে। তাঁকে গোসল করানোর জন্য মুর্দা সৎকারের দাতব্য প্রতিষ্ঠান আল মারকাজুলে নিতে হবে। মুর্দাবাহী গাড়ির চালক বললেন, তিনি জায়গাটা চেনেন না। খটকা শুরু সেখান থেকে। লাশ টানা গাড়ি আঞ্জুমান মুফিদুল, আল মারকাজুল চেনে না, তা কখনো হয়! আলাপে জানতে পারি, চালক সদ্য এসেছেন ঢাকায়। দেশের উত্তরাঞ্চলের একটা কম পরিচিত উপজেলায় তাঁর বাড়ি। লাইসেন্সের কথা বলতে তিনি যা উত্তর দিলেন, তা লেখার সাহস আমার নেই। উল্টো আমাকে সেই তরুণ চালক আশ্বাস দেন লাশ থাকলে কেউ (স্বভাবত পুলিশ বুঝিয়েছিলেন) ‘ঠ্যাকায়’ না।
লাশের গাড়ি ঠ্যাকায় না, অন্য কামের জন্য নিরাপদ
তল্লাশিচৌকিতে অ্যাম্বুলেন্সের ছাড় থাকার সুযোগ নেয় মাদক ব্যবসায়ীরা। গত কয়েক বছরে এ রকমের অনেক অ্যাম্বুলেন্স আর লাশবাহী গাড়ি ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। কুমিল্লা, যশোর, কক্সবাজারের সীমান্ত হয়ে রাজধানীর দিকে আসতে থাকা এসব গাড়িতে ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ নানা কিসিমের মাদকের চালান ছিল।
ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে লাশ নিয়ে মফস্সল শহরগুলোতে গেলে ফিরতি গাড়িগুলো টার্গেট করে পাচারকারীরা। বছর দুয়েক আগের এক ঘটনা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এক রোহিঙ্গা শরণার্থীর লাশ তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা হয়েছিল।
এই যে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, তারপর সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়, সেসব তদন্তের ফল কোথায় যায়, তা কেউই জানেন না
অ্যাম্বুলেন্স লাশটি কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় ‘খ্যাপের’ প্রলোভনে পড়ে যায়। উখিয়া টিভি স্টেশনের পাশের এক বাড়ি থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে সেই অ্যাম্বুলেন্সে চট্টগ্রামের দিকে রওনা দেয় পাচারকারীরা। পরে ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মানস বড়ুয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন।
অ্যাম্বুলেন্সের ফিটনেস, চালকদের বৈধ লাইসেন্স, বিশ্রাম আর চালকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করাটা খুবই জরুরি। স্মার্ট বাংলাদেশে বৈধ অ্যাম্বুলেন্সচালকদের একটা ডেটাবেজ বা তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতে না পারলে আর সবাইকে মঞ্চে উঠতে দিলে লাশ বা রোগী কাউকে রক্ষা করা যাবে না।