ইলিশ ধরছে ভারতীয় জেলেরা, নিষেধাজ্ঞায় লাভ কী

ইলিশ’ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ:  ২৩ অক্টোবর ২০২৩)

ইলিশ ধরার ওপর দ্বিতীয় দফার নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে ১২ অক্টোবর থেকে। ২২ দিন পর আবার ইলিশ-জেলেরা নৌকা ভাসাবেন। তবে সবার নৌকা ভাসবে না। নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিন থেকেই ঘাটে ঘাটে জেল-জরিমানা, নৌকা আটক, জাল পোড়ানোর যে যজ্ঞ শুরু হয়েছে, তাতে গরিব জেলেদের পেশায় ফেরা কঠিন হয়ে যাবে। প্রথম দিন ঢাকার দোহার উপজেলায় তিন জেলেকে ২২ দিন করে কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞার শেষ দিন পর্যন্ত তাঁরা বন্দী থাকবেন।

আমতলীর (বরগুনা) পায়রা নদীতে ইলিশ শিকারের অভিযোগে এক জেলেকে ২২ দিনের এবং ভোলার মেঘনায় এক জেলেকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া ১১ হাজার মিটার জাল ও একটি নৌকা জব্দ করা হয়েছে। পরদিন ১৪ অক্টোবর বরিশালের মুলাদিতে আড়িয়ালখাঁ ও জয়ন্তী নদী থেকে সাত জেলেকে গ্রেপ্তার করে নৌ পুলিশ। একই দিন নাজিরপুর নৌ পুলিশ ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে পৃথক অভিযানে সাত জেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে তিনজনকে জেল এবং চারজনের নামে নিয়মিত মামলা করা হয়েছে। তাঁদের কাছে থাকা মাছ জব্দ করার পাশাপাশি তাঁদের ২ হাজার মিটার জাল ধ্বংস করা হয়েছে।

এই লেখা ছাপা হতে হতে জেলখানাগুলো হয়তো আরও ইলিশ-জেলেতে ভরে উঠবে। অভিযান সফলের প্রশংসা কুড়াবেন কর্তারা। দণ্ড শেষে অভিযুক্ত জেলেরা ফিরবেন অভুক্ত ছেলেমেয়ে আর ঋণগ্রস্ত পরিবারের কাছে। যাঁরা জাল পোড়ানোর নির্দেশ দেন, তাঁরা কি জানেন, ইলিশ ধরা একটা জালের দাম কত? কত দাম একটা নৌকার, যেটা বাজেয়াপ্ত করে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকবে নৌ পুলিশের ঘাটলায়।

সবচেয়ে উদ্বেগে আছেন জলে-ভাসা মান্তারা
যে নৌকা দিয়ে মাছ ধরেন, সে নৌকাতেই বসবাস মান্তাদের। বেশির ভাগ জলে-ভাসা মান্তা থাকেন ভোলার তজুমদ্দিন, চরফ্যাশন, দৌলতখানসহ সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। অনেকে থাকেন পটুয়াখালীর গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, চরমোন্তাজ, বরিশালের মুলাদি, মেহেন্দিগঞ্জ, বানারীপাড়াসহ সদর উপজেলায়। তা ছাড়া লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীরহাট, রায়পুরের নাইয়াপাড়া, কমলনগরের মতিরহাট, রামগতি, চর আলেকজান্ডারের বিভিন্ন এলাকায় সব মিলিয়ে কমপক্ষে তিন লাখ (এটা আঁচ-অনুমান আর চোখের হিসাব; জনশুমারির বাইরে থাকা এই মানুষগুলো হিসাবের বাইরের মানুষ; তারা খাতায় নেই, কিন্তু গোয়ালে আছে) মান্তার বসবাস। মৃত্যু হলেই কেবল ডাঙায় ঠাঁই হয় মান্তাদের।

ঠিকানাহীন পানিতে বাস করা এসব মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। তাই তাঁরা রাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষার কোনো প্রকল্পের আওতায় গণ্য হন না। সাহায্য পৌঁছানোর কোনো তরিকা না থাকায় তাঁরা খাদ্যসহায়তার হকদার নয়। আইনের মানুষেরা ভালো করেই জানেন, মান্তাদের ছোট ছোট নৌকা দিয়ে ইলিশ মাছ ধরার মতো দরিয়ায় যাওয়া সম্ভব নয়। ইলিশ ধরার জালও তাঁদের নেই। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা তাঁদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। উপোস ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই তাঁদের জন্য।

শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কি ইলিশ রক্ষা সম্ভব
চাঁদপুরের ডিসি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘জেলেরা যদি সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে চলেন, তাহলে আমাদের কঠোর হতে হবে না এবং আইন প্রয়োগ করা লাগবে না। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, এ বছর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, মৎস্য বিভাগ, কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশসহ সবাই সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা নেব। কারণ, গত বছর জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানে বহু জেলে আটক হয়েছেন এবং তাঁদের জেল-জরিমানা হয়েছে। আপনারা যদি আইন না মানেন, তাহলে আমরা সর্বোচ্চ সাজা দিতে বাধ্য হব।’ এ রকম হম্বিতম্বি উপকূল আর নদীবেষ্টিত সব জেলা থেকেই শোনা যাচ্ছে।

সমন্বিত আঞ্চলিক নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন
আমাদের দেশের একতরফা নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বরগুনার পাথরঘাটার জেলেরা। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে আমরা মাছ না ধরলে মাছ ধরা বন্ধ থাকে না, নিষেধের সময় পাশের দেশের জেলেরা এসে আমাদের সীমানা থেকে মাছ শিকার করে নিয়ে যান। কীভাবে তাঁরা জানলেন এমনটা হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তাঁদের চটপট উত্তর, ‘গত বছর (৩ সেপ্টেম্বর ’২২) অবৈধভাবে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ শিকারের সময় বিপুল পরিমাণ ইলিশসহ ১৩ ভারতীয় জেলেকে আটক করে কোস্টগার্ড। তার আগে ৮ আগস্ট একই কারণে আরও ১৩ জন, ২৯ জানুয়ারি ২৮ জন ও ২৩ ডিসেম্বর ১৬ জন, ২ ডিসেম্বর ১৭ জন ভারতীয় জেলে নৌবাহিনীর হাতে আটক হন। প্রতিবছরই এ রকম ঘটনা ঘটে।

বরগুনা জেলে শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি স্থানীয় সংবাদকর্মীদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশের জলসীমা শেষে ভারতের কাকদ্বীপ এলাকা। সেখানকার শত শত জেলে এ দেশের জলসীমায় মাছ ধরতে আসেন। মাছ ধরার অত্যাধুনিক সরঞ্জাম থাকায় তাঁরা অনেক বেশি মাছ ওঠাতে পারেন। বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘দেশের ভালোর জন্য আমরা কষ্ট করতে রাজি। কিন্তু ইন্ডিয়ার ট্রলারগুলো বিনা বাধায় নিষিদ্ধ সময়ে ডিমভরা মাছ শিকার করলে তাতে ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হচ্ছে না।’ পেছন থেকে এক নারীর কণ্ঠে শোনা গেল, ‘চাউল চাই না, ওগো ঠ্যাকান।’

বাংলাদেশে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকে দুই দফায় মোট ৮৭ দিন। অন্যদিকে, প্রতিবেশী দেশ তাদের জলসীমায় প্রতিবছর একবার মোট ৬১ দিন (১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন) বন্ধ রাখে। ফলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের জেলেরা যখন বাড়িতে বসে থাকেন, ঠিক সেই সময় অন্য দেশের জেলেরা ইলিশ ধরায় ব্যস্ত থাকেন। ভারত, মিয়ানমারের সঙ্গে থাইল্যান্ডও আছে এই দলে। নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য যদি হয় মা ইলিশের নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়ার সুবিধা করে দেওয়া আর জাটকা বা শিশু ইলিশের বৃদ্ধির পথ সুগম করা, তাহলে ইলিশ উৎপাদক দেশগুলোকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে এককাট্টা হতে হবে। একই দিনক্ষণে ইলিশ ধরা বন্ধ রাখতে হবে।

দূষণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ইলিশ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়
জেলেদের জাল পোড়ানো, নৌকা জব্দ আর জেলে আটকানোর চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে নদীগুলোকে ইলিশের বাসযোগ্য করে তোলা। চলতি বছরের মার্চের শেষে এবং এপ্রিলের শুরুতে মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল মৎস্য বিপর্যয়ের কথা পাঠকের মনে আছে নিশ্চয়। এই সময় ষাটনল এলাকায় মেঘনার দূষণের মাত্রা বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর মাত্রাকে ছাড়িয়ে যায়।

ফলে ষাটনল ইউনিয়নে মেঘনার পানিদূষণে বাবুবাজার, ইস্পাহানির চর, গজারিয়া, ষাটনল, সটাকি, মহনপুর, এখলাসপুরসহ প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে নদী পরিণত হয় মরা আর পচা মাছের ভাগাড়ে। স্থানীয় জেলেরা জানান, বেশ কয়েক বছর ধরেই শীতের মৌসুমে নিয়মিতভাবে মেঘনার পানি দূষণ চরমে পৌঁছে যাচ্ছে। বর্ষার মৌসুমে নদীর পানি বাড়ার আগপর্যন্ত নদীর দূষণ দশা প্রায় স্থায়ী হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে ইলিশসহ কোনো মাছই থাকবে না নদীতে।

যেখানে নদীকে বর্জ্য ফেলার জায়গা হিসেবে গণ্য করা হয়, সেখানে নদীকে ইলিশের বাসযোগ্য করে তোলা সহজ কাজ নয়। নদীগুলো যখন বর্জ্যের ভাগাড় বা ডাম্পিং গ্রাউন্ড, তখন জেলেদের পিটিয়ে জেলে ভরে ইলিশের বিকাশ দূরে থাক, রক্ষাও সম্ভব নয়। তারপরও প্রজননকালে ইলিশ ধরা বন্ধ রেখে শুধু যে ইলিশ বেড়েছে, তা-ই নয়, নদীর পাঙাশ আর আইড় মাছের উৎপাদনও বেড়েছে।

তবে এই সুফল ধরে রাখতে হলে আমাদের এ অঞ্চলের থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভারতকে নিয়ে আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। দূষণ বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। গরিব জেলেদের জাল পুড়িয়ে জেলে পুরে আমরা বেশি দূর যেতে পারব না।

Leave a Reply