ইলিশ-বারণ ইলিশ-বরণ

ইলিশ’ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ:  ০৭ নভেম্বর ২০২৩)

ইলিশ-বারণ পর্ব শেষে ইলিশ-বরণ পর্ব শুরু হয়েছে। জাল-নৌকা নিয়ে আবার সাগরে, গহিন গাঙে ছুটছে মহাজনের কেনা ‘জলদাস’ আর বাধ্য শ্রমিক জেলের দল। বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) মধ্যরাত থেকেই কোনো কোনো জেলে নৌকা ও মাঝিমাল্লা নিয়ে রাতেই মাছ শিকারে নেমে পড়েন। কেউ আবার ভোররাত থেকে শুরু করেন মাছ শিকার।

লক্ষ্মীপুর অঞ্চলের চর রমণীমোহনের মোনাজাত ফকিরের (ছদ্মনাম) যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি এখন জেলে। নদীর ঘাট থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যান ভ্রাম্যমাণ আদালত। অপরাধ, ‘পুলিশের কাজে বাধা’, আইন অমান্য ইত্যাদি। তাঁর কাছে মাছ না পেলেও জাল পাওয়া গিয়েছিল। মোনাজাত ফকিরের বয়স ২০-২২; এটাই সাগরে আর উত্তাল মোহনায় যাওয়ার বয়স। যৌবনেই নাকি মানুষ যুদ্ধে যায়। ইলিশ ধরা যুদ্ধের চেয়ে কম কিছু নয়।

মোনাজাতের বাবা আসর উদ্দিন ফকিরের বয়স ৫৮ পার হয়েছে। তাঁর সঙ্গে কথা হয় ইলিশ–বরণ পর্ব শুরুর রাতে। মোনাজাতের বদলি হিসেবে তিনিই যাচ্ছেন এবার ট্রলারে। যৌবন না থাকলেও তাঁর উপায় নেই। যৌবনকালে দুবার ‘নৌকা ডুবা খাইছেন, দরিয়া–তুফানকে ডরাইতেন না।’ এখন গতরে জোর নেই, মনের জোরেই চলছেন। ছেলে কবে ছাড়া পাবেন, জানা নেই। ‘ট্রিপ’ ফেল করলে মহাজন ছাড়বেন না।

কত জেলে এখনো জেলখানায়
সঠিক হিসাব কার কাছে আছে, কেউ জানেন না। ট্রলারমালিক বা মহাজনদের হিসাবের সঙ্গে শ্রমিকদের হিসাব মেলে না। কারাগারের হিসাব আবার ভিন্ন। শুধু চাঁদপুরেই গত ২২ দিনে ৩৭৪ জেলের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। চাঁদপুর জেলা মৎস্য বিভাগের এক সংবাদ বিবৃতিতেও একই হিসাব পাওয়া যায়। চাঁদপুরের নৌসীমার (মেঘনা উপকূলীয় সদর, মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ ও হাইমচর) মধ্যে আটক সবাই যে চাঁদপুর জেলার বাসিন্দা নন। অনেকের পরিবার হয়তো খবরও জানে না। জামিনে মুক্তি, এসব শব্দ তাদের জানা নেই।

লক্ষ্মীপুর মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সেখানে ৬৮টি মামলায় ২ লাখ ৩ হাজার টাকা অর্থদণ্ড ও ৩৪ জন জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ২৮ দশমিক ৮৪ লাখ মিটার জাল ও ১৪টি নৌকা জব্দ করা হয়েছে।

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর থেকে গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর পর্যন্ত পদ্মা-মেঘনা প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা ইলিশের অভয়ারণ্য। ইলিশের অভয়ারণ্যে প্রজনন মৌসুমে (অক্টোবর থেকে নভেম্বরের ২ তারিখ পর্যন্ত) নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে নৌ পুলিশ জেলা, উপজেলা টাস্কফোর্সের অভিযানে আটক হয়েছেন শতাধিক শ্রমিক জেলে।

কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরেও হামলা হয়েছে। চাঁদপুর অঞ্চলের নৌ পুলিশ সুপার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অভিযানে গিয়ে এ পর্যন্ত তাঁদের বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে সেসব মামলা মামুলি মাছ চুরির থেকে শক্ত আর সাজাও কঠোর হবে।

জেলে আছেন ভোলা–বরগুনার জেলেরাও।

আটক আর সাজাপ্রাপ্ত জেলেদের মামলাগুলো দ্রুত পর্যালোচনা করে তাঁদের আশু মুক্তির ব্যবস্থা করা দরকার।

মাছ ধরার দক্ষ জনশক্তি কারাগারে আটক থাকলে ইলিশ মৌসুমে প্রতিবেশীদের থেকে আবার আমরা পিছিয়ে যাব। নিষেধাজ্ঞার সময় তাঁরা দেদারসে ইলিশ ধরেছেন। অভিযোগ আছে, তাঁরা মাঠ ফাঁকা পেয়ে আমাদের জলসীমায় ঢুকেও মাছ ধরেছেন। শুধু সাগরপথের জলসীমায় নয়, অভ্যন্তরীণ নদীপথেও তাঁরা হানা দিয়েছেন, দিচ্ছেন।

রাজশাহী অঞ্চলের পদ্মার চারঘাট-বাঘা দুই উপজেলায় বাংলাদেশ-ভারতের জলসীমা প্রায় ৪৮ কিলোমিটার। এবারও বারণকালে চারঘাট-বাঘা সীমান্তে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে শত শত ভারতীয় জেলে ধরে নিয়ে গেছেন মা ইলিশ। আমাদের জেলেদের এই অভিযোগ স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তারা স্বীকার করে জানিয়েছিলেন, বিজিবির মাধ্যমে বিএসএফের কাছে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

নদীসীমান্তের পাহারায় থাকা আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ২০১৯ সালের অভিজ্ঞতার পর বোধ হয় ‘দেখো আর অপেক্ষা করো’ নীতির প্রতি বেশি আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সেবার ১৭ অক্টোবর (২০১৯) নিষেধাজ্ঞার সময়ে পদ্মা নদীর সীমানায় ঢুকে মাছ শিকারের অভিযোগে প্রণব মণ্ডল নামের ভারতীয় এক জেলেকে আটক করে বিজিবি। পরে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে গোলাগুলিও হয়। এতে এক বিএসএফ সদস্য মারা যান। এই ঘটনার পর থেকে বিজিবি রক্তপাত এড়ানোর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের জেলেদের হক।

বারণকালে অনেক জেলে ঋণগ্রস্ত হয়েছেন
ভ্রাম্যমাণ আদালতের হাত থেকে জাল-নৌকা বাঁচাতে অনেকেই উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে জরিমানার টাকা তাৎক্ষণিকভাবে শোধ করেছেন। অনেকে ঋণ করেছেন নিষেধাজ্ঞার দিনগুলোতে ‘খায় খোরাকি’র খরচ মেটানোর জন্য। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর এলাকার চরবংশী ইউনিয়নের জেলে কাশেম মাঝি নিষিদ্ধ ২২ দিনে ঋণ করেছেন ১৫ হাজার টাকার মতো। জেলে জাহাঙ্গীর মিয়ার জেলে কার্ড আছে। তিনি ২৫ কেজি চাল পেয়েছিলেন।

তিনি জানালেন, ‘সরকারের দেওয়া চালে আমাদের সংসার চলে না। ঋণ করতে হয়। সরকার চাল না দিয়ে সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে না? আমরা কারও টাকা মারি না।’ জাহাঙ্গীর মিয়ার এই প্রস্তাব বা প্রশ্নের জবাব কি কেউ দিতে পারবে? জরিমানার টাকা ফেরত দিলেও অনেকের জান বাঁচে।

আশার আলো দেখছেন জেলেরা
এবার অনেক মোকামে মাছের আড়তে নিষেধাজ্ঞার পরপরই মাছের আমদানি ভালো ছিল। বরিশাল আর লক্ষ্মীপুরের জেলেরা ভালো মাছ পেয়েছেন। ইলিশের পাশাপাশি প্রচুর পাঙাশ আর আইড় মাছ বরিশালের পোর্ট রোড মোকামে সাড়া ফেলে দিয়েছিল প্রথম দুই দিন। প্রথম দিন পোর্ট রোডে ৯০০ থেকে হাজার মণ ইলিশ বিক্রি হয়। এর মধ্যে ১ কেজি ২০০ গ্রাম আকারের ইলিশ প্রতি মণ ৬২ হাজার দরে বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে প্রতি মণ পাঙাশ মাছ ২১ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার আলতাফ মাস্টারঘাট, সাজু মোল্লাঘাট, হাজীমারা বাজার, নতুন বাজার ও পুরান বেড়ির মাছবাজারে ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের ইলিশের পসরা চলছে। তবে এই বাজারগুলোতে ডিমওয়ালা ইলিশের জোগান বেশি। তবে বাজারে ডিমওয়ালা ইলিশ এলেও, ভবিষ্যতে ইলিশের উৎপাদনে প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন মৎস্য কর্মকর্তারা।

চাঁদপুর অঞ্চলের জালে এখনো আশা অনুযায়ী মাছ ধরা পড়েনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অঞ্চলের নদীদূষণের মাত্রা না কমালে ইলিশ তার পথ পরিবর্তন করবে। সরে যাবে যেখানে, সে স্বস্তি পাবে।

ইলিশ নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা মনে করেন, ইলিশের জন্য যে তাপমাত্রা দরকার, সেটা না পাওয়ায় দিন দিন ইলিশ গভীর সমুদ্রে চলে যাচ্ছে। আবার ইলিশের ধর্ম হচ্ছে সোজা পথে চলা। ডুবোচরে বাধা পেলে বিকল্প পথ না খুঁজে ফিরে যায় সাগরে। সাগরের মোহনায় পলি পড়ার কারণে যে ডুবোচর তৈরি হচ্ছে, তা অপসারণ না করলে ইলিশ আসবে না।

ইলিশ সামুদ্রিক মাছ হলেও ডিম ছাড়ার সময় নদীতে আসে, তখন তার দরকার হয় কম লবণাক্ততার পরিবেশ। লবণের পরিমাণ বাড়লে বা পানি বেশি গরম হয়ে গেলে ইলিশ অন্য পথ খুঁজবে। তাই বলা যায়, বিভিন্ন কারণে নদীতে এখন আর ইলিশ স্বাচ্ছন্দ্য পাচ্ছে না।

দূষিত নদীতে পানির তাপমাত্রা, স্বাদ, গভীরতা, উষ্ণতা—কোনোটাই রক্ষিত হয় না। তাই নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে নদী আর মোহনাগুলোকে মাছের বাসযোগ্য রাখতে হবে।

Leave a Reply