ঈশ্বরদীর মন্টু, মার্কিন লেখক জো গ্রিফত ও ডিসলেক্সিয়া

ডিসলেক্সিয়া’ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩)

মন্টুদের বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীতে। ভালো দাবা খেলে, মাত্র ১২ বছর বয়সে সে যেভাবে ফুটবল খেলে, তা দেখে চমকে যেতে হয়। বড়দের টিমে তার ডাক আসে। বাঁ-ডান দুই পা তার সমানে চলে। সেই সঙ্গে চলে বুদ্ধি। ফুটবল যে এখন বুদ্ধিরও খেলা, মন্টু সেটা খুব ভালো বোঝে। তারপরও মন্টুর মার বুকফাটা আর্তনাদ ‘আমার ছাওয়ালডা একটা গাধা’। পঞ্চম শ্রেণি থেকেই সে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। স্কুলের শিক্ষক থেকে নিচু ক্লাসের ছাত্ররা পর্যন্ত তাকে নানা নামে ডাকে। ‘হ্যাদা মন্টু’ থেকে শুরু করে বুদ্ধিহীনতার সঙ্গে যুক্ত সব শব্দই তার জন্য বরাদ্দ ছিল।

যাঁরা বিশিষ্ট মার্কিন লেখক জো গ্রিফতের লেখা হাউ ডিসলেক্সিক বেনি বিকেম আ স্টার: আ স্টোরি অব হোপ ফর ডিসলেক্সিক চিলড্রেন অ্যান্ড দেয়ার প্যারেন্টস বইটা পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন মন্টুকে কেন স্কুল ছাড়তে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত এই বই আসলে সফল রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ী, লেখক, উপস্থাপক, প্রেরণামূলক বক্তা জো গ্রিফতের নিজেরই জীবনকাহিনি। তাঁর গল্পের বেনি-কে স্কুলে যেমন সবাই বোকারাম বলে ডাকত, জো-কেও একই নামে ডাকত সবাই। মন্টুকেও ডাকে একই কায়দায়।

জো-এর বুদ্ধিমত্তার কোনো অভাব ছিল না, যেমন নেই আমাদের মন্টুরও। এরা লেখার সময় শব্দ ও বর্ণের ক্রম উল্টে ফেলে, হাতের লেখা খারাপ হতে পারে, সবার মতো করে শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না, উচ্চ স্বরে পড়ার সময় উচ্চারণে সমস্যায় পড়ে, পঠিত বিষয়বস্তুর অর্থ না বোঝা ইত্যাদি। ইংরেজিতে শিশুর এই পরিস্থিতিকে ডিসলেক্সিয়া বলে, বাংলায় এই অবস্থাকে অনেকে ‘পঠন বিকার’ বলে থাকেন।

শিশুর এই আলামত মূলত প্রাথমিক শৈশবকালীন বছরগুলোতে, বিশেষ করে বিদ্যালয়ে যাওয়ার পর প্রকাশ পেতে থাকে বা জানাজানি হয়। ক্রমেই শিশুটি ক্লাসে একা হয়ে যায়। অন্যদের থেকে সে পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। স্কুলে দেওয়ার আগে মা-বাবারা বা অভিভাবকেরা যখন অক্ষর চেনানো বা হাতে ধরে লেখার কাজ শুরু করেন, তখনই কিন্তু শিশুর ডিসলেক্সিয়াজনিত সীমাবদ্ধতাগুলো শনাক্ত করা সম্ভব। যেমন এ ধরনের পরিস্থিতির শিশু একই রকম দেখতে অক্ষরের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। M W b d তার কাছে একই অক্ষর মনে হয়। অনেক সময় সে B লেখে উল্টো করে। এ রকম দেখলে তাকে অমনোযোগী ভেবে শাস্তির পর শাস্তি দিয়ে তার মনোবল নষ্ট করে দেওয়া ঠিক হবে না।

মনে রাখতে হবে, ডিসলেক্সিয়া একধরনের মানসিক অবস্থা মাত্র, এটা শিশুদের তথ্য বোঝার, উপলব্ধি ও ব্যবহার করার ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে রাখে। এই সমস্যা শিশুর পড়াশোনার ওপরই প্রভাব ফেলার পাশাপাশি তার রোজকার কাজকর্ম যেমন জুতার ফিতা বাঁধা, শার্টের বোতাম তাড়াতাড়ি আটকানো ইত্যাদিকেও সমানভাবে প্রভাবিত করে।

ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত কোনো শিশুর পড়া ও লেখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায় সঠিক শিক্ষাদানের কৌশল এবং নির্দেশ অনুসরণ করার মাধ্যমে। এই ধরনের শিশুদের সেই সব কাজ করায় উৎসাহ প্রদান করা উচিত, যা করতে তারা পারদর্শী। এ ছাড়া অনেকে বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলে থাকেন। তার মানে এই নয় যে এদের জন্য আলাদা স্কুল করতে হবে। শিক্ষক ও মা-বাবা এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে শিশুকে বিকল্প উপায়ে শিখতে সাহায্য করা উচিত।


আর কী কী প্রাথমিক লক্ষণ দেখে ডিসলেক্সিয়া চেনা যায়
সব শিশুর ক্ষেত্রে একই ধরনের আলামত দেখা যাবে, এটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। সাধারণভাবে যেসব লক্ষণ দেখা যায়, সেগুলো হচ্ছে:

স্কুলে যাওয়ার আগে
১. অক্ষর ও শব্দ চিনে মনে রাখতে না পারা, ২. অক্ষরের সঙ্গে আওয়াজের সম্পর্ক (ধ্বনি বা ফোনেটিক্স) বুঝতে না পারা, ৩. নতুন শব্দ শিখতে সময় লাগা, ৪. অক্ষর, সংখ্যা বা ছড়া মনে রাখতে সমস্যা।

স্কুলের প্রাথমিক এবং মধ্যস্তরে
১. তথ্য বা সংখ্যা মনে রাখতে না পারা, ২. বাজে হাতের লেখা, পেনসিল ধরতে সমস্যা, ৩. ছড়া বা কবিতা মনে রাখতে না পারা, ৪. এক রকম দেখতে অক্ষরে তফাত না করতে পারা, ৫. ঠিকমতো বানান না লেখা, ৬. কথা বলতে গিয়ে শব্দ মনে না করতে পারা, ৭. নির্দেশানুযায়ী কাজ করতে না পারা, ৮. পাটিগণিতে সমস্যা, ৯. নতুন ভাষা শিখতে সমস্যা।

কিশোর ও পরিণত বয়সে
১. গড়গড় করে বা জোরে জোরে কিছু পড়তে অসুবিধা, ২. রসবোধ, ধাঁধা, ছড়া বা বাগ্‌ধারা বুঝতে না পারা, ৩. কবিতা বা গল্প পড়ে মনে রাখতে না পারা, ৪. সারসংক্ষেপ করতে না পারা, ৫. অঙ্ক করতে না পারা, ৬. সময়ানুবর্তিতার অভাব

চিকিৎসা কী
ডিসলেক্সিয়ার কোনো নির্দিষ্ট বা নিশ্চিত চিকিৎসা নেই। যত তাড়াতাড়ি এর উপসর্গগুলো চিহ্নিত করা যাবে, ততটাই জরুরি ভিত্তিতে কোনো বিশেষজ্ঞ মনোবিদের পরামর্শ নিতে হবে। ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত কোনো শিশুর পড়া ও লেখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায় সঠিক শিক্ষাদানের কৌশল এবং নির্দেশ অনুসরণ করার মাধ্যমে। এই ধরনের শিশুদের সেই সব কাজ করায় উৎসাহ প্রদান করা উচিত, যা করতে তারা পারদর্শী। এ ছাড়া অনেকে বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলে থাকেন। তার মানে এই নয় যে এদের জন্য আলাদা স্কুল করতে হবে। শিক্ষক ও মা-বাবা এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে শিশুকে বিকল্প উপায়ে শিখতে সাহায্য করা উচিত। যেমন শিশুকে ক্লাসের পড়া অডিও রেকর্ড করে শোনানো। ত্রিমাত্রিক অক্ষর ছুঁয়ে ও স্পর্শ করিয়ে অক্ষর চেনানো সম্ভব অথবা ছবি দেখিয়ে নতুন শব্দ শেখানো যায়। এ ছাড়া আইইপি বা ইনডিভিজ্যুয়ালাইজড এডুকেশন প্ল্যান: একটি বিশেষ পরিকল্পনামাফিক ছোট ছোট লক্ষ্য তৈরি করে পড়তে উৎসাহ দেওয়া।

কেন হয় ডিসলেক্সিয়া
এই রোগের সঠিক কারণ নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। তবে জিনগত কারণে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেকোনো জনসমষ্টির ৩-৭% ব্যক্তি এর শিকার হয়ে থাকে। তবে কোনো জনসম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ২০% (প্রতি ৫ জনে ১ জন) কোনো না কোনো মাত্রায় ডিসলেক্সিয়া লক্ষণ-উপসর্গ দেখা যেতে পারে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী তুলনামূলকভাবে পুরুষদের মধ্যে ডিসলেক্সিয়া বা ‘পঠন বিকার’ বেশি ধরা পড়লেও বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি পুরুষ ও নারী উভয়কেই সমভাবে আক্রান্ত করে।

সম্প্রতি ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন সাইকোলজি’ জার্নালে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বলেন, ডিসলেক্সিয়াকে একটি মানসিক ব্যাধি হিসেবে দেখা উচিত নয়। গবেষকদের মতে, ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের আবিষ্কার, উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতাসহ নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে আর পাঁচজনের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতা রয়েছে।

গবেষকদের মতে, ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা অন্বেষণ এবং কৌতূহলের বিশেষজ্ঞ। তাঁদের এই অনুসন্ধানমূলক আচরণ পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে। মানুষের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই ডিসলেক্সিয়া কোনো মানসিক অসুস্থতা নয়। যেসব শিশু এতে আক্রান্ত, তাদের ‘ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপাসিটি’ তথা মানসিক ক্ষমতা হয়তো গড় বা গড়ের চেয়ে বেশিই হয়। এসব শিশু অসাধারণ বাগ্মী হয়। ঈশ্বরদীর মনটুকে দেখে আর জো গ্রিফতের লেখা পড়ে সেটাই বিশ্বাস হয়। আসুন, আমরা মন্টুদের পাশে দাঁড়াই, ব্যঙ্গ-অবহেলা না করে তাদের সীমাবদ্ধতাকে সম্মান করতে শিখি।

Leave a Reply