প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত দুর্যোগ এবং সাপে কাটা বিষয়ে লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা। প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২২
২০২০–২১ সালে দেশে ২ হাজার ৭৯৮ জন সাপে কাটা রোগীর পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা হয়। তবে হাসপাতালে যাওয়ার পরও ৩৪ জন রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
সাপে কাটা রোগী নিয়ে করণীয়
হাতে ঘড়ি বা চুড়ি, বালা থাকলে খুলতে হবে।
কামড়ের স্থানে ঠান্ডা, গরম, বরফ জল বা কেমিক্যাল দেবেন না। কেটে বিষ বের করা যাবে না।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে।
শিরোনামটা একজন চিকিৎসকের। সাপের কামড়ে গ্রামের মানুষের হরদম মৃত্যু নিয়ে কথা বলার সময় তিনি কথাটা বলেন। গত সপ্তাহে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় সিরাজগঞ্জে। একসময় কাজ করতেন মধুপুরের জলছত্র খ্রিষ্টান হাসপাতালে।
গ্রামের মানুষের সাপে কাটায় প্রাণ হারানোর কথা মাথায় রেখে জলছত্র হাসপাতাল ১৯৫৮ সাল থেকে অ্যান্টিভেনম দেওয়া শুরু করে। বৃহত্তর ময়মনসিংহে টানা ছয় দশক এটিই ছিল সাপে কাটার একমাত্র নির্ভরযোগ্য হাসপাতাল। ২০১৪ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জেলা সদর ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে জলছত্র হাসপাতালের সেই চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়।
গত বছরের ১ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঘোষণা করে, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা ‘অ্যান্টিভেনম’ এখন থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাওয়া যাবে। তবে সেই ঘোষণার একটা মারপ্যাঁচ ছিল। ঘোষণার শেষ অংশে বলা হয়েছিল ‘বেশির ভাগ’ উপজেলা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনমের পর্যাপ্ত মজুত ও সরবরাহ করা হয়েছে। তার মানে সব উপজেলায় নয়।
১১ আগস্ট রাতে ঘুমন্ত রিয়াজের বাঁ হাতে সাপে কামড় দেয়। ১০ বছরের রিয়াজ জোয়ার্দার নানাবাড়ি থেকে লেখাপড়া করত। মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার হোগলডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এই শিক্ষার্থীকে বাঁচানো যায়নি। সংবাদ সূত্রগুলো জানাচ্ছে, রিয়াজকে বাঁচানোর জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ওঝা-কবিরাজ এবং পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতাল মানে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। হোগলডাঙ্গা থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দূরত্ব সাকল্যে চার কিলোমিটারের বেশি নয়। এই পথ হেঁটে পাড়ি দিতে লাগবে বড় জোর ৫০ মিনিট।
এখানে প্রশ্ন, রিয়াজকে কি ঠিক সময়মতো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়া হয়নি? নাকি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন ছিল না? অথবা অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে কেউ সাহস করেনি? তিনটির যেকোনো একটি কারণে রিয়াজের মৃত্যু হতে পারে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবরণ থেকে জানা যাচ্ছে, আত্মীয়স্বজন প্রথমে ওঝা-কবিরাজ দিয়ে রিয়াজের ‘বিষ নামানো’র চেষ্টা করেন। রাতে ওঝা-কবিরাজকে খুঁজে তারপর বিষ নামানোর নাটক করতেই ‘সোনালি ১০০’ মিনিটের অনেকটাই পার হয়ে যায়। এরপর হাসপাতালে নিলে তাদের প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করার ফুরসত থাকে না। তা ছাড়া চিকিৎসাকর্মীরা অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের কাজটি এড়িয়ে চলতে চান বলে বাজারে কথা আছে।
বিষয়টি স্বীকার করে গত বছরের ১ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেছিলেন, ‘জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকেরা নিরাপত্তাজনিত কারণে অ্যান্টিভেনম প্রদানে অনেক সময় বিরত থাকেন। কারণ, অ্যান্টিভেনম প্রয়োগে অনেক সময় শরীরে তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়।’ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাকর্মীদের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘আমদানি করা অ্যান্টিভেনমে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। রোগী মারা গেলে চিকিৎসকেরা হামলার আতঙ্কে থাকেন।
তাই ঝুঁকি এড়াতে উপজেলা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয় না।’ সরকারের দাবিমতে, উপজেলা পর্যায়ের প্রচুর অ্যান্টিভেনম মজুত আছে, তারপরও কেন উপজেলা হাসপাতালের ‘প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত’ চিকিৎসাকর্মীরা বা চিকিৎসকেরা সাপে কাটার অ্যান্টিভেনম পুশ না করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে রোগীকে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলেন, তা কি নিতান্তই ঝামেলা–ঝক্কি এড়ানোর আর গা বাঁচিয়ে চলার জন্য! সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০–২১ সালে দেশে ২ হাজার ৭৯৮ জন সাপে কাটা রোগীর পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা হয়।
তবে সঠিক সময়ে হাসপাতালে আসার পরও ৩৪ জন রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। অ্যান্টিভেনম দেওয়ার পর তাদের মৃত্যু হয়েছে নাকি আগেই তাদের জীবনাবসান ঘটেছে, সেটা অবশ্য জানা যায়নি।
‘সোনালি ১০০’ বা ‘রুল অব ১০০’ কী?
সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০০ মিলিলিটার অ্যানটিভেনম শরীরে প্রবেশ করালে রোগী বেঁচে যাবে—এটাকেই বলা হয় ‘গোল্ডেন রুল অব ওয়ান হানড্রেড।’
আমাদের দেশের তুলনায় অস্ট্রেলিয়ায় অনেক বেশি বিষধর সাপ থাকলেও মৃত্যু হয় পাঁচ বছরে সাকল্যে দুই থেকে তিনজনের আসলে আমাদের দেশে এখনো বহু মানুষ সাপে কাটার পর ডাক্তারদের তুলনায় ওঝা, ঝাড়ফুঁকের ওপর বেশি ভরসা রাখেন। ফলে রোগীর গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট (গোল্ডেন আওয়ার) বিনা চিকিৎসায় নষ্ট হয়ে যায়। সমীক্ষা অনুযায়ী, সাপে কাটা রোগীদের মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে আসেন।
রিয়াজ যেদিন মারা যায়, ঠিক তার পরদিন সাপের কামড়ে অন্তঃসত্ত্বা সাগরী বেগম মারা যান রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। উপজেলার শলুয়া ইউনিয়নের বালুদিয়ার গ্রামের বাসিন্দা সাগরী বেগমকে সাপে কামড়ায় সকাল ৯টার দিকে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এখানে কালক্ষেপণ বা ওঝা–কবিরাজের হাত ঘুরে আসার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে কি হাসপাতালে দেরি হয়েছিল? অথবা ওষুধ ছিল না কিংবা ইনজেকশন পুশ করার তাকত কারও ছিল না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশে ৯৪ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৬টি প্রজাতি বিষধর। বাকি ৬৮ প্রজাতির সাপের বিষ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর দেশে সাপে প্রায় ৯ লাখ মানুষকে ছোবল দেয়। এর মধ্যে প্রতিদিন ১৬ থেকে ২০ জন মানুষ মারা যায়, বছর শেষে সেই হিসাব ছয় হাজারে গিয়ে ঠেকে।
বিশেষ করে বন্যার সময় দেশে সাপের উপদ্রব বাড়ে। এ ছাড়া হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলে সাপের উপদ্রব বেশি। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় প্রতিবছর সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় প্রায় ১০০ মিলিয়ন টাকার অ্যান্টিভেনম ক্রয় করে। এসব অ্যান্টিভেনমের সবটাই আসে ভারত থেকে। একটি বেসরকারি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির অ্যান্টিভেনমের সূত্রও ভারত।
ভারতের ওষুধ কি কার্যকর?
একজন অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন জানালেন, ভারত ও ইউরোপের সাপ থেকে বাংলাদেশের সাপের ধরন কিছুটা আলাদা। তাই সেখান থেকে আমদানি করা অ্যান্টিভেনম অনেক সময় কাজ করে না।
এ জন্য দেশি সাপের অ্যান্টিভেনম জরুরি। পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকেরাও মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গে অ্যান্টিভেনম উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দক্ষিণের রাজ্যগুলো থেকে আমদানি করা ওষুধে সমস্যা বাড়ছে। সেখানকার সাপের বিষে প্রোটিনের মাত্রা আর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে সাপের বিষে প্রোটিনের মাত্রা সমান নয়। তাই এসব দামি অ্যান্টিভেনমও অনেক সময় কাজ করে না।
বাংলাদেশে ২০১৮ সাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে দেশি সাপের বিষে অ্যান্টিভেনম তৈরির চেষ্টা চলছে। তাড়াতাড়িই এর সুফল মিলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নতুন চ্যালেঞ্জ চন্দ্রবোড়া
বাংলাদেশে ২০০০ সালের আগে চন্দ্রবোড়ার উৎপাত ছিল না। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রলয়ংকরী বন্যায় সাপটি ভেসে আসে ভারত থেকে। এই সাপের বিষ রক্তকণিকা ধ্বংস করে। এটি এ দেশের একমাত্র হিমোটক্সিক সাপ। এই সাপ এখন সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। সাপটি বাদামি বা কাঠ রঙের।
ফণাহীন। গায়ে চন্দন হলুদ চাকা চাকা দাগ। কামড়ালে রোগীর রক্তের গঠনে তালগোল পাকিয়ে যায়। প্রবল শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। চিকিৎসায় দেরি হলে রোগীর কিডনি নষ্ট হতে থাকে। পেশাবে রক্ত এসে যায়। শুধু অ্যান্টিভেনম দিয়ে চন্দ্রবোড়া দংশনের চিকিৎসা কঠিন। ভেন্টিলেশন আর কিডনি ডায়ালাইসিসের সুযোগ না থাকলে রোগীর বিপদ বেড়ে যেতে পারে।
করণীয় কী?
নিয়মিতভাবে ওষুধের প্রাপ্যতা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দাবি করে, সারা দেশের ৮০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল সার্জন কার্যালয়, জেলা সদর হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করা হয়েছে। একটা গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মানুষকে জানিয়ে দেওয়া উচিত, কোন হাসপাতালে কত ওষুধ মজুত আছে। হাসপাতালগুলোর সামনে একটা চিহ্ন দিয়েও জানিয়ে দেওয়া যায় ওষুধের প্রাপ্যতার কথা।
প্রশিক্ষণ
ওষুধের পাশাপাশি প্রশিক্ষিত জনশক্তির দিকেও নজর দিতে হবে। দেশের বেসরকারি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা হয় না। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থীরা এ চিকিৎসা শিখছেন না। এই শিক্ষার্থীরাই যখন চিকিৎসক হয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে যান, তখন সাপে কাটা রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা দিতে পারেন না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে দেশি সাপের বিষে অ্যান্টিভেনম তৈরির চেষ্টাকে আরও বেগবান করতে হবে।
পুনশ্চ
আলমারিতে ফ্রিজে অ্যান্টিভেনম মজুত থাকার পরও প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। এর বড় কারণ ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না করতে পারা। দক্ষ চিকিৎসাকর্মীর অভাব। তথ্য না জানা। তাই চিকিৎসা সহজ আর মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার জন্য ইনজেকশনের বদলে ট্যাবলেট দিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে ভারতে মোট ১১২ জনের ওপর মুখে খাওয়ার এই ওষুধ প্রয়োগ করে সুফল পাওয়া গেছে। কলকাতাতেও এটা ব্যবহার করা হয়েছে। ভারেসপ্লাডিব মেথাই ওয়ান (Varespladib Methyl) নামের এই ওষুধ সফল হলে অনেক জটিলতা কেটে যাবে।