কেমন বইমেলা চায় রেহনুমার মতো শিশুরা

বইমেলা নিয়ে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ:  ৩০ জানুয়ারি ২০২৪)

বাংলা একাডেমি সূত্র নিশ্চিত করেছে, এবার ছয় শতাধিক বইয়ের দোকান নিয়ে শুরু হবে একুশে বইমেলা। বইমেলা উপলক্ষে খুলনা থেকে ঢাকা যাচ্ছে রেহনুমা। একই বাসে আমাদের সহযাত্রী। যখন ছোট-বড় সবাই যার যার মোবাইল আর ট্যাবলেট নিয়ে মশগুল, মেয়েটি তখন বই হাতে। সপ্তম শ্রেণির রেহনুমার বইমেলা নিয়ে অনেক প্রশ্ন, অনেক আগ্রহ। তার কাছেই জানলাম, মেলা নাকি পূর্বাচলের দিকে সরিয়ে নেওয়ার কথা উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই হচ্ছে। এটা জেনে খুব খুশি রেহনুমা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হলে তার কী লাভ? সে তো থাকবে উত্তরায় চাচার বাসায়; ওদিক থেকে পূর্বাচল যাওয়া সহজ হতো না? তা ছাড়া ওদিকে বাণিজ্য মেলা চলছে। বাণিজ্য মেলা নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই। ও রকম মেলা নাকি খুলনাতেও হয়; বোরিং। সে জেনে গেছে, উত্তরা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা বাংলা একাডেমি আসতে এখন আর আগের মতো হ্যাপা নেই। মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে সটাং চলে যাওয়া যাবে মেলা প্রাঙ্গণে। তিন বছর ধরে রেহনুমা তার পরিবারের সঙ্গে বইমেলায় আসে। সারাবছর অপেক্ষা করে ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য। এবার বাংলা একাডেমি মেলা অনুষ্ঠানের ব্যাপারটি যে আর ঠিকাদার কোম্পানির হাতে দেয়নি, সে খবরও রাখে মেয়েটি। সে জানায়, এবার আগের মতো বাংলা একাডেমিই দেখবে সবকিছু। সে খুবই আশাবাদী, এবার খুব জমজমাট হবে বইমেলা।

কেমন মেলা চায় রেহনুমারা

শুধু ছুটির দিনে শিশু প্রহর তাদের পছন্দ নয়। এমন ঘোষণা বা ব্যবস্থা থেকে মনে হয়– ‘সব দিন বড়দের, তোমাদের জন্য

শুধু কয়েক ঘণ্টা।’ গতবার শিশু প্রহরের বাইরে এক দিন মেলায় গিয়ে বড়দের টিপ্পনী শুনেছে সে, ‘আজকেও দেখি পোলাপানের ভিড়!’
লেখকদের কাছাকাছি যাতে বড়রা যেতে পারে, তার জন্য আলাদা মঞ্চ আছে। আমাদের কেন সেই সুযোগ থাকবে না? আমাদের কী দোষ? শিশুদের নিয়ে লেখা গল্প, ছড়া স্বয়ং লেখকের মুখে শোনার ব্যবস্থা থাকলে মনে হতো, মেলাটা আমাদেরও। রেহনুমার এই ধারণাটা বেশ মজার। ভাবতেই ভালো লাগছে, দেশের নামকরা কোনো ছড়াকার বা গল্পকার শিশুদের তাঁর রচনা পড়ে শোনাচ্ছেন বা শিশুরা তাদের লেখা পড়ে শোনাচ্ছে।

মেয়েটি তার গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলল, আমরা ঢাকায় গিয়ে চাচা-মামাদের বাসায় থেকে মেলায় যাই। কিন্তু যারা নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ থেকে আসে, তারা কিন্তু অনেক ক্লান্ত থাকে। তাদের বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে। তাদের জন্য একটু বিশ্রাম, একটু বসার ব্যবস্থা রাখা কি খুব বড় চাওয়া? বইমেলার ভেতরে বসার জায়গা নিতান্ত কম। বড় মানুষও অনেক সময় হাঁপিয়ে ওঠে। তার মতে, মেলার সময়টা বেলা ৩টা থেকে না করে সকাল থেকে করলে ঢাকার আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে আসা ছেলেমেয়ে একটু বেশি সময় পেত। এই মৌসুমে বেলা ছোট থাকে। তাগিদ থাকে সন্ধ্যার আগেই তাদের বাস ধরার।

এতটুকু মেয়ে অন্যদের জন্য এত কিছু ভাবে, আমরা কেন ভাবতে পারি না? মাইকের আওয়াজ কি একটু নিয়ন্ত্রণ করা যায় না? বড় বেশি ‘নয়েজ পলুশন’ হয় সেখানে। মেলায় নতুন প্রকাশিত বইগুলোর নাম মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। ব্যাপারটা আরেকটু ডিজিটাল হলে ভালো হতো। মেলায় বড় একটি বা দুটি স্ক্রিনে সদ্য আসা বইয়ের প্রচ্ছদ ও বিস্তারিত দেখানো গেলে কোনো বইয়ের ঘোষণাই মিস হতো না।

শিশুদের পছন্দ-অপছন্দের খোঁজ

রেহনুমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এত এত বুদ্ধি খাটানো প্রস্তাব সে কি কখনও একাডেমিকে জানিয়েছে? সে সুযোগ কি আছে? পাল্টা প্রশ্ন তার, ‘আপনারা মনে করেন, যে বয়সে ছোট, সে বুদ্ধিতেও খাটো। দেখুন, আমরা মানে যাদের বয়স ১৮ হয়নি তারা কিন্তু দেশের প্রায় অর্ধেক। কিন্তু আমাদের কেউ গোনেই না।’

ঠিকই তো। শিশু-কিশোরদের সঙ্গে কথা বললে তাদের মনের অনেক কথা আমরা জানতে পারতাম। একাডেমির সেই চেষ্টা থাকা প্রয়োজন। শিশুদের কাছেও শেখার আছে। শিশু আর পরিবারবান্ধব বইমেলা করতে শিশুমনস্ক একটি মন চাই।

একাডেমি ছাড়া অন্যরা আর কী করতে পারে

এখানেও রেহনুমার সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব আছে। দোকানের ছেলেমেয়ে প্রায় সবাই নতুন। বড়দের কথা তারা যত মন দিয়ে শোনে, ছোটদের বেলায় তেমন সাড়া দেয় না। পোশাকি স্মার্টনেস দেখে তারা নড়েচড়ে। শিশুদের মধ্যে যারা বিশেষ, তাদের সঙ্গে কীভাবে ভাব বিনিময় করবে সেটা জানিয়ে দেওয়া খুব জরুরি। প্রশিক্ষণ ছাড়া কাউকে এ কাজে বসানো ঠিক নয়।

প্রকাশকরা অনেক রোজগার করেন মেলা ঘিরে। কিন্তু শিশুদের জন্য তাদের সৃষ্টিশীল বিনিয়োগ নেই। নতুন পাঠকদের মনকাড়া বই প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে বিষয়বস্তু শিশুদের তেমন টানতে পারছে না। এখনকার পাঠক আগামীর ক্রেতা। শিশুদের টানতে না পারলে বই প্রকাশনার মূল ভিতটাই দুর্বল হয়ে যাবে, সেটা আমরা কবে বুঝব?
অনেকেই বলবেন, ‘বই তো চলে না, কেউ বই কেনে না, দিন দিন পাঠকের সংখ্যা কমছে। বইমেলায় বেশির ভাগ মানুষই যায় ঘুরতে, ফালতু আড্ডা দিতে, সেলফি তুলতে ইত্যাদি।’ যদি সেটাই হয়, তবে দিন দিন স্টলের চাহিদা আর সংখ্যা বাড়ে কেন?

আরও কয়েকটি সুপারিশ

১. মেলায় ঢুকে যে শিশুরা তাদের চত্বরে যাবে– সে রকম কোনো নির্দেশনা থাকে না। সেটা থাকা দরকার। স্টলে স্টলে শিশুদের বিশেষভাবে অভ্যর্থনা জানানো প্রয়োজন।
২. শিশুদের জন্য আলাদা পানি পান বা তাদের মাপের উপযোগী শৌচাগার ও হাত ধোয়ার বেসিনের ব্যবস্থা থাকা দরকার।
৩. যেসব প্রকাশক বড়দের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের জন্য বই প্রকাশ করেন, তারা শুধু শিশুদের জন্য আলাদা পরিসর রেখে স্টল বানাতে পারেন, যেখানে মা-বাবার সঙ্গে শিশুরা গিয়ে তাদের বই খুঁজতে পারবে।
৪. বড় শিশুর সঙ্গে মা যে কোলের সন্তানকে নিয়ে আসেন, তার জন্য কোনো ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার থাকতে পারে।

যে বইমেলা শিশুকে আকর্ষণ করবে, সেই বইমেলা দেশকে পথ দেখাবে। একটি পড়ুয়া জাতি গড়ে তোলা আমাদের সবার লক্ষ্য হোক। সেই লক্ষ্যে শিশুরা থাকবে সবার চিন্তা আর কাজের কেন্দ্রে।

Leave a Reply