প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মা ইলিশের প্রজনন নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ ধরা বন্ধ। এই সময় জেলেদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২২)
জাল ও নৌকাকে এখন অপরাধ সংগঠনের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হচ্ছে আর জেলেরা হচ্ছেন সন্দেহভাজন অপরাধী।
মা ইলিশ রক্ষা করার জন্য কমবেশি ৩৮ জেলায় এখন সাজ সাজ রব। নৌকা সাজিয়ে ছুটছে ইলিশ রক্ষার কোতোয়ালেরা। শ্যামা নৃত্যনাট্য চলেছে যেন মঞ্চে মঞ্চে ‘হোক না সে যেই কোনো লোক, চোর চাই। নহিলে মোদের যাবে মান!’ দক্ষিণে সাগর, নদী মোহনা থেকে উত্তরের কুড়িগ্রামের রৌমারী-রাজীবপুর পর্যন্ত চলছে ‘ইলিশ চোর ধরার অভিযান।’ ধরপাকড়, জেল-জরিমানা, জালে আগুন চলছে দেদার।
আগুন ধরিয়ে সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার মধ্য একধরনের আদিমতা কাজ করে। কেউ কেউ এটাকে যা খুশি তা-ই করতে পারার ক্ষমতার প্রকাশ বলে মনে করেন। অবুঝ শিশু হাতে আগুন পেলে যেখানে-সেখানে লাগিয়ে যেমন উল্লাস প্রকাশ করে, অনেকটা সে রকমই ঘটছে যেন। বরিশাল থেকে খবর এসেছে, সেখানকার এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছেলেমি উত্তেজনায় জাল জ্বালাতে জ্বালাতে হুকুম দখল বা রিকুইজিশন করা নৌকাটাও জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মা ইলিশ রক্ষার লক্ষ্যে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মা ইলিশের প্রজনন নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। এ সময় সারা দেশে ইলিশ ধরা, বহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় দণ্ডনীয় অপরাধ। এসব অপরাধের জন্য এক থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। কোথাও জাল জ্বালানো বা নৌকা পোড়ানোর বিধান নেই। তবু জালে আগুন দিয়ে সে খবর সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে কী বাহাদুরি দৃশ্যমান হচ্ছে কে জানে!
মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এ রকম বল্গাহীন আচরণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব শেখ ইউসুফ হারুন পত্রিকান্তরে জানান, ‘সবখানেই এখন অধঃপতন। প্রশাসনও তার বাইরে নয়। এখন সরকারি কর্মকর্তারা অনেক ভালো জীবন যাপন করেন। এই মূল্যস্ফীতির বাজারেও তাঁরা যে বেতন পান, যে সুযোগ-সুবিধা পান, তা তাঁদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি।
তারপরও তাঁদের অনেকের আচরণে উন্নতি নেই, সেবার মান কমছে। তাঁরা অসহিষ্ণু আচরণ করছেন। আইনের শাসনের অনুপস্থিতিও এর কারণ। ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ইসির সঙ্গে বৈঠকের পর একজন ইউএনও টেলিভিশনে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এবার ইসির সঙ্গে বৈঠকে ডিসি-এসপিরা যে ভাষা ও ভঙ্গিতে প্রতিবাদ করেছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়।’
জাল ও নৌকাকে এখন অপরাধ সংগঠনের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হচ্ছে আর জেলেরা হচ্ছেন সন্দেহভাজন অপরাধী।
প্রজ্ঞাপনে খুব পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট ৩৮টি জেলাকে দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথম তালিকায় আছে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ২০টি জেলা। এসব জেলায় মাছ ধরার নৌকা নিয়ে নদী, নালা, খাল, বিল, মোহনা, সাগর—কোথাও যাওয়া যাবে না। বাকি ১৮টা জেলা যেমন নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, জামালপুর, রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খুলনা, কুষ্টিয়া ও নড়াইল জেলায় নদ-নদী, খাল-বিলে ইলিশ ছাড়া সব মাছ ধরা যাবে।
কিন্তু কার্যত সেটা হচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অভিযানকারীরা দুই তালিকার পার্থক্য অনুধাবন না করেই ‘ইলিশ চোর’ ধরতে নেমে গেছেন। আর যেখানেই জেলে পাচ্ছেন, সেখানেই জাল জব্দ করছেন। সব জালে যে ইলিশ ধরা দেয় না, ইলিশের জাল যে আলাদা, এটা আমাদের পাঠ্যপুস্তক বা বিসিএসের নোটবইয়ে লেখা নেই। তাই অভিযানে নামা কর্তাদের কাছে জেলে মানেই ‘ইলিশ চোর’, সে প্রথম তালিকার জেলারই হোক অথবা থাকুক দ্বিতীয় তালিকাভুক্ত।
সিরাজগঞ্জের যমুনায় যেখানে অন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ নয়, সেখানেও নৌ পুলিশের কর্তারা ভাসমান কেন্দ্র বসিয়ে ‘কেউ যেন মাছ ধরতে নদীতে না নামতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য নৌ পুলিশের অভিযান’ চালাচ্ছেন। সিরাজগঞ্জ সদরে প্রথম দিনেই ১ লাখ ৫০ হাজার মিটার জাল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জালহারা জেলেরা কি আগামী মৌসুমের আগে আবার জাল জোগাড় করতে পারবেন? নাকি জড়িয়ে যাবেন নতুন ঋণের জালে?
তালিকাভুক্ত ইলিশ জেলেদের নিষিদ্ধ মৌসুমে কিছু খয়রাতি চাল দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে। ইলিশ মৌসুমের শুরুতে যে ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে, সেই কদিনের খোরাকি হিসেবে ৪০ কেজি চাল দেওয়া হয়। চলমান নিষেধাজ্ঞার ২২ দিনের খোরাকি ধরা হয়েছে ২৫ কেজি। অক্টোবরের ১৪ তারিখ পর্যন্ত খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, কোথাও তখন পর্যন্ত চালের বিলিবণ্টন শুরু হয়নি।
কোথাও কোথাও তালিকা চূড়ান্ত করা বাকি। শীতের কম্বল বর্ষায় বিতরণ এখন আমাদের নিত্যচর্চায় পরিণত হয়েছে । গত বছর (২৯ আগস্ট ২০২১) ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২১’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমার কাছে তথ্য আছে, জেলেরা খাদ্যসহায়তার চাল ঠিকমতো পান না। জেলেরা সমুদ্রে অনেক কষ্ট করে মাছ ধরেন। তাঁরা যাতে তাঁদের খাদ্যসহায়তা সঠিকভাবে পান, সে জন্য আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’ বলা বাহুল্য, সে অব্যবস্থা এখনো চলমান।
বরগুনার ক্ষুব্ধ জেলেরা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘মোগো চাউল লাগবে না, ভারতীয়গো মাছ ধরা ঠ্যাকান’, ‘আমরা না খেয়েও থাকতে রাজি, কিন্তু আমাদের জলসীমায় অন্য দেশের ইলিশশিকারিরা যেন না ঢোকে।’
নিষিদ্ধ মৌসুমে বাংলাদেশের জেলেদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর উচ্চক্ষমতার ট্রলার আমাদের জলসীমা চষে বেড়ায়। একটা-দুইটা ট্রলার কখনো ধরা পড়লেও বেশির ভাগই মাছ নিয়ে ভেগে যায়। তাই উপকূলের জেলেদের আরজি, ‘এইয়া না ঠেহাইতে পারলে কোনো কাম অইবে না। মোরা না খাইয়া থাকতেও রাজি আছি, তোমো (তবুও) ওগো মাছ ধরা যেন সরকার ঠ্যাকাইয়া রাহে।’
বন্ধ হোক জেলেদের হয়রানি আর জাল-নৌকা জ্বালানোর আত্মঘাতী চর্চা। জেলেদের আস্থায় নিয়েই ইলিশের আবাদ বাড়াতে হবে। জেলেরা ইলিশের দুশমন নন।