কোলে সন্তান নিয়ে পরীক্ষা দিতে আসা বালিকা মায়েদের বিরক্ত না করি

বাল্যবিবাহ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৩)

বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়। দেশ, সমাজ, প্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনতে চায়—বিদ্যায়তনে সেই পরিবেশ ও মানসিকতা থাকার বার্তাটা কিশোরীদের কাছে প্রমাণসহ পৌঁছানোটা খুবই জরুরি।

পরিসংখ্যান সাক্ষ্য দিচ্ছে, কিশোরী বা বালিকাদের বিয়ে বন্ধ করা তো যায়ইনি বরং বিভিন্ন সংকটের সময় তা বেড়েছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল তাদের সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশ এখন বাল্যবিবাহে শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয় বরং গোটা এশিয়ায় সবার ওপরে। এশিয়ায় আমাদের চেয়ে গরিব দেশ আছে; আবার ধর্মীয় গোঁড়ামির অপেক্ষাকৃত মোটা চাদরে ঢাকা দেশও আছে। কিন্তু বাল্যবিবাহের রেকর্ডে আমাদের কেউ টেক্কা দিতে পারছে না। আমরা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছি। জাতীয় চ্যাম্পিয়নের মর্যাদা নিয়েও বাগেরহাটের কিশোরী রাগবি খেলোয়াড়েরাও অসময়ের বিয়ে ঠেকাতে পারেনি। পড়াশোনাও শিকেয় উঠেছে। করোনার ছোবল না এলে হয়তো তারা আরেকটু সময় পেত; কিন্তু বিয়ে ঠেকিয়ে খেলাধুলা আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারত বলে মনে হয় না। এ রকম একটা বৈরী পরিবেশে কোনো কোনো কিশোরী বিয়ে করতে বাধ্য হলেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার এক অন্য রকম যুদ্ধে নেমেছে। নিজেদের মতো করে চালিয়ে যাচ্ছে সেই যুদ্ধ। বিয়ে ঠেকাতে পারেনি, গর্ভধারণ করতে হয়েছে; তারপরও দাঁতে দাঁত চেপে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষায় বসছে।
করোনার পরে স্কুল খুললে ছাত্রছাত্রীদের মনের খবর জানতে নানা জেলায় গিয়েছি। রংপুরের বদরগঞ্জে এক স্কুলবালিকা বলেছিল, ‘পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার শর্তে বিয়েতে বসেছিলাম; কথার বরখেলাপ হলে ছুটে যাব (তালাক দেব) কিন্তু পড়াশোনা ছাড়ব না।’ মনে হয়েছিল ঝোঁকের মাথায় সে কথাগুলো বলে ফেলেছে। তাদের কথাগুলো ভেবে বলতে বলেছিলাম। পরেরবার কোনো শব্দ বদল না করে একই বয়ান দিয়েছিল তারা। বলেছিল, ছবিসহ নাম–ঠিকানা দিয়েও তাদের কথাগুলো লিখতে পারি। জানিয়েছিল, শ্বশুরবাড়ির লোকের সামনেও কথাগুলো তারা বলতে পারবে। পড়াশোনায় থাকার সেই অঙ্গীকারের প্রমাণ পরের পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে আমরা পেয়েছি। সবাই পারেনি কিন্তু অনেকেই পেরেছে, পারছে। স্বামীদের মতলব আমাদের জানা নেই। গর্ভধারণের জন্য জোর করা ও উৎসাহিত করার কারণে যে অনেকে আর এগোতে পারেন না, সেটি আমাদের অজানা নয়। চার দিনের শিশু, এক মাসের শিশু নিয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিতে চলে এসেছেন কয়েকজন পরীক্ষার্থী। তাঁদের সালাম ও অভিনন্দন। আমাদের উচিত হবে তাঁদের বিরক্ত না করে সহায়তা করা। পরীক্ষার হলে ঢুকে সন্তানসহ তাঁদের ছবি তোলাটা কি এতই জরুরি? কোনো কোনো কর্মকর্তা পরীক্ষার্থীর সদ্যোজাত শিশুদের কোলে নিয়ে নিজেকে ভাইরাল করার লোভ সামলাতে পারেননি। অনেক সংবাদকর্মী বিয়ের সময় পরীক্ষার্থীর বয়স আইনসিদ্ধ ছিল কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন করে চার–পাঁচ লাইন লিখে ফেলেছেন। একবারও ভাবেননি এগুলো পরীক্ষার্থীকে নতুন বিড়ম্বনা আর জটিলতায় ফেলতে পারে। খামাখা এক মানসিক চাপের জন্ম দিতে পারে। দিনের শেষে তাঁদের সেই শ্বশুরবাড়িতেই ফিরতে হবে, যাঁরা অপেক্ষা করতে রাজি ছিলেন না। যাঁদের নাতিপুতির মুখ দেখতে তর সইছে না।

কীভাবে সন্তানসম্ভবা ও দুধের শিশু নিয়ে আসা পরীক্ষার্থীদের সহায়তা করা যায়?
কর্তৃপক্ষ এসব পরীক্ষার্থীকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পরীক্ষার্থী হিসেবে বিবেচনা করার একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। এখন পর্যন্ত কেবল শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী হিসেবে বিবেচনা করার রেওয়াজ আছে। শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীর প্রতিবন্ধিতার কথা উল্লেখ করে সময়মতো যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা কিছু ছাড় দিয়ে থাকে। এই ছাড় সাধারণত খাতা জমা দেওয়ার সময় বাড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। চলতি বছর ময়মনসিংহ বোর্ড তার আওতাধীন বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রের মোট ৪৭ জন শিক্ষার্থীকে ৩০ মিনিটের অতিরিক্ত সময়সহ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে একজন সহকারী নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। অন্যান্য বোর্ডেও সে রকম ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে।
সদ্যোজাত শিশু বা শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করে, এমন শিশুকে দুধ পান করানো ছাড়াও নানা যত্নে পরীক্ষার্থী মাকে সময় দিতে হয়। তাই তাঁদের পরীক্ষা শেষ করতে একটু বেশি সময় লাগাটাই স্বাভাবিক। একটি কেন্দ্রের সহকারী প্রধান শিক্ষক বলেছেন, ‘নিয়ম মেনে শিশুটির জন্য নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। তাকে কয়েকবার মায়ের দুধ পানের ব্যবস্থা করা হয়।’ অবশ্য এই কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কোলের শিশু নিয়ে পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা দিতে আসার বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নন।
অন্য একটি কেন্দ্রে যাঁরা পরীক্ষার্থীর শিশুকে কোলে নিয়ে নানা ভঙ্গির ছবি প্রকাশ করেছেন। তাঁদের ক্ষমতা অনেক; তাঁরা চাইলেই জেলা–উপজেলা পর্যায়ে সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক থেকে শিশুর জন্য একটা দোলনা বা বিছানার ব্যবস্থা করা সম্ভব। আস্থায়ী এ রকম ব্যবস্থা মা পরীক্ষার্থীদের অনেক সাহস জোগাবে। পরীক্ষায় তাঁরা মন দিতে পারবেন।
এবার স্মরণকালের সবচেয়ে গরমের মধ্যে পরীক্ষা হচ্ছে। তাই নবজাতক ও পরীক্ষার্থী মা ছাড়াও অন্য পরীক্ষার্থীদের যেকোনো জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী রাখা প্রয়োজন। সাহস করে যাঁরা পরীক্ষা পর্যন্ত তাঁদের যুদ্ধটাকে জারি রেখেছেন, তাঁদের জন্য একটা অনুকূল পরীক্ষা পরিবেশ সৃষ্টির কথা আমাদের ভাবতে হবে।

এ বছরও ঝরে পড়েছে অনেক কিশোরী শিক্ষার্থী বলা হয়ে থাকে, দেশের মধ্যে কুমিল্লা শিক্ষায় অগ্রসরমাণ জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আধুনিক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হওয়ার অনেক আগে থেকেই কুমিল্লা বোর্ডের সার্বিক পাসের হার অন্য বোর্ডগুলোর চেয়ে বেশিই থাকত। সেই কুমিল্লা বোর্ডে এবার প্রায় ৩২ হাজার কিশোরী রেজিস্ট্রেশনের পরও পরীক্ষা দিতে পারেনি। কুমিল্লায় শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এবার এসএসসির জন্য নিবন্ধন করেছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ২৫৮ জন। কিন্তু ফরম পূরণ করে মাত্র ১ লাখ ৮৫ হাজার ১০৬ জন। সে হিসাবে ৫৭ হাজার ১৫৩ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষার আগেই ঝরে গেছে। এ তালিকার ৫৭ হাজারের মধ্যে ৩২ হাজারের বেশি হচ্ছে ছাত্রী। তা ছাড়া টেস্টে উত্তীর্ণ এবং ফরম পূরণের পরে আরও ২ হাজার ৬১৮ শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে আসতে পারেনি। শিক্ষাদীক্ষায় অন্য বোর্ড বা জেলাগুলো থেকে এগিয়ে থাকা কুমিল্লার যদি এই অবস্থা হয়, তবে অন্যদের অবস্থা যে খুব একটা ভালো না, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিয়ে হয়ে যাওয়া, গর্ভবতী হয়ে পড়া বা সন্তানের মা হওয়া শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনাটা জরুরি বাল্যবিবাহ যখন আশানুরূপ হারে ঠেকানো যাচ্ছে না, তখন বিয়ে হয়ে যাওয়া কিশোরীদের স্কুলে–মাদ্রাসায় ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে অল্পবয়সী এসব নারীদের স্বাস্থ্যগত কারণেই সন্তান নেওয়াকে বিলম্বিত করার কাজগুলোকে আরও বেগবান ও সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন।

বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়। দেশ, সমাজ, প্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনতে চায়—বিদ্যায়তনে সেই পরিবেশ ও মানসিকতা থাকার বার্তাটা কিশোরীদের কাছে প্রমাণসহ পৌঁছানোটা খুবই জরুরি।

Leave a Reply