গণতন্ত্রের লাঞ্ছনা দেখে তাঁরা কী গান গাইতেন

গণতন্ত্রের লাঞ্ছনাঘটনা নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ:  ১৮ জানুয়ারি ২০২৪)

নদীয়াঘেঁষা প্রমিত বাংলায় ‘ঝুটা’ বলে কোনো শব্দ নেই। লক্ষ্ণৌয়ি উর্দুতে শব্দটির প্রচলন আছে, সেখানে মিথ্যা বা ব্যর্থ অর্থে ‘ঝুটা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

তবে পুরান ঢাকার প্রচলিত কথ্য ভাষায় ঝুটার ব্যবহার আছে। ব্যবহার আছে বৃহত্তর ঢাকার কথ্যবুলিতেও।

নদীয়ার প্রমিত বাংলায় যেটা এঁটো বা উচ্ছিষ্ট কিংবা খাবারের পরিত্যক্ত অংশ ঢাকার বাংলায় সেটাই ঝুটা।

বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বাংলা ভাষায় আরবি ফারসি তুর্কি হিন্দি উর্দু শব্দের অভিধান’ বইয়ে ‘ঝুটা’

শব্দটি হিন্দি শব্দ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে (পৃষ্ঠা ১৫৭)। এর বাংলা অর্থ হচ্ছে মিথ্যাবাদী, মিথ্যুক।

পণ্ডিত লেখক বিচারপতি হাবিবুর রহমান তাঁর যথাশব্দ (পরিবর্তিত ২য় সংস্করণ ১৯৯৩) বইয়ে শব্দটির ব্যাখ্যা আরও খোলসা করেছেন। তিনি ঝুটাকে অসত্য (৫০৮, পৃষ্ঠা ১৮২), মিথ্যাবাদিতা (৫৫৬, পৃষ্ঠা ২০২) এবং প্রতারণা (৫৫৭, পৃষ্ঠা ২০৩) প্রভৃতি শব্দের যথাশব্দ তালিকায় রেখেছেন।

তবে পোশাকশিল্পের যুগে পৌঁছানোর পর বাংলায় ‘ঝুট’ শব্দটির নানামুখী ব্যবহার শুরু হয়—উচ্ছিষ্ট কাপড়কে ঝুট বলা হতে থাকে এখানে। উচ্ছিষ্ট কাপড়ের কেনাবেচা ‘ঝুট ব্যবসা’র তকমা লাভ করে। ক্রমশ একটি ব্যবসা শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

এই ব্যবসায়ীদের এখন জোট বা সমিতি আছে। চট করে ধনী হওয়া, পেশিবান হওয়া বা পেশি পোষার এটা একটা সোপান বা প্রাথমিক ধাপ বলে অনেকে মনে করেন।

সহপাঠী পারভেজরা থাকত টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে। বাড়িতে উর্দুতে কথা বললেও আমরা তাদের কখনো ‘বিহারি’ বলতাম না। অন্তত সামনাসামনি তো নয়ই। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ইন্ডিয়া থেকে চলে আসা শিক্ষিত উর্দুভাষীদের অনেকেই বিহারি হিসেবে পরিচিত হতে অপমানিত বোধ করতেন।

সাধারণ উর্দুভাষীদের চেয়ে নিজেদের আশরাফ ভাবার এটা ছিল একটা প্রচেষ্টা। সুযোগ পেলেই জানিয়ে দিতেন তাঁরা বিহারের নন ; লক্ষ্ণৌ, কেউ ভোপাল, কেউ হায়দরাবাদ, কটক কিংবা কলকাতার।

পারভেজদের আদিনিবাস ছিল এলাহাবাদে। পারভেজের দাদাজি মাওলানা খোদা গঞ্জে বক্স উর্দু বয়ানে চমৎকার কাশিদা দিয়ে মিলাদ পড়াতেন। তখনকার ডিএম (এখন ডিসি), এসপি , এসডিও প্রমুখদের মাহফিলে তাঁকে বেশি ব্যস্ত থাকতে হতো। সরকারি অনুষ্ঠানের সুবাদে মাওলানা গঞ্জে বক্স বেসরকারি মানুষ হয়েও প্রায় সরকারি হয়ে উঠেছিলেন। তবে আমাদের কাছে তিনি ছিলেন খাটিয়ায় ঝিমাতে থাকা নিতান্তই এক সাধারণ দাদাজি।

পারভেজদের বাসায় দরজার মুখে খাটিয়ায় বসে মাওলানা খোদা গঞ্জে বক্স লম্বা নলের হুঁকা টানতেন। গরগর গরগর আওয়াজ পেলেই বলতেন, ‘কৌন? পারভেজ আয়া; আউর এক টিকিয়া ডাল দো।’

হুঁকার নিবুনিবু কল্কেতে একেকটা টিকিয়া (গুঁড়া তামাক আর চিটা গুড় দিয়ে তৈরি চ্যাপটা সন্দেশসদৃশ বস্তু) দিয়ে হুঁকার আগুনটা উসকে দেওয়ার কাতর অনুরোধ।

পারভেজের দাদা একদিন হুঁকা টানতে টানতে বলেছিলেন, ‘আমরা এসেছি এলাহাবাদ থেকে, যেমন এসেছে তোমাদের পদ্মা গড়াই।’

পুরা রাষ্ট্রদ্রোহ! পেয়ারা পাকিস্তানের আজাদি ঝুটা হ্যায়? কত বড় আওকাত! এত ভাঙা ভারতের কমিউনিস্টদের গান। দেশ ভাঙার পর দেশে শরণার্থী অব্যবস্থাপনা, খাদ্য আর জীবিকার সংকটে অতিষ্ঠ দেশবাসী কমিউনিস্টদের বাঁধা এ গান পছন্দ করেছিল। পরে স্লোগান আকারে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সেই অভিমানের বাক্যবান।
উর্দুতে তাঁর কথাগুলো কবিতার মতো শুনাচ্ছিল। বয়ানের ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিল চালু হুঁকার গরগর আওয়াজ।

আগের দিনে ভরা ভাদরে যখন গড়াই ছুটত শোঁ শোঁ, তখন কথা থেকে যেন সেই গরগর আওয়াজ আসত।

গড়াই ছুটছে গড়গড়িয়ে। গড়াইয়ের সেই দুরন্তপনা এখন ইতিহাস। দিন দিন কমছে তার পানি।

যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী ২০২২ সালে ১ জানুয়ারি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ২০ কিউসেক, ২০২৩ সালে ছিল ৯০ হাজার ৭৩০ কিউসেক ও ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি পানির পরিমাপ করা হয় ৭৫ হাজার ৪০৯ কিউসেক।

১৯৯৬-এর ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে নির্ধারিত হয় নদীটির জলপ্রবাহের মাত্রা ভারত গত ৪০ বছরের গড় মাত্রায় বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।

সেই চেষ্টা দৃশ্যমান হোক, গড়াই বাচুক—দুই হাত তুলে এ প্রার্থনা করা ছাড়া আর উপায় কী!

মাওলানা গঞ্জে বক্স মিলাদ পড়িয়ে দিন গুজরান করলেও সাদা চুল–দাড়ির এই মানুষের এলেম ছিল অঢেল। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের অন্যতম শরিক খাকছার আন্দোলনের এলাহাবাদ অঞ্চলের সংগঠক ছিলেন তিনি। ত্রিবেণি সঙ্গমের কথা তিনিই আমাদের প্রথম শুনিয়েছিলেন।

মাওলানা গঞ্জে বক্স বলতেন, এলাহাবাদের যেখানে তিন নদী—সরস্বতী, গঙ্গা, যমুনা মিশেছে, সেখানে একদিন তিনি নিয়ে যাবেন। সেখানেই নাকি তাঁদের বাড়ি। নদীর মাঝে মানুষের বাড়িঘর হয় কীভাবে? ত্রিবেণি সঙ্গমের গল্প যেদিনই শুনতাম, সেদিন রাতেই স্বপ্ন দেখতাম বড় বড় নৌকায় ত্রিবেণি সঙ্গম যাত্রার।

স্কুলের উর্দু পরীক্ষায় সব সময় ‘আচ্ছা’ ফল করত পারভেজ। সবার চেয়ে বেশি নম্বর—প্রায় ১০০–তে ১০০ পেত সে। স্কুলের সেকেন্ড মাওলানা আমাদের উর্দু পড়াতেন। তিনি পারভেজের খাতা আমাদের দেখিয়ে বলতেন, ‘কিতনা আচ্ছি হ্যান্ড রাইটিং হ্যাঁয়, কিতনা পেয়ারা লিখতা হ্যায়। মারহাবা! মারহাবা!’

যখন অষ্টম শ্রেণিতে (১৯৬৮ সাল), তখন চারদিকে আইয়ুব খানের উন্নয়নের এক দশকের মজমা চলছে। পরীক্ষার উত্তরপত্র নিয়ে উর্দু স্যার মানে সেকেন্ড মাওলানা ক্লাসে ঢুকলেন। আমরা সবাই পারভেজ–বন্দনা শোনার জন্য কান খাড়া করে আছি। সবার খাতা দেওয়া হলো পারভেজের খাতা ছাড়া। বিস্ময়কর ঘটনা।

স্যার খাতা সাজাতেন প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে। বলাবাহুল্য, পারভেজের খাতা থাকত সবার ওপরে। ক্লাস সিক্স থেকে আমরা সেটাই দেখে এসেছি। এবার সেটা ঘটল না।

সবাই খাতা দেখে খাতা জমা দিয়ে ছুটির অপেক্ষায়। স্যার ছুটি দিয়ে দিলেন। আমি আর পারভেজ একসঙ্গে বাড়িতে ফিরি। তাই আমি অপেক্ষায় থাকি। স্যার আমাকেও বাইরে চলে যেতে বলেন। আমি দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি বারান্দায়।

স্যার দরজা বন্ধ করে হামলে পড়েন পারভেজের ওপর প্রথমে বেত, তারপর বেত ভেঙে গেলে কিল–ঘুষি। আমি বাইরে থেকে শুধু পারভেজের আর্তনাদ শুনি। স্যার বলতে থাকেন, ‘কাহো গলতি হ গিয়া; মাফি মাঙ্গো বল ভুল হয়ে গেছে মাফ চা।’

পারভেজ মাফ চায় না। মার থামে না। পাশের প্রেয়ার রুম থেকে ছুটে আসেন চৌধুরী স্যার। আমাদের প্রথম শ্রেণিশিক্ষক। তৃতীয় শ্রেণি থেকে আমাদের সবাইকে চেনেন।

আমার চোখে পানি দেখে স্যার অস্থির হয়ে আমাকে নিয়েই ক্লাসে ঢুকে যান। দেখি, পারভেজ মাটিতে, বেত ভেঙে গেছে, স্যার জুতা হাতে নিয়েছেন। উর্দু-ফারসির পণ্ডিত মাওলানা খোদা গঞ্জে বক্সের নাতি এমন কী ভুল করেছে যে তাকে ঘর বন্ধ করে পেটাতে হবে?

সেবার আমাদের শব্দ দিয়ে বাক্য রচনায় ‘ঝুট’ শব্দটা দেওয়া হয়েছিল। স্যার শিখিয়ে ছিলেন, ‘ঝুট মাত কাহ’, আমরা সবাই তা–ই লিখে উতরে গিয়েছিলাম। শুধু পারভেজ কেরদানি করে লিখে বসে এক দীর্ঘ বাক্য, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় লাখো আদমি ভুখা হ্যায়।’

পুরা রাষ্ট্রদ্রোহ! পেয়ারা পাকিস্তানের আজাদি ঝুটা হ্যায়? কত বড় আওকাত! এত ভাঙা ভারতের কমিউনিস্টদের গান। দেশ ভাঙার পর দেশে শরণার্থী অব্যবস্থাপনা, খাদ্য আর জীবিকার সংকটে অতিষ্ঠ দেশবাসী কমিউনিস্টদের বাঁধা এ গান পছন্দ করেছিল। পরে স্লোগান আকারে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সেই অভিমানের বাক্যবান।

দেশভাগের কারণে গ্রামছাড়া কলোনির খাটিয়াকেন্দ্রিক জীবনে অতিষ্ঠ সাবেক খাকছার লাল টুপি পরে খোদা গঞ্জে বক্স এ গান গাইতেন খাটিয়ায় শুয়ে গুন গুন করে। সুযোগ পেয়ে পারভেজ তার দাদাজির মুখের গানটা উর্দু প্রশ্নের উত্তরে বসিয়ে দিয়েছিল।

একাত্তর–একানব্বই পেরিয়ে গঞ্জে বক্সের মতো লাল টুপিওয়ালারা যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে গণতন্ত্রের লাঞ্ছনা দেখে তাঁরা কী গান গাইতেন?

Leave a Reply