পরিস্থিতি প্রতিবেদন-১৫ ০৪ জুন ২০২৩
গলায় লিচুর বিচি আটকে শিশু মৃত্যুর ঘটনা বেশ উদ্বেগজনক, অভিভাবকের সচেতনতা এই দুর্ঘটনা রোধ করতে পারে
গলায় খাবার আটকিয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনা অহরহ ঘটছে। মধুমাসে লিচুর বিচি আটকে শিশুর মৃত্যুর হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গিয়েছে। চলতি বছর (২০২৩) গত এক মাসে (মে, ২০২৩) গলায় লিচু বিচি আটকে কমপক্ষে ৭ জন শিশু মারা যাওয়ার খবর মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ১ জন প্রতিবন্ধী শিশু আছে। আছে ছয় সাত মাস বয়সী শিশু থেকে ছয় বছরের শিশু।

এই ধরনের দুর্ঘটনা রোধে যা জানা জরুরি
কাদের হয় ও কেন
প্রতি বছর ১০ মিলিয়ন মানুষের গলায় খাবার বা অন্য কিছু আটকিয়ে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রবীন এবং ছোট শিশুদের গলার গ্যাগ রিফ্লেক্স কম থাকে। ফলে গলায় খাবার আটকে যেতে পারে। শ্বাসনালির মুখে খাবার আটকে গেলে ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। শরীরে অক্সিজেন চলাচল কমে যায়। এমনকি পুরোপুরি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে শিশুর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে।
কখন সাবধান হবেন
শিশু হোক বা বয়স্ক মানুষ, গলায় কিছু আটকে গেলে কয়েকটা লক্ষণ দেখলে অবিলম্বে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখবেন, এখানে সময়ের দাম অনেক বেশি। সময় নষ্ট করলে জীবন দিয়ে তার দাম দিতে হবে। শ্বাসনালীতে কিছু আটকে গেলে প্রথমেই মানুষটির নিঃশ্বাসের কষ্ট হবে। এর জন্যে কাশি হবে, বুকের মধ্যে সাঁই সাঁই শব্দ, বমি বা বমি বমি ভাব, কথা বলতে না পারা, এমনকি বা অক্সিজেন গ্রহণ একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে রোগীর ঠোঁট নীল হয়ে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ৭–১২ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা শুরু না করলে রোগীকে বাঁচানো মুশকিল।
তাৎক্ষণিক করণীয়
শিশু বা প্রবীন যেই হোক না কেন এ রকম পরিস্থিতিতে কাউকে পড়তে দেখলে অসুস্থ মানুষকে পেছন থেকে জড়িয়ে দুই হাত দিয়ে পেটের ওপরের দিকে জোরে জোরে চাপ দিলে আটকে যাওয়া বস্তু বা খাবার দ্রুত বের হয়ে যাবে। খুব ছোট শিশুকে কোলে নিয়ে হাতের ওপর উপুড় করে পিঠে চাপড় দিতে হবে। কোনভাবেই পানি বা গলায় হাত দিয়ে খাবার বের করার চেষ্টা করা যাবে না। অ্যাম্বুলেন্স ডেকে কাছের হাসপাতালে নিতে হবে। জিনিসটি বের না হওয়া বা হাসপাতালে চিকিৎসা না শুরু হওয়া পর্যন্ত পদ্ধতিটি চালিয়ে যেতে হবে। পুরোটা সময় খেয়াল রাখতে হবে রোগীর জ্ঞানের মাত্রা কমে যাচ্ছে কি না, রোগীর হার্ট বন্ধ বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে যাচ্ছে কি না। তাহলে দ্রুত বুকে চাপ তথা সিপিআর শুরু করতে হবে। বাড়িতে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ থাকলে ব্যাপারটা জেনে রাখলে ভালো হয়। স্কুল, কলেজ, রেস্তোরা, পাড়ার ক্লাব মেম্বার আর অ্যাম্বুলেন্সের কর্মীদের এই প্রশিক্ষণ থাকলে অনেক বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
প্রতিরোধ
খাওয়ার সময় প্রতিটি খাবারে মনোযোগ দিন। ছোট ছোট গ্রাসে খাবার খেতে হবে এবং খাওয়ার সময় কথা কম বলতে হবে। দেড়-দুই বছরের শিশু বাড়িতে থাকলে তার হাতের কাছে ছোটখাটো জিনিস না রাখাই ভালো। খাওয়ানোর সময় বেশি তাড়াহুড়া করা যাবে না, জোর করে শিশুর মুখে খাবার গুঁজে দেওয়া অনুচিত। অসুস্থ ও প্রবীন রোগীদের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার দেওয়া উচিত।
সতর্ক থাকতে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে
• চারপাশে ১ ১/৪ ইঞ্চি বা ২ ১/৪ ইঞ্চির চেয়ে ছোট যে কোন খেলনা বা বস্তু শ্বাসরোধের (চকিং) জন্য ঝুঁকি। কোন বস্তুর নিরাপত্তা মূল্যায়ন করতে ‘চোক টেস্টার’ ব্যবহার করতে পারেন। যদি বস্তুটি সিলিন্ডারের মধ্যে সম্পূর্ণ ফিট হয়ে যায় তবে এটা গিলে ফেললে দম বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি আছে।
• মাঝে মাঝে আপনিও নিজেকে শিশু হিসেবে ভাবতে পারেন, একটা শিশু তার চারপাশের কোন কোন জিনিস মুখে পুরে নিতে পারে তা খুঁজে বের করুন এবং সেগুলো হাতের নাগালের বাইরে নিয়ে যান। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো- ছোট ব্যাটারি, বোতাম, গয়না, পুঁতি, পিন, ফলের বিচি (লিচু বা জামের বিচি), কাগজের ক্লিপ, ট্যাপ, স্ক্রু, পেরেক বা মার্বেল ইত্যাদি।
• লিচু বা জাম খাওয়ার পর বিচিগুলো সংগ্রহ করে শিশুর নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
• পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের শক্ত দানার কোন খাবার এমনকি লজেন্স দেয়াও উচিত নয়, এগুলো গলায় আটকে সংকটের সৃষ্টি করে।
• লিচু বা জাম কম বয়সী শিশুদের বিচ ছড়িয়ে খাওয়াতে হবে। বড়দের তত্ত্বাবধান ছাড়া এগুলো দেয়া ঠিক নয়।
• রেফ্রিজারেটরে চুম্বক রাখবেন না বা দেয়াল বা বোর্ডে কাগজপত্র সেঁটে রাখার জন্য পেরেক বা পিন ব্যবহার করবেন না।
• বিশেষ করে খাবার টেবিল এবং শিশুর ঘুমানোর জায়গার চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন।
• আপনার তত্ত্বাবধানে না রেখে শিশুর মুখে রাবার বেলুন দেবেন না। বেলুন শ্বাসরোধের ঝুঁকি বাড়ায়, ফিতা বা গোলাকার রাবারও শ্বাসরোধের ঝুঁকি।
• আপনার পার্স এবং ডায়াপার ব্যাগ নাগালের বাইরে রাখুন, এবং নিশ্চিত হোন যে ঘরের অন্য সদস্যরাও একই কাজ করে।
• আপনি যখন অন্য কারও বাড়িতে যাচ্ছেন তখনও শিশুর দিকে বিশেষ সতর্কদৃষ্টি রাখুন।
• খেয়াল রাখুন যেন আপনার শিশু শুধু বয়স-উপযুক্ত খেলনা দিয়ে খেলে। যেমন, অনেক খেলনা ৩ বা তার বেশি বয়সী শিশুর জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করে। কারণ এসব খেলনার ছোট অংশ থাকে যা ছিটকে যেতে পারে এবং শ্বাসরোধের কারণ হতে পারে। শিশুকে অবশ্যই বয়স উপযোগী খেলনা দিন।