গৃহকর্মীর ছদ্মবেশে শিশুরা পাচার হচ্ছে

শিশু পাচার ‘ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ:  ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩)

অফিসের গাড়ি কুড়িগ্রাম যাবে। ছোট-বড় সব কলিগ জানতে চান পেছনে সিট খালি আছে কিনা? কবে ফিরব? রাত হবে কিনা? কেউ কেউ পরামর্শ দেন তাড়াহুড়ার কী আছে, পরদিন সকাল সকাল রওনা দেবেন। অন্ধকার হওয়ার আগে পৌঁছে যাবেন। সে সময় যমুনা ব্রিজ চালু হয়নি। নগরবাড়ী দিয়ে আরিচা হয়ে ফিরতে হতো কুড়িগ্রাম থেকে। কলিগ ভাইবোনদের এসব খোঁজখবর নেওয়ার কারণ প্রথমবার বুঝতে পারেননি হালিম সাহেব, ভেবেছিলেন শুভাকাক্সক্ষীরা তার মঙ্গল চান তাই খোঁজখবর নিচ্ছেন। এসব ভালো মানুষ আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো এত সুন্দর, অফিসেও একটা পরিবার-পরিবার ভাব। আহা এ সুখ কোথায় রাখি!!! মনে মনে রোলন্দোর মতো ডিগবাজি খান খুশিতে।

দুজন সিনিয়র কলিগ পার্টনার প্রতিষ্ঠানের প্রধানের নাম নিয়ে বললেন, আসার আগে মাহফুজ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসবেন। আমি ফোনে বলে দিয়েছি। পেছনের সিট তো খালিই থাকবে, ওখানে বসিয়ে নেবেন। হালিম সাহেব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন! কী বসিয়ে নেবেন। কাকে বসিয়ে নেবেন? কলিগের রুম থেকে বেরিয়ে আসার আগে ফোন আসে মাহফুজ ভাইয়ের। কলিগ বলেন, ‘আরে ভাই ফ্রকের ওপরে যেন না হয় বেশি বয়স হলে ঝামেলা বোঝেন না? অ্যাভোমিন খাইয়ে দেবেন। দেখবেন সকালে যেন কিছু না খায়। রাস্তায় বমি করলে গাড়ি নষ্ট হবে। খাওয়া-দাওয়া ঢাকায় আসার পর। একশ টাকা ওর বাপকে দিয়ে দেবেন। আমি ড্রাইভারের হাতে টাকা দিয়ে দেব। না না গাড়ি উলিপুর যাবে না। আপনি আগের দিন আনিয়ে রাখবেন কুড়িগ্রাম থেকে গাড়িতে তুলে দেবেন। ফ্রক পরা দুটো ফুটফুটে শিশু ঢাকায় আসবে উন্নয়নকর্মীর বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে। উলিপুরের সুদূর চর ‘সাহেবের আলগা’ থেকে উলিপুর আসতে প্রায় সারাদিন লেগে যায় বর্ষার সময়। শীতের সময় ভেঙে ভেঙে মোটরসাইকেলে বা নৌকায় আবার মোটরসাইকেলে- এভাবে এলে চার-পাঁচ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়, তবে শরীরের কিছু থাকে না। তার পর উলিপুর থেকে কুড়িগ্রাম তাও বাসে ঘণ্টা দেড়েক পর। এত পথ পাড়ি দিয়ে কুড়িগ্রামে আসবে দুটো ছোট মেয়ে ঢাকায় দুবেলা খাবে আর মাসে একশ টাকা তাদের বাবা পাবে এই শর্তে। সেই প্রথম হালিম সাহেবের নিলামে ‘শিশু পাচারে’ অংশ নেওয়া কিন্তু সেই শেষ নয়। যতবার কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা গিয়েছেন ততবারই কাউকে না কাউকে গাড়ির পেছনের সিটে বসিয়ে ঢাকায় এনেছেন, দোয়া পেয়েছেন কলিগদের, তাদের স্ত্রীদের। অনেক ভাবি অনুযোগ করেছেন আমারটা কিন্তু ভালো দেননি। শুধু খায় আর ঘুমায়, কোনো কাজ করে না। চটকানি দিলে আবার ভোঁ ভোঁ করে কাঁদে। সারা গায়ে চুলকানি, মাথায় উকুন আমার ছেলেমেয়েরও চুলকানিতে ধরেছে, আমার মাথায় উঁকুন ওর থেকেই এসেছে। এবার কিন্তু ভাই আমার জন্য একটা ভালো দেখে নিয়ে আসবেন। মিষ্টি খাওয়াব। মিষ্টি যে কত তেতো হতে পারে তা হারে হারে বুঝেছিলেন হালিম সাহেব। এমনও হয়েছে শিশু বমি করছে বলে তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন মাঝপথে। বসের শ্বশুর হাঁস দিয়েছে। শীতে হাঁসের গোশত খুব মজা। চালের রুটি দিয়ে আহা আহা!

পেছনের সিটে বসে বমি করলে হাঁসের হাঁসফাঁসানি লাগে। তাই শিশু ঘুমাও তুমি খিদে পেটে বসের হাঁস যেন থাকে আরামে।

হালিম সাহেব শেষ পর্যন্ত মসজিদ ছুঁয়ে তওবা করলেও শিশু পাচারের এই কাফেলা থামেনি এখনো। বাড়ি বাড়ি ফ্রক পরা মেয়ে গৃহকর্মীর অন্ত নেই। কে কাকে ঠ্যাকায়। এখন তো দলে দলে শিশুপাচার হয়। কয়েক বছর আগে ষোলো জন শিশুসহ একজন কথিত পাচারকারী ধরা পড়ে বান্দরবানের হাবিব আবাসিক হোটেলে। এর বেশিরভাগই ছিল মেয়েশিশু। তার পর কী হলো? চাপ ধামা, ধামা চাপা, সুনসান খবর নেই। এ দেশে আইন আছে, মন্ত্রী আছেন, আমলা আছেন, কামলা আছেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে। উন্নতি হোক শৈনঃশৈন, ভরে উঠুক তাদের বাগান আর পদবিতে। কিন্তু এ শিশুদের কী হবে। মানবাধিকার কমিশনার? আদালতের মান্য বিচারকরা আপনারা কি কোন হাদিস দিতে পারবেন?

২০১০-এ ভূমিকম্পের পর হাইতির নাম শোনেননি এমন টেলিভিশন দর্শক পাওয়া কঠিন হবে। সংবাদপত্র পাঠকরাও জেনে থাকবেন দেশটিতে কিছু নেই। না সরকার, না প্রশাসন, না পুলিশ, না বিচারক, না মন্ত্রী, না এনজিও। সবাই ইয়া নফসি ইয়া নফসি। এর মধ্যেই ভূমিকম্পের পর সেখানে ঢুকে পড়েছিল শিশু পাচারকারী ছদ্মবেশীরা। কিছু নেই যে হাইতিতে, সেই হাইতির মানুষ সাদা রঙের এসব ছদ্মবেশীদের ধরে শিশুদের রক্ষা করেছে। জেলে পুরেছে ছদ্মবেশী মার্কিনিদের। গরিবের কী সাহস। মার্কিন মেরিনরা পানি না দিলে যাদের গোসল-খাওয়া বন্ধ সেই কাতরবিধ্বস্ত কালো মানুষগুলো শুধু শিশুদের জন্য তাদের বুকভরা ভালোবাসার শক্তিতে ভর করে পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। সপ্তাহ ধরে আটকিয়ে রেখেছে জেলে। ধন্যবাদ হাইতির মহামানবরা।

আমার এটা লিখতে খুব খারাপ লাগছে যে, আমাদের ‘সব’ থাকার পরও আমরা ‘নিরুপায়’, কেউ কাঁদে না গরিব শিশুদের জন্য। এ দেশে শিশুপাচারের জন্য দুর্যোগের অজুহাত লাগে না। আর দুর্যোগ হলে তো কথাই নেই। আমাদের দুর্যোগ সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং অর্ডার দুর্যোগের পর সব এতিমখানার দরজা খুলে দিতে বলেছে। মৃত আত্মীয়স্বজনের সম্পত্তি দখলের এই মওকা কেউ ছাড়ে না। এতিম বা অনাথদের পাঠিয়ে দেয় এতিমখানা নামের জেলখানায়।

ওড়িশার বাঙালি মায়েরা গর্জে উঠেছিল ২০০০ সালে। দুর্যোগের পর শিশুদের দূর-অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়ার সরকারি নীতির বিরুদ্ধে। কোন জনমে নড়াইল, সাতক্ষীরা থেকে ভাসতে ভাসতে ওড়িশার উপকূলে ‘পাত্তান’ (দলিল) ছাড়া ঘর বাঁধা বাঙালি মায়েরা একাট্টা হয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা ওদের যেতে দেব না, থাকব একসঙ্গে, বাঁচব একসঙ্গে।’ ভাবেনি একটা বর্ণপ্রধান সমাজে কীভাবে এসব শিশু থাকবে তাদের নতুন মায়ের কাছে। ব্রাহ্মণের এতিম ভাত খাবে নাপিতের বউয়ের হাতে। সে অসম্ভবও সম্ভব হয়েছে। ঠাঁই নিয়েছে অনাথ এতিম সন্তানরা সন্তানহারা মায়ের কোলে। ভাবেনি সে নাপিত না ব্রাহ্মণ, শূদ্র না নমশূদ্র। বাঙালি মায়ের কাছে বড় হচ্ছে ওড়িশার ব্রাহ্মণের ছেলে হরিপদ। মমতা গৃহের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়। কিন্তু আমাদের এখানে কী হচ্ছে? পুলিশ এখন গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছে। পুলিশের নির্দিষ্ট হটলাইন নম্বর ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। কোথাও গৃহকর্মী নির্যাতন হচ্ছে এমন খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে তা ৯৯৯ নম্বরে জানানোর জন্য সবার প্রতি খাস অনুরোধ আছে পুলিশের। তার পরও নানাভাবে পাচার হয়ে আসা শিশু বয়সের গৃহকর্মীদের হত্যা চলছে অবাধে।

গত ২৬ আগস্ট (২০২৩) সকালে কলাবাগানের এক বাসার দরজা ভেঙে পুলিশ শিশু হেনার লাশ উদ্ধার করে হত্যার একদিন পর। শিশুটির শরীরে নতুন ও পুরনো অনেক আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ ছাড়া তার মুখে ফেনা ও শরীর ফোলাভাব দেখে বিষয়টি হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সার্ভেয়ার সাথী পারভীন ওরফে ডলির বাসাতেই থাকত শিশু গৃহকর্মী হেনা। সার্ভেয়ার ডলি তার মেয়ের দেখভালের জন্য অনাথ শিশু হেনাকে ময়মনসিংহ থেকে নিয়ে এসেছিলেন মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে। পুলিশ জানিয়েছে, ক্ষিপ্ত ডলি প্রথমে হেনাকে লোহার কোনো বস্তু দিয়ে পেটাত, পরে তার গলায় পা তুলে শ্বাসরোধে হত্যা করে। হত্যার পর বাসায় তালা দিয়ে গা ঢাকা দেন শিক্ষিত সরকারি চাকুরে ডলি। পুলিশ অনেক খোঁজাখুঁজির পর যশোর থেকে খুনিকে পাকড়াও করে। জিজ্ঞাসাবাদে ডলি স্বীকার করে, কখনো দা অথবা বঁটি দিয়ে শিশু হেনার ওপর নির্যাতন চালানো হতো। মাঝে মধ্যে লাঠি দিয়ে বেদম পেটানো হতো। প্রতিবেশীরা জানত কিন্তু হত্যার আগে কেউ ৯৯৯ ব্যবহার করেনি।

গত ১৭ এপ্রিল ২০২৩ সকাল সাড়ে ৮টায় দক্ষিণ খুলশীর ২ নম্বর রোডের ১০১ নম্বর র‌্যাংগস এফসি বাড়ির বি-৬ ফ্ল্যাট থেকে গৃহকর্মী আমেনা খাতুনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজি ছাবের আহমদের বড় ছেলে মো. সাইফুল ইসলামের বাসায় কাজ করত পিতৃহারা কিশোরী আমেনা। আমেনা নিহত হওয়ার মাত্র আড়াই মাস আগে তাকে এই বাসায় নিয়ে আসা হয়। আমেনা খুন হওয়ার পরদিন রাতেই ফ্ল্যাটের মালিক চতুর সাইফুল ইসলাম নিজেই বাদী হয়ে খুলশী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ আছে, আমেনা খাতুনকে হত্যা বা খুন করার পর পুলিশকে প্রভাবিত করে আসল খুনি নিজেই মিথ্যা মামলা সাজিয়ে মামলার বাদী হন। উদ্দেশ্য মামলা তদন্তে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া। গৃহকর্মী আমেনা খাতুন হত্যা মামলায় তার মাকে বাদী করতে পুলিশ তিন মাস ধরে গড়িমসি করে শেষ পর্যন্ত আদালতের পুনঃপুন নির্দেশে নিহতের মাকে বাদী করে। শেষ পর্যন্ত কী হবে আল্লাহ মালুম। তবে ক্ষমতা আর প্রভাবের পাঁচের এটা একটা অনন্য উদাহরণ।

গত ২৩ জুন ২০২৩ সকালে রূপনগর থানার আরামবাগ আবাসিক এলাকার আট নম্বর রোডের বি-ব্লকের ৪০ নম্বর বাসার নয়তলার ছাদ থেকে তামান্না নামের ওই গৃহকর্মীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় গৃহকর্ত্রী অরুনিমা মৌ। পরে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় তামান্নার ডান কাঁধের হাড়, বুকের পাঁজর, মেরুদণ্ডের হাড় ও কোমরের হাড় ভেঙে গেলেও তার জ্ঞান ফিরে আসে। পুলিশকে তামান্না সব বলে যেতে পেরেছিল। দীর্ঘ আট দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর আইসিইউতে মারা যায় শিশু তামান্না।

হত্যা আর নির্যাতনের তালিকা অনেক লম্বা। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় না। হত্যাকারীদের হাত যে কত লম্বা আর শক্ত তা খুলশীর ঘটনা থেকেই মালুম করা যায়। অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। কথা ছিল জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়নে শিশু কল্যাণ বোর্ড হবে। তারা শিশুদের বিরুদ্ধে অন্যায়, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, অবহেলা রুখে দেবে। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে ওয়াদা রক্ষার।

Leave a Reply