ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’: ভারী বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে বিপর্যস্ত উপকূলবাসী

২৬ মে রাত আটটার পর বাংলাদেশের উপকূলে বছরের প্রথম ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ আঘাত হানে। এই সময় ঘন্টায় বাতাসের গতিবেগ ছিল ১১০-১২০ কিলোমিটার। সারারাত বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হেনে ২৭ তারিখ সকাল ১০ টায় স্থলভাগে উঠে আসার পর বৃষ্টি ঝরিয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ দুর্বল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অফিসের সূত্রমতে, ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ ২৭ মে সকাল ১০ টার দিকে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে গভীর স্থল নিম্নচাপটি যশোর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছিল।

আবহাওয়া অফিস ২৭ মে সকাল ১০ টায় বন্দরের জন্য সংকেতও কমিয়ে দিয়েছে। পায়রা ও মোংলা সমুদ্র বন্দরকে ১০ নম্বর মহাপিবদ সংকেত নামিয়ে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। আর কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। তবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টা অর্থাৎ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনাসহ উপকূলের বিভিন্ন জেলায় ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়। বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সময় জোয়ারের প্রভাবে বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়।

ক্ষয়ক্ষতি
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্যর ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত দুপুর ১২.০৭ বিভিন্ন জেলার ক্ষয়ক্ষতির প্রাপ্ত তথ্য নিচে দেয়া হল-

মৃত্যু: ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ এর আঘাতে এখন পর্যন্ত ৭ জন নিহত হওয়ার খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। এরমধ্য ১ জন শিশু, ১ জন নারী এবং ৫ জন পুরুষ।

অনান্য ক্ষয়ক্ষতি

ভোলা: ভোলায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে বাঁধ ধসে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ৩০ গ্রাম।
খুলনা: দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় উপজেলা কয়রার বেশ কিছু জায়গার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ ভেঙে অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে মাছের ঘের ও ফসলি জমি।রোববার (২৬ মে) দিবাগত রাতে জোয়ারের চাপেমহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের সিংহেরকোণা, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বেলাল গাজীর বাড়ির সামনের বাঁধ ভেঙে গেছে। এ ছাড়া বাঁধের নিচু কয়েকটি জায়গা ছাপিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এসব জায়গায় এলাকার মানুষ রাতভর মেরামত কাজ চালিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
দাকোপ উপজেলার শিবসা ও ঢাকী নদীর বাঁধ ভেঙে তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনীবাসিয়া গ্রামের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা তলিয়ে যায়। উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগী ফকিরকোনা, ঝুলন্তপাড়া এবং পণ্ডিতচন্দ্র স্কুল সংলগ্ন এলাকা সম্পূর্ণ প্লাবিত।
পিরোজপুর: রোববার (২৬ মে)দুপুর থেকে শুরু হওয়া জোয়ারে পিরোজপুরের বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। কোনো কোনো জায়গায় পানির উচ্চতা ৪ ফুট পর্যন্ত বেড়েছে। এতে শঙ্কায় আছেন স্থানীয়রা। জেলাজুড়ে গত প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পিরোজপুর সদর উপজেলার নামাজপুর, ভাইজোড়া, শারিকতলা, পাড়েরহাটসহ জেলার কাউখালী, ইন্দুরকানী, ভান্ডারিয়া, মঠবাড়িয়া, নাজিরপুর ও নেছারাবাদসহ জেলার সব উপজেলার বিভিন্ন এলাকার লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকেছে। এতে অধিকাংশ বাড়ি-ঘর পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
পাথরঘাটা (বরগুনা) : পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পাথরঘাটা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ১৫টির মতো গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ায় চরম বিপাকে পড়েছে এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষ। বসতবাড়ি ও চুলা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার কারণে রান্না করতে পারেনি এসব এলাকার বাসিন্দারা। পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের জিনতলা এলাকার বাসিন্দা মো. মজিবর জানান, তার এলাকায় জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধের বাইরে দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। এদিকে অতিরিক্ত জোয়ারের কারণে বরগুনার বাইনচটকি, বড়ইতলা ও পুরাকাটা ফেরিঘাটের সংযোগ সড়কসহ গ্যাংওয়ে তলিয়ে ফেরি চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। সরজমিনে গিয়ে বিকাল ৫টার দিকে দেখা যায়, বিষখালী নদীর তীরবর্তী হরিণঘাটা, জিনতলা এলাকার শতাধিক ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে।
আমতলী (বরগুনা) : বরগুনার প্রধান তিন নদীতে জোয়ারের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অস্বাভাবিক জোয়ারের তোড়ে বরগুনার আমতলী উপজেলার আড়পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড পশরবুনিয়া গ্রামের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রায় ৬০০ মিটার ভেঙে পায়রা নদীতে বিলীন হয়েছে। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব বলেন, অস্বাভাবিক জোয়ারের কারণে পানির চাপে আমতলীর পরশুরবুনিয়া এলাকার বাঁধ ভেঙে নদীতে বিলীন হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বাঁধের ভাঙা অংশ মেরামতের কাজ শুরু করেছি। এ ছাড়া যেসব বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো দ্রুত মেরামত করা হবে। জেলার এক হাজার মিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। বরগুনায় তলিয়ে গেছে ২৭ গ্রাম।
পটুয়াখালী: পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামসংলগ্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর থেকে পানি গড়িয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে সেখানকার চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
কক্সবাজার: কক্সবাজারে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরাটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর নুনিয়াছটাসহ অন্তত ২১টি গ্রাম। এসব গ্রামের হাজারো মানুষকে গৃহপালিত প্রাণী, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, কাপড়চোপড় নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে শহরের দিকে ছুটতে দেখা যায়। উপকূলের মানুষের আশ্রয়ের জন্য শহরের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাবলিক হল ও কিছু হোটেল খুলে দেওয়া হয়। কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক উপকূলে শুঁটকি উৎপাদনের মহাল রয়েছে প্রায় ৭০০টি। জোয়ারের পানিতে ৩০০টির বেশি মহাল পানিতে ডুবে গেছে।
বরিশাল: বরিশালের সব নদীর পানি বিপদসীমার উপর প্রভাবিত হচ্ছে। ফলে নিম্ন অঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি বেরিবাধঁ ভেঙ্গে শতাধিক গ্রামে ডুকে পড়েছে পানি। বরিশাল নগরের নিম্নাঞ্চলসহ অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বরিশাল নগরের রূপতলীর জিয়ানগর, খ্রিষ্টানপাড়া, পলাশপুর, বেলতলা, মোহাম্মদপুর, রসুলপুর, দক্ষিণ রূপাতলী, ভাটিখানা, কাউনিয়া, প্যারারা রোড, সদর রোড, কেডিসি, ত্রিশ গোডাউন, দপদপিয়া ও কালিজিরা এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দাদের ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় তারা ঘরবন্দী রয়েছে। এসব এলাকার গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সড়ক চলে গেছে পানির নিচে। রাস্তাঘাটের পাশাপাশি৯ তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ।
বাগেরহাট: বাগেরহাটে ঝোড়ো হাওয়ায় সঞ্চালন লাইনে গাছপালা উপড়ে পড়ায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি রোববার সন্ধ্যা থেকে পুরোপুরি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখেছে।
সাতক্ষীরা :ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে অনেক বসতবাড়ি। রবিবার দুপুরে স্বাভাবিকের তুলনায় পানির উচ্চতা বৃদ্ধি হলে উপজেলার কলবাড়ি জেলেপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান হাজি নজরুল ইসলাম। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় রবিবার ভোর রাত থেকেই শুরু হয় বৃষ্টি।
নোয়াখালী: নোয়াখালীর উপকূলীয় উপজেলা হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপসহ কয়েকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দিনাজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেড়িবাঁধ না থাকায় নিঝুম দ্বীপের সব কটি গ্রাম সম্পূর্ণ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। নিঝুম দ্বীপের প্রধান সড়কের ওপরে ২ ফুট উচ্চতায় পানি প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে অনেকের মাছের খামার ও পুকুরের মাছ। অনেক জায়গায় মানুষের বসবাস করা ঘরেও পানি ঢুকে গেছে।’

সুন্দরবনের করমজলসহ বেশিরভাগ বনভূমি ডুবে গেছে জোয়ারের পানিতে।

Leave a Reply