চূড়ান্ত খারাবির কি এখনও বাকি

ডেঙ্গু পরিস্থিতি’ নিয়ে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৩)

দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে গভীর খাদের দিকে বাঁক নিচ্ছে, তা দেখে বিখ্যাত মার্কিন গায়ক কেব মো (কেভিন রুজভেল্ট মোর)-এর গাওয়া ‘দি ওরসট ইজ ইয়েট টু কাম’ গানটির কথা মনে পড়ছে। ‘…সকালের নাশতা জোটেনি, জোটেনি দুপুরের ভাত, কারখানা বন্ধের নোটিশ ঝুলছে … আল্লাহ রহম করুক …মন বলছে … সবচেয়ে খারাপ দিনটি এখনও আসতে বাকি যে …।’ পাঁচবার গ্র্যামি জেতা এই গায়কের সঙ্গে ডেঙ্গুর কোনো লেনদেন নেই। তবুও মনে হয়, আমাদের আসন্ন বিপদের কথা ভেবেই এ গানটি তিনি গেয়েছেন।

ডেঙ্গুর অবস্থা ইতোমধ্যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সংবাদপত্রের সব পাতা, টিভি সংবাদের স্ক্রলে এখন ডেঙ্গুর খবর। এবার ডেঙ্গু অচেনা সুরতে। জ্বরে হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। কমে যাচ্ছে রক্তচাপ; কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; রোগী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, যা ডাক্তারি ভাষায় ডাকা হয় ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’ নামে। হাসপাতালের সূত্রগুলো বলছে, এই শক সিনড্রোমের কবজায় পড়ে মানুষ মরছে বেশি। এটিই এখন মৃত্যুর বড় কারণ। ডেঙ্গু জ্বর এখন আর আগের মতো মাথায় চড়ে বসছে না। বিরামহীন উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর দেখা যাচ্ছে না। এখন সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথার আলামতের ওপর ভর করেই ডেঙ্গু হাজির হচ্ছে।

২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা গত ১৮ জুলাই সর্বোচ্চ ১৩-তে পৌঁছেছে। যেখানে গত বছর জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ৯ জনের; এ বছর জুলাই মাসের তিন সপ্তাহ যেতে না যেতে মারা গেছেন ৮০ জন। এটি সরকারি হিসাব; হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর গণনা মাত্র।

পরিস্থিতির গভীরতা বুঝতে পেরে সরকারি চাকরিতে না থাকা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই জনস্বাস্থ্যের ‘ইমার্জেন্সি’ বা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে নির্ধারিত নীতি-কৌশলের আলোকে পরিকল্পনামাফিক এগোতে হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ রকম প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত এমন কিছু ঘটেনি যে, জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা দিতে হবে। কেতাব অনুযায়ী যখন কোনো একটা রোগে প্রতি এক লাখে গড়ে ১৫ জন বা তার বেশি মানুষ সংক্রমিত হয় এবং এ রকম পরিস্থিতি পরপর দুই সপ্তাহ বলবৎ থাকে, তখন একটা মহামারি বা এপিডেমিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নিষ্কলুষ তথ্যভান্ডার না থাকলে এসব হিসাব কষা বেশ কঠিন এবং বিতর্কিত হতে পারে। কাজেই ঘোষণার ঝামেলায় না জড়িয়ে নিজের কাপড় বাঁচিয়ে চলার আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ঘুরপাক খেতে থাকবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি।

নানান মিথ তৈরি হচ্ছে

পরিসংখ্যানের অপরিষ্কার হিসাব অনেক মিথ বা ভুল ধারণার সৃষ্টি করতে পারে; করছে। যেটা পরিস্থিতি অনুধাবন করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সহায়ক নাও হতে পারে। যেমন ১৯ জুলাই পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করলে মনে হবে, এবার নারীরা বেশি মারা যাচ্ছে। হাসপাতালগুলোর সূত্রে সরকারের তালিকা অনুযায়ী ১৮ জুলাই পর্যন্ত যে ১২৭ জন মারা যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তার ৭৩ জনই নারী। পুরুষ ৫৪ জন অর্থাৎ রোগী ভর্তির অনুপাতে পুরুষের চাইতে দ্বিগুণের বেশি নারী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, যা বেশ আশঙ্কাজনক। বাস্তবের ছবি অন্য রকম হতে পারে। পুরুষের তুলনায় কম নারী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। তাদের সংখ্যা পুরুষ রোগীর অর্ধেক (১৫ হাজার ১৪৪ জন পুরুষ এবং নারী ৮ হাজার ৮৫৬ জন)। ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে মৃতের আনুপাতিক হিসাব করলে দেখা যাবে পুরুষের মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ৩;৫ অথচ নারীর ক্ষেত্রে সেটা শূন্য দশমিক ৮২। অন্যভাবে বলা যায়, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া পুরুষ-নারীর মৃত্যুর অনুপাত ১ : ২ দশমিক ৩১। তবে কি পুরুষরা বেশি যত্ন-আত্তি, চিকিৎসা পাচ্ছে আর নারীরা হাসপাতালে অবহেলার শিকার? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো সংস্কার বা সামাজিক আচার কাজ করছে? হতে পারে, নারীদের হাসপাতালে আনাই হচ্ছে দেরি করে। একেবারে শেষ সময়ে। এই মুহূর্তে রোগীবান্ধব/নারীবান্ধব হাসপাতালের বিতর্কে না গিয়েও বিষয়টা আমাদের আমলে নিতে হবে। আক্রান্ত নারীরা যেন ঠিক সময় হাসপাতালে আসে, সেদিকে নজর দিতে হবে।

ঢাকার একটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভিড় -সমকাল
ডেঙ্গু্র ডিপো রোহিঙ্গা ক্যাম্প

এটাও একটা মিথ। রোহিঙ্গাদের আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য ঢাকার কন্ট্রোল রুম প্রকাশ করে না। তবে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন অফিসের সূত্র অনুযায়ী, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ঢাকার পরেই কক্সবাজারে বেশি। শরণার্থী শিবিরগুলোর ঘরে ঘরে ডেঙ্গু; মৃতের সংখ্যাও সেখানে বেশি। গত বছর কক্সবাজারে সর্বমোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১৭ হাজার ৩৯০ জন। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৩৫২ জনই ছিল রোহিঙ্গা। ওই বছরের প্রথম ছয় মাস স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কেউই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত না হলেও চলতি বছরের একই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৬৮ জন স্থানীয়। যদিও জুলাই মাসেই স্থানীয় জনগোষ্ঠী (১৫ জুলাই পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৪৯ জন। এ ছাড়া গত বছর ৩০ রোহিঙ্গা ও ৯ জন স্থানীয়সহ সর্বমোট ৩৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় কক্সবাজারে। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে চারজন। তাদের সবাই আবার রোহিঙ্গা বলে জানিয়েছে জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়।

শরণার্থী শিবিরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে ওষুধ দেওয়ার কোনো ফাঁকফোকর নেই। চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে জ্বরের রোগী এলেই পরীক্ষা করা হয়। সেখানেই ধরা পড়ে কার ডেঙ্গু আর কার সাধারণ জ্বর কিংবা অন্যকিছু। ক্যাম্পের বাইরের সমাজে সেই বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে প্রকৃত তথ্য অধরাই থেকে যাচ্ছে। কক্সবাজারে ডেঙ্গুর বাড়বাড়ন্তর আরেকটা বড় কারণ পর্যটকদের অবাধ চলাফেরা এবং বেশির ভাগ হোটেলের দুর্বল মশক ব্যবস্থাপনা।

ডেঙ্গু রোগীকে রক্ত দিতেই হবে?

রোগীর স্বজনদের মধ্যে রক্ত বা প্লাটিলেটের জন্য হা-হুতাশ করতে দেখা যায়। চিকিৎসকদের দিক থেকেও একটা চাপ থাকে বলে অনেকে জানিয়েছেন। দেশের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ এ বিষয়ে চিকিৎসকদের উদ্দেশে খুব সুন্দর করে বলেছেন, ‘রক্তের জন্য রক্ত, ডেঙ্গুর জন্য নয়।’ হিমোগ্লোবিনের লেভেল ভালো থাকলে, রক্তক্ষরণ না হলে রক্ত দেওয়ার দরকার নেই। যদি ব্লিডিং বেশি হয়, তাহলে ডাক্তার প্রয়োজন মনে করলে রক্ত দিতে পারেন। বিশেষ দুই-একটা কেসে প্লাটিলেট দেওয়ার দরকার হতে পারে। নিয়ম করে সবাইকে প্লাটিলেট দেওয়ার দরকার নেই। মানুষ যেন ভুল না বোঝে– ডেঙ্গু হলেই রক্ত বা প্লাটিলেট দিতে হবে।

ডেঙ্গু থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য সবাই একবাক্যে ‘জনসচেতনতা’ বাড়ানোর কথা বলে বলটা জনগণের কোর্টে ঠেলে দিয়ে দায়িত্ব এড়াতে চাইছেন বলে মনে হয়। মিথের বেড়াজাল ডিঙিয়ে সঠিক তথ্য তাকে দিতে হবে। মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন– ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মায়েরা কি সন্তানকে বুকের দুধ দিতে পারবেন? পেঁপের পাতায় প্লাটিলেটের ঘাটতি কি আসলেই দূর হয়? এবার কেন শিশু বেশি মারা যাচ্ছে ? ডেঙ্গু ‘সেরে’ যাওয়ার পর হঠাৎ রোগীর অবস্থা কেন খারাপ হয়ে যাচ্ছে? হার্টের অনেক রোগী ব্লাড থিনার, অ্যাসপিরিন খায়। তাদের ডেঙ্গু হলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে। সে ক্ষেত্রে হার্টের ওষুধ কি বন্ধ রাখতে হবে? ভ্যাকসিন নিয়ে চালু গুজব কি আসলেই গুজব? একই সঙ্গে কভিড ও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। করোনায় কিছু ওষুধ দেওয়া হয়, যেগুলো ডেঙ্গুতে দেওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে কী উপায় হবে? এ ছাড়াও অনেক প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে; সেগুলো জানতে হবে; জানাতে হবে সঠিক উত্তর। চিকিৎসা প্রটোকল তিন মাস পরপর তথ্যের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করে সবাইকে হালনাগাদ করতে হবে। এক কথায়, অনুমাননির্ভর নয়, মিথতাড়িত নয়, বিজ্ঞানভিত্তিক, সমাজমনস্ক ব্যবস্থার দিকে আমাদের তাকাতে হবে।

Leave a Reply