ডায়রিয়ায় যে ভুলগুলো বিপদ ডেকে আনছে শিশুর

পরিস্থিতি প্রতিবেদন-১৮ ১৪ জুন ২০২৩

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে ও পরে সারাদেশে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। চলতি বছর সময়ের আরো আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে শিশুরা। ডায়রিয়া চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা হলো স্যালাইন পানি খাওয়ানো। স্যালাইন হলো বিভিন্ন খনিজ উপাদানসমৃদ্ধ লবণ। স্যালাইন পানি ডায়রিয়া বন্ধ করে না, এটি ডায়রিয়ার ফলে শরীরে যে পানি ও লবণশূন্যতা হয়, তার ঘাটতি পূরণ করে। কিন্তু স্যালাইন পানি তৈরির সঠিক নিয়মাবলী না জানার কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুদের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে এমনকি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবসহ মৃত্যুও হচ্ছে।

একবছরের কমবয়সী শিশু রাজ, যখন তার হাঁটাচলার চেষ্টাই ছোটাছুটি করার কথা সেই সময় তার দিন কাটছে হাসপাতালের আইসিইউ বেডে, ডায়রিয়ায় হাজার শিশুর জীবন বাচাঁয় যে স্যালাইন সেই স্যালাইনের ভুল ব্যবহার রাজকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর মুখে, সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত তার মায়ের বক্তব্য মতে ১০০ মিলিতে ১টি স্যালাইন গ‍ুলিয়ে রাজকে ১২ টি স্যালাইন ৩ দিনে এভাবে খাওয়ানো হয়েছে একদিনে কয়টি খাওয়ানো হয়েছে তার সঠিক হিসাব রাজের মা জানাতে পারেনি। মা ধারণা করেছে, ‘বেশি যখন পায়খানা হচ্ছে তখন ঘন করে গোলা স্যালাইন পানি বেশি বেশি খাওয়ালে মনে হয় তার সন্তান তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে’।

স্যালাইন তৈরি ও ব্যবহারে ভুল
ডায়রিয়ার চিকিৎসায় রাজের মায়ের মত অনেক বাবা-মায়ের ছোট্ট একটি ভুল শিশুদের ঝুঁকিতে ফেলছে, কেউবা ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে।
• অনেকে অল্প পানিতে পুরো প্যাকেট বা অর্ধেক প্যাকেট স্যালাইন মিশ্রিত করেন। এটি ঠিক নয়। অবশ্যই আধা লিটার পানিতে পুরো প্যাকেট স্যালাইন মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করতে হবে।
• স্যালাইন পানি তৈরির পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে খাওয়া ভালো। আর ১২ ঘণ্টা পর গ্রহণ করা যাবে না।
• কোনোভাবেই স্যালাইন পানি গরম করা যাবে না।

ভুল পদ্ধতিতে স্যালাইন তৈরির ফলে কী কী সমস্যা হতে পারে
• আধা লিটার বিশুদ্ধ পানিতে পুরো এক প্যাকেট স্যালাইন মিশ্রিত করতে হবে। অল্প পানির মধ্যে প্যাকেটটি মিশ্রিত করলে যে খনিজ লবণ আছে, তার মাত্রা বেড়ে যায় বা মাত্রা ঠিক থাকে না। দ্রবণে খনিজ লবণ ও পানির মাত্রা ঠিক না থাকলে রক্তের ঘনত্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। ফলে কোষ থেকে বিশেষ করে মস্তিষ্ক থেকে পানি বের হয়ে কোষ নষ্ট হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
• আধা লিটার পানি না দিয়ে অল্প পানিতে তৈরি স্যালাইন পানি ঘনঘন খাওয়ানোর ফলে রক্তে লবণের মাত্রা বেড়ে হচ্ছে খিঁচুনি, এমনকি কিডনী বিকল হয়ে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটছে। ভাগ্যক্রমে অনেকে বেঁচে গেলেও নষ্ট হচ্ছে ব্রেনের কোষ, বাধাঁগ্রস্থ হচ্ছে বেড়ে উঠা, কেউ হারাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি, কেউ হচ্ছে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আজীবন।
• স্যালাইন তৈরির ১২ ঘণ্টার বেশি সময় পর ওই স্যালাইন ব্যবহার করলে সেখানে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়, যা ডায়রিয়াকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়।

সঠিক নিয়মে স্যালাইন পানি খাওয়ানোর নিয়ম
শরীরে পানি প্রতিস্থাপনের কাজটা তাড়াহুড়া করে করা যাবে না। ধীরে ধীরে করতে হবে। তাই স্যালাইন পানি একটু একটু করে চুমুক দিয়ে খেতে হবে।

• বয়স ২ বছরের কম হলে–
শিশুকে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পরে একটা বড়ো কাপের (২৫০ মিলি) অর্ধেক বা সোয়া পরিমাণ খাওয়াতে হবে। চামচ অনুযায়ী হিসাব করলে ১০ থেকে ২০ চা চামচ।

• ২ থেকে ১০ বছর বয়সি শিশু–
প্রতিবার পাতলা পায়খানার পরে বড় কাপের (২৫০ মিলি) পুরোটা অথবা কমপক্ষে অর্ধেক খাওয়াতে হবে।

• ১০ বছরের বেশি বয়স–
প্রতিবার পাতলা পায়খানার পরে কমপক্ষে বড় কাপের (২৫০ মিলি) পুরোটা বা ২ কাপ অর্থাৎ তৈরি স্যালাইন পানির পুরোটা খেতে হবে।

  • স্যালাইন খাওয়ানোর পরে শিশু বমি করলে ১০ মিনিট অপেক্ষা করে আবার স্যালাইন পানি দিতে হবে। সাধারণত বমি এমনিতেই থেমে যাবে। একটু একটু করে খাওয়াতে হবে। তাড়াহুড়ো করা যাবে না, বমি হলেও শরীর ঠিকই একটু না একটু পানি এবং লবণ শোষণ করে নেবে।
  • স্যালাইন পানি খাওয়ানোর পাশাপাশি তরল জাতীয় অন্যান্য খাবারও খাওয়াতে হবে। যেমন স্যুপ, বা বাড়িতে তৈরি তাজা ফলের রস, ডাবের পানি, ভাতের মাড়। স্যালাইন পানি খাওয়ানোর সময় বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা যাবে না। শিশু যদি ৬ মাসের বেশি বয়সি হয়, তাহলে অর্ধ তরল বা শক্ত খাবারও দেওয়া উচিত।
  • পানিশূন্যতার কারণে রোগী অচেতন হয়ে পড়লে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে। তবে যদি কোনো কারণে ঐ মুহূর্তে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব না হয়, বা অ্যাম্বুলেন্স আসার আগ পর্যন্ত ৫ মিনিট পরপর তার ঠোঁটে একটু একটু করে স্যালাইন পানি দিতে থাকতে হবে, যতক্ষণ না প্রস্রাবের পরিমাণ ঠিক হয়।
  • ডায়রিয়া যতদিন পুরোপুরি না সারে তার আগ পর্যন্ত স্যালাইন পানি ও অন্যান্য তরল খাবার চালিয়ে পরিমাণে যেতে হবে।
  • স্যালাইন পানি সঠিক নিয়মে না খাওয়ালে জটিলতা আরও বাড়তে পারে। তাই এই ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত সবার।

তথ্যসূত্র:
https://corona.gov.bd/rules-of-feeding-saline-in-diarrhea/
https://rehydrate.org/solutions/homemade.htm
The Mother and Child Health and Education Trust
Rehydration Project, TST P O Box 97098, Kowloon, Hong Kong

ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

1 thought on “ডায়রিয়ায় যে ভুলগুলো বিপদ ডেকে আনছে শিশুর”

  1. Pingback: ডেঙ্গুতে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রের্কড, নারী মৃত্যুহার বেশি – Disaster Forum

Leave a Reply