ডায়রিয়া নিয়ে দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২৩)
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে ও পরে সারাদেশে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। চলতি বছর সময়ের আরও আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) সূত্রে জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ সংখ্যক রোগী সেখানে আসছে প্রতিদিন। বর্তমানে দিনে গড়ে ৫৫০ থেকে ৬০০ ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গরমের সময় ছাড়া অন্য সময়ে রোগীদের এই সংখ্যা ৩০০ থেকে ৩৫০ জনের মধ্যে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
ঢাকার বাইরে থেকেও ক্রমেই ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার খবর আসছে। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নারী, পুরুষ ও শিশুসহ আক্রান্ত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় আছে আরও অর্ধশতাধিক মানুষ। গত ৭ জুন বুধবার সকাল ও দুপুরে সাজেক ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডের দুর্গম লংথিয়ানপাড়া এলাকায় ডায়রিয়ায় এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সাজেকের কংলাকপাড়া থেকে হেঁটে লংথিয়ানপাড়া পৌঁছতে একদিন লাগে যায়। এলাকার আশপাশে কোনো হাসপাতাল বা কমিউনিটি ক্লিনিক না থাকায় রোগীরা স্থানীয় তান্ত্রিক দিয়ে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এলাকায় যাতায়াতের কোনো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় হেঁটে এতদূর থেকে মাচালং ও উপজেলা সদর হাসপাতালে রোগী পাঠানো সম্ভব নয়। ২০১৬ সালে এখানে ডায়রিয়ায় ছয়জনের মৃত্যু হয়েছিল। পরে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে মেডিক্যাল টিমের এক মাসের চিকিৎসায় ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে আসে। এবারও দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে রোগী ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে স্থানীয়রা আশঙ্কা করছে। প্রাথমিকভাবে পাশের বিজিবি বিওপি থেকেও স্যালাইন সরবরাহ করা হয়েছে। তবে তা খুবই সীমিত। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওষুধ, স্যালাইন ও বিশুদ্ধ পানি আর শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে। পরে ৮ জুন দুপুরে একটি হেলিকপ্টার করে শিয়ালদাইলুই পর্যন্ত আরও চিকিৎসা সামগ্রী পাঠানো হলে সেখান থেকে আরও একটি টিম প্রায় ৩ ঘণ্টা হেঁটে ঘটনাস্থলে সামগ্রীগুলো পৌঁছানোর পর চিকিৎসাসেবা আরও জোরদার হয় এবং মেডিক্যাল টিমদ্বয়ের আন্তরিক চিকিৎসাসেবায় আশঙ্কাজনক অনেক মুমূর্ষু রোগী মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পায়। অন্য রোগীরাও বর্তমানে সুস্থতার পথে।
ডায়রিয়ার আরেকটি হটস্পট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে যশোর। ডায়রিয়ার মারাত্মক বিস্তারের পরিস্থিতিতে জাতীয় রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) রোগতত্ত্ব গবেষণা দল গত ৩০ মে দ্বিতীয়বারের মতো যশোরের উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন সম্পন্ন করেছে। প্রথম পরিদর্শনের গোপনীয় প্রতিবেদনে কলেরার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছিল। ডায়রিয়াজনিত অসুস্থতার রোগী বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাসের অনুরোধে আইইডিসিআর-এর গবেষণা দল দ্বিতীয়বার এই অঞ্চল পরিদর্শন করেন। দ্বিতীয় দফার গবেষণায় শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের যেসব এলাকায় রোগী বেশি, সেসব এলাকা বেশি পরিদর্শন করেন। এতে তারা নিশ্চিত হয়েছেন, ‘পয়েন্ট সোর্স’ অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটি উৎস থেকেই জীবাণুর বিস্তার ঘটেনি। বরং ‘মাল্টিপোল সোর্সে বা একাধিক উৎস’ জীবাণুর অস্তিত্ব রয়েছে। এমনকি গ্রামের সাবমার্সিবল টিউবওয়েলের পানিতেও জীবাণু পাওয়া গেছে। প্রথমবারের গবেষণায় শহরের সাবমার্সিবল টিউবওয়েলেও কলেরার জীবাণু শনাক্ত হয়েছিল। এবারের গবেষণায় পানির পাশাপাশি অন্যান্য খাবার থেকেও জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
কলেরার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বছরে বিশ্বব্যাপী ১৩ থেকে ৪০ লাখ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়। যাদের মধ্যে ২১ হাজার থেকে দেড় লাখের মৃত্যু হয়। কলেরা ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। যশোরের পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের সঙ্গে জড়িত দপ্তরগুলো অবশ্য তাদের গাফিলতির কথা মানতে রাজি নন। যশোরের জেলা প্রশাসক জানান, পানির লাইন স্যুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে মিশে গেছে, এটা অনুমাননির্ভর। গরমের সময় ডায়রিয়া বাড়ে। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে মানুষ কিছুটা উদাসীন বলেই এমনটা হয়। আমাদের জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় এসব নিয়ে আলোচনা করেছি। আর যশোর পৌরসভার মেয়র বলেন, ‘আমাদের বলা হচ্ছে পানির লাইনের সমস্যার কারণে কলেরা-ডায়রিয়া হচ্ছে। কিন্তু কোথায় হচ্ছে আমাদের দেখাক। আমরা তো খুঁজে পাচ্ছি না। তবে পানিতে আয়রন ও আর্সেনিক আছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব পরিষ্কার করতে ব্লিচিং ওয়াশ চলছে।’
আইইডিসিআর-এর রোগতত্ত্ব গবেষণা দল সাবমার্সিবল টিউবওয়েলের জীবাণুমুক্ততা ও মান নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সেটা আমলে না নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সেখানে আরও ১৫টি সাবমার্সিবল টিউবওয়েল বসানো হচ্ছে। তবে যশোর পৌরসভার উপসহকারী প্রকৌশলী সংবাদ মাধ্যমের কাছে নিশ্চিত করেছেন যে, তারা পানির লাইনে ৪২টি লিকেজ পেয়েছেন, যেসব লিকেজ দিয়ে জীবাণুর বিস্তার ঘটা সম্ভব। এসব লিকেজ মেরামতসহ আরও লিকেজ খুঁজে বের করার কাজটি চলমান রয়েছে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়েছে, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত (জুন ৭) জেলায় সাড়ে আট হাজার ডায়রিয়া রোগী পাওয়া গেলেও গত মাসে (মে মাস) রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ছিল। প্রায় পাঁচ হাজার রোগী পাওয়া যায় ওই মাসে। বিশেষ করে জেলার বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, চন্দনাইশ ও সদরে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। জেলার রোগীদের মলের ৩০টি নমুনা পরীক্ষা করে তার মধ্যে ছয়টিতে ভিব্রিও কলেরি পাওয়া গেছে।
সে যাই হোক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডায়রিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘আউটব্রেক’ বলে মনে করছে না। পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ)-এর মতে, ‘নিরাপদ পানির অভাবে দেশের কোথাও কোথাও ডায়রিয়া দেখা গেছে। তবে আউটব্রেক হয়নি। প্রচ- তাপপ্রবাহ ও বৃষ্টি না হওয়ার কারণে নিরাপদ পানির সংকটে এমনটি হয়েছে। যেসব এলাকায় ডায়রিয়ার রোগী পাওয়া যাচ্ছে সেসব এলাকায় বিশেষ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’
ডায়রিয়া / কলেরা চিকিৎসায় ওআরএস বা ওরাল রিহাইড্রেশন সল্টের ভুল ব্যবহার নিয়ে নতুন উদ্বেগ : এক বছরের কমবয়সী শিশু রাজ, যখন তার হাঁটাচলার চেষ্টায় ছোটাছুটি করার কথা সেই সময় তার দিন কাটছে হাসপাতালের আইসিইউ বেডে, ডায়রিয়ায় হাজার শিশুর জীবন বাঁচায় যে স্যালাইন সেই স্যালাইনের ভুল ব্যবহার রাজকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর মুখে, সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত তার মায়ের বক্তব্যমতে, ১০০ মিলিতে ১টি স্যালাইন গুলিয়ে রাজকে ১২টি স্যালাইন ৩ দিনে এভাবে খাওয়ানো হয়েছে, একদিনে কয়টি খাওয়ানো হয়েছে তার সঠিক হিসাব রাজের মা জানাতে পারেনি। মা ধারণা করেছে, ‘বেশি যখন পায়খানা হচ্ছে তখন ঘন করে গোলা স্যালাইন পানি বেশি বেশি খাওয়ালে মনে হয় তার সন্তান তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।’
স্যালাইন তৈরি ও ব্যবহারে ভুল : ডায়রিয়ার চিকিৎসায় রাজের মায়ের মতো অনেক বাবা-মায়ের ছোট্ট একটি ভুল শিশুদের ঝুঁকিতে ফেলছে, কেউ বা ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে।
- অনেকে অল্প পানিতে পুরো প্যাকেট বা অর্ধেক প্যাকেট স্যালাইন মিশ্রিত করেন। এটি ঠিক নয়। অবশ্যই আধা লিটার পানিতে পুরো প্যাকেট স্যালাইন মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করতে হবে।
- স্যালাইন পানি তৈরির পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে খাওয়া ভালো। আর ১২ ঘণ্টা পর গ্রহণ করা যাবে না।
- কোনোভাবেই স্যালাইন পানি গরম করা যাবে না।
ভুল পদ্ধতিতে স্যালাইন তৈরির ফলে কী কী সমস্যা হতে পারে :
- আধা লিটার বিশুদ্ধ পানিতে পুরো এক প্যাকেট স্যালাইন মিশ্রিত করতে হবে। অল্প পানির মধ্যে প্যাকেটটি মিশ্রিত করলে যে খনিজ লবণ আছে, তার মাত্রা বেড়ে যায় বা মাত্রা ঠিক থাকে না। দ্রবণে খনিজ লবণ ও পানির মাত্রা ঠিক না থাকলে রক্তের ঘনত্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। ফলে কোষ থেকে বিশেষ করে মস্তিষ্ক থেকে পানি বের হয়ে কোষ নষ্ট হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
- আধা লিটার পানি না দিয়ে অল্প পানিতে তৈরি স্যালাইন পানি ঘন ঘন খাওয়ানোর ফলে রক্তে লবণের মাত্রা বেড়ে হচ্ছে খিঁচুনি, এমনকি কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। ভাগ্যক্রমে অনেকে বেঁচে গেলেও নষ্ট হচ্ছে ব্রেনের কোষ, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বেড়ে ওঠা, কেউ হারাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি, কেউ হচ্ছে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আজীবন।
- স্যালাইন তৈরির ১২ ঘণ্টার বেশি সময় পর ওই স্যালাইন ব্যবহার করলে সেখানে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়, যা ডায়রিয়াকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়।
সঠিক নিয়মে স্যালাইন পানি খাওয়ানোর নিয়ম : শরীরে পানি প্রতিস্থাপনের কাজটা তাড়াহুড়া করে করা যাবে না। ধীরে ধীরে করতে হবে। তাই স্যালাইন পানি একটু একটু করে চুমুক দিয়ে খেতে হবে।
- বয়স ২ বছরের কম হলে
শিশুকে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পরে একটা বড় কাপের (২৫০ মিলি) অর্ধেক বা সোয়া পরিমাণ খাওয়াতে হবে। চামচ অনুযায়ী হিসাব করলে ১০ থেকে ২০ চা চামচ।
- ২ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশু
প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর বড় কাপের (২৫০ মিলি) পুরোটা অথবা কমপক্ষে অর্ধেক খাওয়াতে হবে।
- ১০ বছরের বেশি বয়স
প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর কমপক্ষে বড় কাপের (২৫০ মিলি) পুরোটা বা ২ কাপ অর্থাৎ তৈরি স্যালাইন পানির পুরোটা খেতে হবে।
- স্যালাইন খাওয়ানোর পরে শিশু বমি করলে ১০ মিনিট অপেক্ষা করে আবার স্যালাইন পানি দিতে হবে। সাধারণত বমি এমনিতেই থেমে যাবে। একটু একটু করে খাওয়াতে হবে। তাড়াহুড়ো করা যাবে না, বমি হলেও শরীর ঠিকই একটু না একটু পানি এবং লবণ শোষণ করে নেবে।
- স্যালাইন পানি খাওয়ানোর পাশাপাশি তরলজাতীয় অন্যান্য খাবারও খাওয়াতে হবে। যেমন স্যুপ বা বাড়িতে তৈরি তাজা ফলের রস, ডাবের পানি, ভাতের মাড়। স্যালাইন পানি খাওয়ানোর সময় বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা যাবে না। শিশু যদি ৬ মাসের বেশি বয়সী হয়, তা হলে অর্ধতরল বা শক্ত খাবারও দেওয়া উচিত।
- পানিশূন্যতার কারণে রোগী অচেতন হয়ে পড়লে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে। তবে যদি কোনো কারণে ওই মুহূর্তে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব না হয় বা অ্যাম্বুলেন্স আসার আগ পর্যন্ত ৫ মিনিট পরপর তার ঠোঁটে একটু একটু করে স্যালাইন পানি দিতে থাকতে হবে, যতক্ষণ না প্রস্রাবের পরিমাণ ঠিক হয়।
- ডায়রিয়া যতদিন পুরোপুরি না সারে তার আগ পর্যন্ত স্যালাইন পানি ও অন্যান্য তরল খাবার চালিয়ে পরিমাণে যেতে হবে।
- স্যালাইন পানি সঠিক নিয়মে না খাওয়ালে জটিলতা আরও বাড়তে পারে। তাই এই ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত সবার।