ডেঙ্গু সতর্কতা

ছবি: সংগ্রহ

জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। এডিস মশা ডেঙ্গু ছড়ায়। এডিস মশা সাধারণত ডিম পাড়ে স্বচ্ছ পানিতে। তাই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে বাড়ি বা আঙ্গিনার কোথাও যেন পানি তিন থেকে পাঁচদিনের বেশি জমা না থাকে। সাধারণত বাসার ভেতরে এবং আশেপাশে পাশের ময়লার স্তূপের পাশে জমা পানি থেকেই এডিস মশার বিস্তার ঘটছে। কোনো কোনো বাসা হয়ত অনেকদিন ধরে খালি পড়ে আছে, সেখান থেকে এডিস মশার বিস্তার ঘটার সম্ভাবনা আছে। এছাড়া বেশিরভাগ বাড়িতে দেখা যায় ছাদের সাথে লাগোয়া সিঁড়িঘরে নানান জঞ্জালের স্তুপ থাকে, বছরের পর বছর পরিষ্কার করা হয় না। সেখান থেকেও এডিস মশার বিস্তার ঘটতে পারে। এ সময় ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে সচেতন হতে হবে সবাইকে। বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার রাখা এখন অত্যন্ত জরুরি। ডেঙ্গু রোগ হওয়া থেকে বাঁচাতে এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যেন মশা না কামড়ায় বিশেষ করে শিশুদের।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে যা করা প্রয়োজন

  • প্রথমেই এডিস মশার উৎসস্থান ধ্বংস করতে হবে। এডিস মশা সাধারণত গৃহস্থালির পরিষ্কার স্থির পানি যেমন ফুলের টব, গাড়ির টায়ার বা ডাবের খোলে বৃষ্টির জমা পানি ইত্যাদি জায়গায় থাকে। তাই এডিস মশার লার্ভা জন্ম নিতে পারে এমন স্থানগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে। বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
  • দই বা যেকোনো খাবারের কৌটা বাইরে ফেলবেন না। এসব পাত্রেও পানি জমে থাকতে পারে।
  • অনলাইনে খাবার বা অন্য কোনও কিছু আনলে, সেই পাত্র বা প্যাকেটটি ছিদ্র করে বা ভেঙ্গে যথাযথ জায়গায় ফেলে দিন।
  • বাথরুমে যদি পানি ধরে রাখতে হয় তাহলে পানির পাত্র সপ্তাহে অন্তত একবার ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ভালো করে ধুয়ে আবার পানি ভর্তি করুন।
  • শিশুদের দিনে ও রাতে মশারির ভেতরে রাখতে হবে। বিশেষ করে নবজাতক শিশুকে সার্বক্ষণিক মশারির ভেতরে রাখা জরুরি। কেননা ডেঙ্গু আক্রান্ত কাউকে এডিস মশা কামড়ানোর পর যদি কোন শিশুকে কামড়ায় তাহলে তার শরীরেও ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়িয়েপড়তে পারে। হাসপাতালে কোন শিশু যদি অন্য রোগের চিকিৎসাও নিতে আসে, তাহলে তাকেও মশারির ভেতরে রাখতে হবে।
  • শিশুদের শরীরে কয়েক ঘণ্টা অন্তর অন্তর মসকুইটো রেপেলেন্ট অর্থাৎ মশা নিরোধীকরণ স্প্রে, ক্রিম বা জেল ব্যবহার করা যেতে পারে। শিশুদের এমন পোশাক পড়াতে হবে যাতে করে হাত ও পা সম্পূর্ণ ঢাকা থাকে।
  • মশা প্রতিরোধক অ্যারোসল, মশার কয়েল বা ফাস্ট কার্ড শিশু থেকে শুরু করে সবার জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। এর পরিবর্তে মসকুইটো কিলার বাল্ব, ইলেকট্রিক কিলার ল্যাম্প, ইলেকট্রিক কয়েল, মসকুইটো কিলার ব্যাট, মসকুইটো রেপেলার মেশিন, মসকুইটো কিলার ট্র্যাপ ইত্যাদির সাহায্যে নিরাপদে মশা ঠেকানো যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে এই সরঞ্জামগুলো যেন শিশুর নাগালের বাইরে থাকে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
  • যদি শিশুর মা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হন, তাহলে সেই ভাইরাসের কোন প্রভাব মায়ের বুকেরদুধে পড়ে না। কাজেই আক্রান্ত অবস্থায় মা তার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও করণীয়

১. সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর।

১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর আবারো জ্বর আসতে পারে। এর সাথে শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথাএবং চামড়ায় লালচে দাগ (র‍্যাশ) হতে পারে। তবে এগুলো না থাকলেও  ডেঙ্গু হতে পারে।

২. জ্বর হলেই কি চিন্তিত হবেন?

ডেঙ্গুর সময়ে জ্বর হলেই সচেতন থাকতে হবে। কোন ভাবেই এই সময় জ্বরকে অবহেলা করা উচিত নয়।

৩. বিশ্রামে থাকতে হবে

জ্বর হলে বিশ্রামে থাকতে হবে। একজন ব্যক্তি সাধারণত প্রতিদিন যেসব পরিশ্রমের কাজ করে, সেগুলো না করে পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকা ভাল।

৪. খাবার

প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন – ডাবের পানি, লেবুর শরবত, তাজা ফলের রস এবং খাবার স্যালাইন গ্রহণ করা যেতে পারে। এমন নয় যে প্রচুর পরিমাণে শুধু পানিই খেতে হবে, তরল খাবার খেলেও  চলবে । 

৫. যেসব ওষুধ খাওয়া উচিত নয়

চিকিৎসকরা বলেন ‘ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ চারটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে। কিন্তু কারো যদি লিভার, হার্ট এবং কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।

৬. প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা 

সাধারণত একজন মানুষের রক্তে প্লাটিলেট কাউন্ট থাকে দেড়-লাখ থেকে সাড়ে চার-লাখ পর্যন্ত।

৭. ডেঙ্গু হলেই কি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়?

অনেক সময় দেখা যায়, দুইদিন জ্বরের পরে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে পেটে ব্যথা হতে পারে, প্রচুর বমি হতে পারে, নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে এবং রোগী কিছুই খেতে পারেনা এসব ক্ষেত্রে হাসপাতাল ভর্তি হওয়াই ভালো।

শিশুর ডেঙ্গু হলে করণীয়

শিশুর ডেঙ্গু হলে তাকে বিশ্রামে রাখুন, প্রচুর পানি বা তরল খেতে দিন। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল সিরাপ বা বড়ি ৪ থেকে ৬ ঘন্টা পরপর খেতে দিন। ডেঙ্গুতে ২-৩ দিন পর যখন জ্বর কমে যায়, তখনই জটিলতা দেখা দেওয়ার সময়। এ সময় প্রতিদিন রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার পরিমাণ দেখা উচিত। অণুচক্রিকার সংখ্যা কমতে থাকলে, শিশু বারবার বমি করলে, খেতে না পারলে, পেতে ব্যথা হলে, শিশুর মধ্যে অতি অস্থিরতা বা নিস্তেজ ভাব দেখা দিলে, মুখ-দাঁত–নাক দিয়ে রক্তপাত হলে কিংবা কালো পায়খানা অথবা কালো রক্তবমি কিংবা রক্তের মত প্রস্রাব করলে অবশ্যই হাসপাতালে নিন। মুখ-চোখ ফ্যাকাশে মনে হলে, হাত-পা অতিরিক্ত ঠান্ডা মনে হলে, ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব না করলে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। জ্বর ভালো হওয়ার পরও কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে, তাই সতর্ক থাকতে হবে।

কিছু  লক্ষণ  থাকলে যেমন নাক দিয়ে রক্ত পড়া, কালো পায়খানা হওয়া রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। গুরুতর ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে নারীদের মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তচাপ কিংবা হঠাৎ করে মাসিক হতে পারে।

Leave a Reply