‘প্রতিবন্ধী শিশু’ নিয়ে আমাদের সময় পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩)
আগে আমাদের লেখা সাহিত্য ছিল পদ্যের ছন্দে। পুঁথি পড়তে হতো সুর করে। মহরম মাসে দহলিজ ঘর বা খানকাঘর অথবা গরমের দিনে খোলা বটগাছের নিচে আশুরার যে বর্ণনা হতো, সেটিও ছিল নিরেট পদ্য। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরওই কলেজের লেখকরা নতুন করে গড়ে তোলেন বাংলা গদ্য। এ গদ্য বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার পথকে অনেকখানি পরিষ্কার করেছে। মুদ্রণযন্ত্র অর্থাৎ ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিশেষ সাহায্য করেছে। ফলে সাহিত্যে আসে নতুন বৈচিত্র্য। এ সময় গদ্যসাহিত্য সৃষ্টি করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)। প্রথম উপন্যাস রচনা করেন প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩)। ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপে ভরা মজার কাহিনি লেখেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। মীর মশাররফ লেখেন বিষাদ সিন্ধু (১৮৮৫, ১৮৮৭ ও ১৮৯১ সালে তিন ভাগে প্রকাশিত হয়। পরে এগুলো এক খ-ে মুদ্রিত হয় ১৮৯১সালে)। মীর মশাররফের এই গদ্যও ধার্মিক আনপড় (পড়তে না পারা) মানুষের সামনে পড়ার সময় দুলতে দুলতে পদ্য পাঠের ঢঙে পড়তেন পাঠক। এতে নাকি ধর্মীয় ভাবটা চাঙ্গা হয়, মানুষের মনে শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। হয়তো করে, হয়তো করে না। কিন্তু ‘করে’-এর পক্ষে বিশ্বাসটি বেশ আঠালো। তাই যে কোনো দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়টি বাংলায় সাজাতে গেলে অন্তঃমিলমূলক পদ্যের ছন্দ আমরা আগে খুঁজি। বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসের প্রতিপাদ্য নিয়ে সেটিই আবার হয়েছে। ইংরাজিতে প্রতিপাদ্য ছিল United in action to rescue and achieve the SDGs for, with and by persons with disabilities। পদ্যের ছন্দে সেটি বাংলা করতে গিয়ে হয়েছে- ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে সম্মিলত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে এসডিজি অর্জন।’
ছন্দ কতটা অর্জিত হয়েছে, সেটি ছন্দরসিকরা বুঝবেন। কিন্তু ছন্দের সঙ্গে আপস করতে গিয়ে প্রতিপাদ্যের মূল তারটিই যে ছিঁড়ে গেছে, সেটি বলবেন কে? টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো উদ্ধার ও অর্জনের কথা আর প্রতিন্ধীদের শুধু সঙ্গে (with) নিলে চলবে না, তাদের দ্বারা (by)- এসব উদ্ধার এবং অর্জনে যে তাগিদ দেওয়া হয়েছে, সেটিও লাপাত্তা ছন্দের ভিড়ে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস (IDPD) পালিত হয়। জাতিসংঘের ৪৭/৩ নম্বর সিদ্ধান্তের লক্ষ্য ছিল- আমাদের অলক্ষ্যে থাকা প্রতিবন্ধীদের অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সামনে নিয়ে আসা। তারা যাতে অন্যদের সঙ্গে সমাজে সম্পূর্ণ সমান ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, সেটির পরিবেশ তৈরি করা। প্রতিবন্ধীরা যাতে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই কোনো বাধার সম্মুখীন না হয়, সেটি নিশ্চিত করা। এবারের ঘোষিত প্রতিপাদ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দই হচ্ছে উদ্ধার বা রেসকিউ- যেটি আমরা অনুবাদ করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছি বা গুম করে রেখেছি।
উদ্ধারের কথা উঠছে কেন?
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে কথা আর কাজে মিলের চেয়ে গরমিলই বেশি। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে করা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে দেশের সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী পরিবেশ এবং ন্যায্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছিল। এখন ২০২৩ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, র্যাম্প ছাড়া স্কুলগুলোয় আর কিছুই দৃশ্যমান ব্যবস্থা হিসেবে বলবৎ হয়নি; এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাধারণ স্কুলগুলোয় ভর্তিই নেওয়া হয় না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ভর্তি করা গেলেও টেকানো কঠিন। পাঠদান ও সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের অবহেলার চোখেই দেখা হয়। ফলে নিঃসঙ্গ এক বৈরী পরিবেশে তারা টিকে থাকতে পারে না।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় ২০১৩ সালে নতুন আইন করা হয়। তাদের বিষয়ে একাধিক নীতিমালাও রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন- আইন ও নীতিমালা কাগজেই আটকে আছে, বাস্তবায়ন কম। প্রতিবন্ধীদের একটি বিশাল অংশ সমাজসেবার স্কুলে পড়লেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের দিন শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনই পরীক্ষা দিতে হয়। শিক্ষানীতিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার কথা বলা হলেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। শিক্ষা অধিকার। কিন্তু এখনো দেশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিষয়টি কল্যাণের দৃষ্টিতে দেখা হয়, অধিকারের আলোকে নয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ছিল ২৯ লাখ ৩৯ হাজার ৯৯১। ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৬০৪ জনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। অর্থাৎ সবাইকে নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। কেন হয়নি? নিবন্ধনের যে জটিল ও অমানবিক প্রক্রিয়া, সেটি নিয়ে কি কেউ কথা বলেন?
২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা হয়েছে। অটিজম, শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, বাক, বুদ্ধি, শ্রবণ, শ্রবণ-দৃষ্টি, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা ও অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা। বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতার ক্ষেত্রে অনেকের পক্ষে স্বশরীরে প্রতিবন্ধিতার মাত্রা মাপার পরীক্ষায় হাজির হওয়া কঠিন। তাদের জন্য আলাদা কোনো বিধান নেই।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের (সিআরসি) ২৩ ধারা অনুযায়ী অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর মতো প্রতিবন্ধী শিশুরাও সমঅধিকার ও সমসুযোগ পাওয়ার অধিকারী। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে (২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর) সিআরডিপি বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক সনদ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সনদটি ২০০৮ সালের ৩ মে থেকে কার্যকর হয়। সিআরসি এবং সিআরপিডি সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশু যেন কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই তাদের অধিকার ভোগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করবে। এ দুটি সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। আইন বা সনদে যাই থাক, এটি আমাদের মানতেই হবে- প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক। বলা হয়ে থাকে, প্রতিবন্ধীদের দিয়ে কিছুই হবে না- এই ভেবে তাদের বাতিলের খাতায় ফেলে রাখা হয়।
নীলফামারীর বানু আকতারের কথা পাঠকদের মনে থাকার কথা। নীলফামারীর এক গ্রামের দরিদ্র পরিবারে দুটি হাত ছাড়া জন্ম হয়েছিল বানু আকতারের। পাড়া-প্রতিবেশী দেখতে এসে তার বাবা মাকে বলত, ‘এমন সন্তান সংসারে না রেখে মেরে ফেলো।’ এমন সন্তান জন্ম দেওয়ার পর ভয়ে বানু আকতারের মুখে দুধ তুলে দেননি তার মা। মা-বাবার প্রথম সন্তান। তাও পঙ্গু এবং মেয়ে- এ নিয়ে মা-বাবার হতাশার কমতি ছিল না। ফলে ছোটবেলায় হাঁটা শেখানো হয়নি তাকে। নিজে নিজে হাঁটতে শিখতে বানুর ১০ বছর লেগে যায়। সেই বানু সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় এখন পা দিয়েই পুঁতির মালা, পুতুল শো পিস তৈরি করে বিক্রি করেন। নিজের খরচ নিজে চালান। বানুর পা দিয়ে বানানো পুঁতির শোপিস ও ব্যাগ বিক্রি হয় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। এক একটি ব্যাগ বানাতে সময় লাগে ২-৩ দিন। প্রতিটি ব্যাগে তার ৫০-৬০ টাকা লাভ হয়। এসবের পরও প্রতিবন্ধী হওয়ায় ক্রমাগত পারিবারিক ও সামাজিকভাবে অবহেলার শিকার হয়ে চলেছেন বানু। বর্তমানে জীবন চালিয়ে নিতে পারলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে তার চিন্তা হয়। প্রতিবন্ধী বৈরী সমাজে তিনি প্রবীণ বয়সে বাঁচবেন কেমন করে?
নানা সময়ে করা আমাদের অঙ্গীকারগুলোর হাল অবস্থা দেখলেই বোঝা যাবে উদ্ধার কতটা জরুরি হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউনিসেফ) তার বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি ২০১৩-এর প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নে কয়েকটি সুপারিশ করেছিল। নীতিগতভাবে আমরা ওই সময় সব সুপারিশই মেনে নিয়েছিলাম-
১। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সনদ ও শিশু অধিকার সনদ অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
২। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। সাধারণ মানুষ, নীতিনির্ধারক এবং শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সুরক্ষার মতো জরুরি সেবা যারা দিয়ে থাকেন- তাদের মধ্যে প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৩। ইন্ট্রিগ্রেশন বা একীভূতকরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে- যেন পরিবেশ শিশুবান্ধব হয়। যেমন- বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যসেবা, জনপরিবহন ক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতা সহজ হয় এবং প্রতিবন্ধী শিশুরা যেন তাদের সহপাঠী বা সমবয়সীদের মতো অংশগ্রহণে উৎসাহিত হয়।
৪। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য পরিবারভিত্তিক সেবা ও কমিউনিটিভিত্তিক পুনর্বাসনের বিস্তার ঘটাতে হবে এবং এসব ক্ষেত্রে সহায়তা ত্বরান্বিত করতে হবে।
৫। পরিবারগুলোকে সহায়তা দিতে হবে- যেন তারা প্রতিবন্ধী শিশুদের জীবনযাপনের জন্য যে বাড়তি খরচ হয়, তা মেটাতে পারেন।
৬। প্রতিবন্ধী শিশু ও তাদের পরিবারের চাহিদা পূরণের জন্য যেসব সহায়তা এবং সেবার পরিকল্পনা করা হয়, এগুলো মূল্যায়নে প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোর-কিশোরীসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে এর বর্তমান মান বৃদ্ধি করতে হবে।
৭। সব খাতের সেবাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে- যেন প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোর-কিশোরী এবং তাদের পরিবার যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, এগুলোকে পূর্ণমাত্রায় মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।
৮। প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জীবনকে প্রভাবিত করে- এমন সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধী শিশু, কিশোর-কিশোরীকে শুধু সুবিধাভোগী হিসেবে নয়; বরং পরিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৯। প্রতিবন্ধিত্ব বিষয়ে একটি বৈশ্বিক সামঞ্জস্যপূর্ণ গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। এর মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য এবং তুলনামূলক উপাত্ত পাওয়া যাবে- যা পরিকল্পনা ও সম্পদ বণ্টন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেবে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী শিশুদের বিষয় আরও সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করবে।
একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই স্পষ্ট হবে- এর অনেক কিছু কেবলই কথার কথা। এখনো বাস, রেলগাড়ি, ব্রিজে প্রতিবন্ধীরা উঠতে পারেন না সহজে। জীবনের বাস, রেলগাড়ি, সেতুও তাদের থেকে দূরেই থেকে যাচ্ছে।