পরিস্থিতি প্রতিবেদন-১৭ ১৩ জুন ২০২৩
বর্তমান পরিস্থিতি: অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেশ আশংকাজনক। গত পাঁচ মাসে প্রায় প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং প্রত্যেক মাসে কমপক্ষে ২ থেকে ৬ মারা গিয়েছে। জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি ছিল এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল তুলনামূলকভাবে কমলেও মে মাস থেকে আবার দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। চলতি বছর (২০২৩) এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩ হাজার ৩৯০ জন রোগী, এর মধ্যে ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ২৫৬২ এবং ঢাকা বাইরে ৮২৮ জন। জুনের প্রথম ১২ দিনেই আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৩৬৮ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মারা গেছে ২৬ জন, এর মধ্যে গত ১২ দিনে মারা গিয়েছে ১৩ জন। (সূত্র: ১২ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য)
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গু পরিস্থিতি
ঢাকার পর দেশে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী চট্টগ্রাম বিভাগে (রোহিঙ্গা শিবির ছাড়া)। রোহিঙ্গা শিবিরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্রমতে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৮ জুন পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৩ জন রোহিঙ্গা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। গত বছর একই সময় শিবিরগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৭৩ জন। অর্থাৎ এই বছর একই সময় আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। ঘনবসতি এলাকা এবং পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব এর অন্যতম কারণ বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখানে অবশ্য পরীক্ষা ব্যবস্থা থাকার জন্য দ্রুত সনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সতর্কতা
স্বাস্থ্য অধিদফতর ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থেকে পরিবেশ পরিচ্ছন্নতার ওপর নজর দিতে পরামর্শ দিয়েছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ মোকাবিলায় স্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে গুরুত্ব আরোপ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
• দুই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে এক তথ্যবিবরণীতে বলেছে, শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি হওয়ার পাশাপাশি মাথা, চোখের পেছনে, শরীরের পেশি ও জয়েন্টসমূহে ব্যথা এবং বার বার বমি করার প্রবণতার লক্ষণ দেখা দিলে ডেঙ্গু সন্দেহে নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
• তীব্র ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ডেঙ্গু হওয়ার ৩ থেকে ৭ দিন পর শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যেতে পারে, তীব্র পেট ব্যথা; ক্রমাগত বমি করা, বমির সাথে রক্ত যাওয়া, ঘন ঘন শ্বাস নেয়া এবং শরীরে অবসাদ বোধ করা, অস্থিরতা বোধ হবে।
• ব্যক্তিগত সতর্কতা সম্পর্কে তথ্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ঘরের বা অফিসের বা কর্মস্থলের জানালা সবসময় বন্ধ রাখতে হবে এবং মশার কামড় থেকে বাঁচতে যতটা সম্ভব শরীর ঢেকে রাখতে পারে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে।
• কমিউনিটির সচেতনতা বৃদ্ধি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদফতর পরামর্শে বলেছে, পরিবার, প্রতিবেশী ও কমিউনিটির মধ্যে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং পরিচ্ছন্নতা অভিযানে সকলকে সরাসরি যুক্ত হওয়ার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
• মশার প্রজনন রোধে যেসব কাজগুলো করতে হবে- ঘরে ও আশপাশে যে কোনো পাত্রে বা জায়গায় জমে থাকা পানি তিনদিন পরপর ফেলে দিলে এডিস মশার লার্ভা মরে যাবে; ব্যবহৃত পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হবে এবং ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, বালতি, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা বা নারিকেলের মালা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারি সেল ইত্যাদিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে বিধায় এগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। এছাড়া পানি যাতে না জমে সেজন্য অব্যবহৃত পানির পাত্র ধ্বংস করতে হবে অথবা উল্টে রাখতে হবে। দিনে অথবা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে এবং ডেঙ্গু হলে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে দ্রুত যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছে অধিদফতর।
শিশুর ডেঙ্গু হলে করণীয়
২০২২ সালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত এবং ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একটি বড় অংশই ছিল শিশু। ঐ বছর লক্ষ করা গেছে যে শিশু দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে তার শারীরিক জটিলতা বেশি দেখা দিয়েছে। শিশুরা সাধারণত তাদের শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন বা সতর্ক না হওয়ায় তাদের ওপর এ রোগের প্রভাব ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলেন,
• শিশুদের খুবই সাবধানে রাখতে হবে। তারা যেন ফুলহাতা জামা কাপড় পরে হাত পা যতোটা সম্ভব ঢেকে রাখে। শিশুরা দিনে ঘুমালেও মশারি টাঙিয়ে দিতে হবে।
• আরেকটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হতে পারে মশা দূরে রাখার ক্রিম ব্যবহার। মশার কামড় থেকে দূরে রাখতে আগে অনেকে শিশুর হাত-পায়ে নিশিন্দাপাতার রস লাগিয়ে দিতেন। এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
• এছাড়া শিশুর জ্বর হওয়ার প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ ও পরীক্ষা করতে হবে। ‘মৌসুমি জ্বর’ ভেবে সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। এরই মধ্যে ডেঙ্গুর ‘বিপজ্জনক চিহ্ন’ বা ‘মারাত্মক’ চিহ্নগুলো প্রকাশ পায়। ফলে শিশু সংকটজনক পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। চিকিৎসকের সন্দেহ হলে প্রথম বা দ্বিতীয় দিনেই ডেঙ্গু এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে ডেঙ্গু শনাক্ত করতে পারবেন।
• শিশুর ডেঙ্গু হলে তাকে বিশ্রামে রাখুন, প্রচুর পানি বা তরল খেতে দিন। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল সিরাপ বা বড়ি ৪ থেকে ৬ ঘন্টা পরপর খেতে দিন। ডেঙ্গুতে ২-৩ দিন পর যখন জ্বর কমে যায়, তখনই জটিলতা দেখা দেওয়ার সময়। এ সময় প্রতিদিন রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার পরিমাণ দেখা উচিত।
• রক্তে অণুচক্রিকার (প্লাটেলেটস) সংখ্যা কমতে থাকলে, শিশু বারবার বমি করলে, খেতে না পারলে, পেটে ব্যথা হলে, শিশুর মধ্যে অতি অস্থিরতা বা নিস্তেজ ভাব দেখা দিলে, মুখ-দাঁত–নাক দিয়ে রক্তপাত হলে কিংবা কালো পায়খানা অথবা কালো রক্তবমি কিংবা রক্তের মত প্রস্রাব করলে অবশ্যই হাসপাতালে নিন। মুখ-চোখ ফ্যাকাশে মনে হলে, হাত-পা অতিরিক্ত ঠান্ডা মনে হলে, ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব না করলে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। জ্বর ভালো হওয়ার পরও কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে, তাই সতর্ক থাকতে হবে।
• যদি শিশুর মা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হন, তাহলে সেই ভাইরাসের কোন প্রভাব মায়ের বুকের দুধে পড়ে না। কাজেই আক্রান্ত অবস্থায় মা তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন।
দেশে সর্বশেষ ১১ জুন সকাল ৮.০০টা থেকে ১২ জুন সকাল ৮.০০টা পর্যন্ত ১৪০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে এবং একজন মারা গিয়েছে। এর মধ্যে ১২৭ জনই আক্রান্ত হয়েছেন ঢাকায় (মহানগর সহ)।
কোভিড থেকে সুরক্ষার জন্য জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। মাস্ক ব্যবহার বন্ধ করবেনা।
লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শে পরীক্ষা করতে হবে।
ছবিসূত্র: ইন্টারনেট