নিরাপদ করতে হবে শিক্ষার্থীদের বনভোজন

শিক্ষার্থীদের বনভোজন নিরাপদ করার আহবান জানিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২২)

বনভোজন বা ভ্রমণের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় বা পর্যটনস্থলে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রাণহানির খবর প্রায়ই দেখা যায়।

বছর প্রায় শেষ। দেশে শীতের আমেজ। এ সময় মানুষ ঘুরতে বের হন। বনভোজন, শিক্ষাসফর, আনন্দভ্রমণ প্রভৃতি নামে পাড়ার স্কুলের, কোচিং সেন্টারের, কলেজের, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষক মিলে বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন। বাস-লঞ্চ-ট্রেন-মাইক্রোবাস-নৌকায় চলতে থাকে এসব আয়োজন। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে দুই বছর এসব পর্যটন বা মানুষের ভ্রমণ সংগত কারণেই বন্ধ ছিল। এখন আপাতত করোনা সংক্রমণের ভয় কমে গেছে। স্বাস্থ্যবিধি কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আগ্রহও যেন কমে গেছে। এটাও ঠিক, এখন বনভোজন বা মানুষের ভ্রমণের আর কোনো মৌসুম নেই। বর্ষা মৌসুম বাদ দিলে সারা বছরই পর্যটন এলাকায় ভ্রমণপিপাসুদের দেখা মেলে। 

চলতি বছরের জুলাইয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জোগীরহাট এলাকার এক কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা মাইক্রোবাস চেপে বনভোজনে বের হয়েছিলেন। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, চালক, সহকারীসহ মাইক্রোবাসে মোট ১৮ জন আরোহী ছিলেন। তাঁরা ঘুরতে গিয়েছিলেন মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায়। বেলা পৌনে দুইটার দিকে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় তাঁদের মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেয় ট্রেন। এ দুর্ঘটনায় ১৮ আরোহীর মধ্যে ১১ জনই নিহত হন। এসএসসি পরীক্ষার্থী নিহত হিশামের চাচা মো. মানিক আহাজারি করতে করতে বলছিলেন, ‘কাউকে না জানিয়ে হাশিম পিকনিকে গেল।’ ভুলটা কার ছিল, এখানে সেটা না বলি। তবে কোচিং সেন্টার হোক বা স্কুল-কলেজ হোক, অভিভাবকদের না জানিয়ে তাঁদের অনুমতি বা মতামত না নিয়ে শিক্ষার্থীদের বনভোজন বা আনন্দভ্রমণে নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত।

গত ১১ নভেম্বর শুক্রবার ভোররাতে চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড এলাকা থেকে একটি বনভোজনের বাস কক্সবাজারের উদ্দেশে যাচ্ছিল। বাসটি লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর হাজির রাস্তার মাথা এলাকায় পৌঁছানোর পর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশের একটি গাছে ধাক্কা দেয়। এ সময় বাস থেকে ছিটকে পড়ে বাসের চাপায় ঘটনাস্থলেই দুজন নিহত হন। আহত হন আরও অনন্ত ২০ জন।

চলতি বছরের শুরুতে গত ২৭ মার্চ গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকা থেকে রাজু ক্যাডেট একাডেমি নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাস ভাড়া করে ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে নাটোরের লালপুরে গ্রিনভ্যালি পার্কে বনভোজনে যাওয়া হয়। পরদিন ২৮ মার্চ রাতে বনভোজন কাফেলার একটি বাস আগুনে পুড়ে যায়। বাসের পেছনের দিকের আসনে বসে কয়েকজন শিক্ষার্থী ধূমপান করছিল। তাদের সিগারেটের আগুন গিয়ে পড়ে সাউন্ড বক্সের ব্যাটারির ওপর। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাসে। ঘটনার ভয়াবহতায় বাসের সব শিক্ষার্থী আগেভাগে দৌড়ে নেমে পড়ায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।

বছর দুয়েক আগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শেষে নেত্রকোনায় বনভোজনে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার পাঁচ শিক্ষার্থী নিহত হয়। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত দুই শিক্ষার্থী আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। নিহতদের পরিবারের কান্না এখনো থামেনি। থামেনি গৌরীপুরের শালিহর হাজী আমির উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের সহপাঠীদের হায়-আফসোস।

শুধু যে শিক্ষার্থীদের বাস দুর্ঘটনায় পড়ে, সেটা বলা যাবে না। চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারার পাগলিরবিল এলাকায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পৌর ব্যবসায়ী সমিতির বনভোজনের বাস দুর্ঘটনার শিকার হয়। এ ঘটনায় বাসচালক নিহত হন। গুরুতর আহত হন কমপক্ষে ১৬ জন। 

মৃত্যু শুধু সড়কে নয়

সড়ক দুর্ঘটনায় যে শুধু প্রাণহানি ঘটছে, তা নয়। বনভোজনস্থলে গিয়েও হরহামেশা প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। এ বছরের ২৯ জানুয়ারি বিকেলে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে মরা পদ্মা পাড়ে গ্রামের অনেক শিশু দল বেঁধে মঞ্জুর রহমানের বাড়ির পাশে খোলা জায়গায় বনভোজন করছিল। বড় ভাইবোনদের হাত ধরে ৭ বছরের শিশু মাইসাও সেখানে যায়। অন্যরা যখন বনভোজনের রান্না ও আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ব্যস্ত, মাইসা তখন সবার অলক্ষ্যে নদীর পাড়ে চলে যায়। একপর্যায়ে পা পিছলে শিশুটি পানিতে পড়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর কয়েকটি শিশু টের পেয়ে চিৎকার করলে বড়রা এসে মাইসাকে দ্রুত উদ্ধার করেন। ততক্ষণে মাইসা মারা গেছে।

গত বছরের ৫ জুলাই সকালে আমিরপুর গ্রামের লইসকার বিলে ৩২ বন্ধু নৌকা নিয়ে বনভোজনে যান। নতুন পানি দেখে বিলে সবাই লাফালাফি শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁদের সঙ্গী শ্রাবণও লাফিয়ে পানিতে নামেন। এরপর বিলে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বিকেলে শ্রাবণের মরদেহ উদ্ধার করেন। 

আরেকটি ঘটনা। ঢাকার ডেমরার নাভারন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১৩৫ শিক্ষার্থীকে নিয়ে চাঁদপুরের মতলবে মেঘনা নদীর পাড়ে মোহনপুর পর্যটনকেন্দ্রে বনভোজনে যান শিক্ষকেরা। এদের মধ্যে দশম শ্রেণির ছাত্র নয়ন মেঘনায় ডুবে যায়। পরে নৌ পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। 

তখন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মো. আজিজুল হক বলেন, ‘আমরা এসেছিলাম আনন্দ করতে। এ ঘটনায় আমরা খুবই মর্মাহত।’

লক্ষ্মীপুরের ৮ বছরের ফুটফুটে শিশু ফৌজিয়ার কথা এত দিন কারও মনে থাকার কথা নয়। লক্ষ্মীপুর সদরের ইলেভেন কেয়ার একাডেমির দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল সে। স্কুল কর্তৃপক্ষ লক্ষ্মীপুর থেকে তাদের কুমিল্লার ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্কে বনভোজনে নিয়ে যায়। পার্কের পুকুরে পড়ে তার মৃত্যু হয়। ফৌজিয়া কখন কীভাবে হারিয়ে গেল, শিক্ষকেরা বলতে পারেননি। মৃত্যুর খবর পাওয়ার এক ঘণ্টা আগেও নাকি ফৌজিয়ার সঙ্গে তার মায়ের মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিল। শিক্ষকদের অসচেতনতা না গাফিলতির শিকার হয়েছিল ফৌজিয়া? নাকি বুয়েট ছাত্রের মতো স্বেচ্ছায় পানিতে ঝাঁপ? দিয়ে মারা গেছে সে, তা বলার বা জিজ্ঞাসার কেউ নেই। 

ভ্রমণ কীভাবে নিরাপদ করা যায়

স্কুলে পড়াশোনা চালানোর যেমন একটা নিয়মনীতি আছে, তেমনি শিশুদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া বা আনন্দ-উল্লাসের সঙ্গে একটা দিন কাটানোরও কিছু অবশ্যপালনীয় নিয়মনীতি থাকা উচিত। শিশুরা খেলবে, বেড়াবে, আনন্দ করবে—সেটা তাদের অধিকার এবং সুস্থ বিকাশের পূর্বশর্ত। কিন্তু মাত্রাটা কেমন হবে, সেটা ঠিক করে দেওয়া জরুরি।

প্রথমত, পরিবহনে একটা নির্দিষ্ট মান রক্ষা করা উচিত। সবার স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর রাখতে হবে। সাধারণত দেখা যায়, বড়রা বসেন নিজ নিজ আসনে, ছোটরা বসে গাদাগাদি করে। বনভোজন করতে গিয়ে খরচ বাঁচাতে অনেক সস্তা পরিবহন খুঁজতে দেখা যায়। লাইনের বাস যখন সারা দিন থাকবে, তখন মালিক কখনোই তাঁর ভালো বাসটি দেবেন না। তারপর দামাদামি করলে খারাপ বাসটি দেবেন, আবার চালাতে দেবেন তাঁকে, যাঁকে লাইনের বাসে দিলে তার দিল ধক ধক করে। অনেক সময় জ্যেষ্ঠ সহকারী হয়ে যান বনভোজন বাসের চালক।

দ্বিতীয়ত, দূরত্বের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বনভোজনের শিক্ষকদের তো ইচ্ছা হবেই, এই মওকায় হিল্লি-দিল্লি ঘুরে দেখার। তাদের দমের সঙ্গে শিশুদের দম তো মিলবে না। ঢাকার ডেমরা থেকে চাঁদপুর মতলবের মোহনপুর মোটেও কাছের কোনো ঠিকানা নয়। লক্ষ্মীপুর থেকে কুমিল্লা শিশুদের জন্য যথেষ্ট দূরের পথ। বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের খুব দূর নয়, এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত। যাতে করে সেখান থেকে দিনের আলো থাকতে থাকতে সবাই ফিরে আসতে পারে। স্কুলের ১০ থেকে ১৫ মাইলের বাইরে বনভোজনের কোনো স্থান নির্বাচন করা ঠিক নয়। 

বনভোজনে কী কী কর্মসূচি থাকছে, সেটাই শিশুরা আসলে বেশি উপভোগ করে, দূরত্ব নয়। সুতরাং বনভোজনে শিক্ষকেরা কী কী আনন্দময় কর্মসূচি রাখছেন, সেটিই আসল। স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যেও শিশুদের একটা আনন্দময় দিন উপহার দেওয়া যায়।

স্কুলের বাইরে শিশুদের নেওয়ার একটা পরিষ্কার নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। জাতীয়ভাবে না হোক, জেলার শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নেতৃত্বে জেলাভিত্তিক একটা নীতিমালা কি খুব বেশি চাওয়া হবে? সেখানে পরিবহন, দূরত্ব, দিনের কর্মসূচি, ফিরে আসার সময় ইত্যাদি বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকবে। সেগুলো অমান্য করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকবে। 

এরপরও বনভোজনে যাওয়া-আসার পথে অথবা বনভোজনস্থলে যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে কী করতে হবে, সেটাও পরিষ্কার করে বলে দিতে হবে। জরুরি চিকিৎসা ও রেফারেল চিকিৎসার একটা সর্বজনস্বীকৃত প্রটোকল থাকতে হবে।

শিক্ষকদেরও এসব অব্যবস্থাপনার জবাব দিতে হবে। গাদাগাদি করে অনেক দূরে শিশুদের নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশ দেখার ইচ্ছাপূরণের চেষ্টাকে অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে। এসব ক্ষেত্রে একচুলও ছাড় দেওয়া যাবে না।

Leave a Reply