‘শিক্ষা’ নিয়ে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৩)
এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা আজ ১৭ আগস্ট শুরু হয়ে শেষ হবে ২৫ সেপ্টেম্বর। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তিনটি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে শুরু হতে যাওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা পিছিয়েছে। শ্রাবণের অভূতপূর্ব বন্যায় চট্টগ্রাম বোর্ডের এইচএসসি, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের আলিম ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ভোকেশনাল, বিএম, বিএমটি পরীক্ষা আগামী ২৭ আগস্ট শুরু হবে। আর ঢাকা, রাজশাহী, যশোর, বরিশাল, সিলেট, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে যথারীতি ১৭ আগস্ট। গত শুক্রবার রাতে (১১ আগস্ট) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়ের এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পরীক্ষা পেছানোর দাবি নিয়ে এর আগে পথে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। কিছুটা ‘মামাবাড়ির আবদার’-এর আদলে তারা রাজপথে ‘দৃশ্যমান’ হয়েছিল। পুলিশ পাত্তা দেয়নি। ৭ আগস্ট প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নিলে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তার আগে প্রথমে তারা শাহবাগে অবস্থান নেয়, এর পর যায় সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও নীলক্ষেতে। সেখান থেকেও পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। পরদিন মঙ্গলবার ঢাকার শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য এলাকায় আবার অবস্থান কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশের বাধার মুখে তারা শেষ পর্যন্ত নিরুপায়ের উপায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যে অবস্থান নেয়। আন্দোলনকারীদের প্রশ্ন ও দাবি ছিল এ রকম–
১. আমরা পুরো দুই বছর পড়ার সুযোগ পাইনি। পুরো সিলেবাস শেষ না করে আমাদের কেন ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হবে? ৫০ নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া হোক।
২. অনেক প্রতিষ্ঠানে আইসিটির শিক্ষক নেই। আইসিটি ঠিকমতো পড়ানো হয়নি। আমাদের আগের ব্যাচকে আইসিটি পরীক্ষা দিতে হয়নি। আমরা কেন দেব? এই পরীক্ষা বাতিল করা হোক।
৩. আমরা এসএসসি পরীক্ষা করোনার কারণে মাত্র তিন বিষয়ে দিয়েছি। এখন এত চাপ আমরা নেব কীভাবে?
৪. ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে পরীক্ষা স্থগিত করা হোক।
তাদের কারও কারও দাবি, ডেঙ্গুর কারণে কোনো কোনো পরীক্ষার্থী ঠিকমতো প্রস্তুতি নিতে পারছে না। তাদের দাবি ছিল– হয় ৫০ নম্বরের পরীক্ষা হোক, না হলে পরীক্ষা কমপক্ষে দুই মাস পিছিয়ে দেওয়া হোক।
শিক্ষার্থীদের সিলেবাস শেষ না হওয়ার আভিযোগ শিক্ষকরা অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন যথারীতি। তারা বেশ জোরের সঙ্গে দাবি করেছেন– ‘আমরা পুরো সিলেবাস শেষ করিয়েছি। করোনার কারণে এ ব্যাচের প্রথম দিকের কিছু ক্লাস অনলাইনে নেওয়া হলেও পরে সশরীরে ক্লাসের সময় সেটা পুষিয়ে দেওয়া হয়।’ পরীক্ষা পেছানো বা কম নম্বরে পরীক্ষা নেওয়ার পেছনে কোনো যুক্তি তাদের নজরে পড়েনি।
শেষ পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রী সব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে নিয়ে বৈঠক করে শুধু আইসিটি পরীক্ষার ক্ষেত্রে ছাড় দিতে রাজি হন। এখন আইসিটি পরীক্ষা হবে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে ৭৫ নম্বরের মধ্যে। আগে বড় প্রশ্ন আটটির মধ্যে পাঁচটির উত্তর দিতে হতো; এবার দিতে হবে তিনটির। এমসিকিউ ২৫টির পরিবর্তে ২০টির জবাব দেবে। ব্যবহারিক পরীক্ষা হবে ২৫ নম্বরের। আদতে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল জুলাই মাসে। শিক্ষা বোর্ডগুলো সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অনেকেরই আপত্তি ছিল জুলাই নিয়ে। আপত্তির কারণ–
১. পরীক্ষার্থীদের উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাস শুরুর পর শিক্ষার্থীরা দুই বছরের জায়গায় এক বছর তিন মাস (১৫ মাস) সময় পেয়েছে। ২. শিখন ঘাটতি নিয়ে তাড়াহুড়া করে পরীক্ষা নেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা পড়ার চাপে পিষ্ট হয়। ৩. জুলাইয়ে পরীক্ষা হলেও এসব শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষা হবে আগামী বছরের এপ্রিল থেকে জুন-জুলাইয়ে। বিস্তর সময় তাদের বসে থাকতে হবে। অথবা ৪. অভিভাবকদের ঘাড়ে কোচিং খরচের বোঝা চেপে বসবে দীর্ঘ সময়ের জন্য। তাই প্রশ্ন ওঠে, উচ্চশিক্ষায় ভর্তির সঙ্গে সমন্বয় না করে শুধু এইচএসসি পরীক্ষা আগে আগে নিয়ে কী লাভ? লাভ যে কারও নেই– সেটা হলফ করে বলা যাবে না। যাদের সংগতি আছে তারা এইচএসসির ফল ঘোষণার পর ভর্তির জন্য ‘ফালতু’ সময় নষ্ট না করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে দু-এক সেমিস্টার এগিয়ে যাবে। অনেকেই দেশের বাইরে চলে যাবে পড়াশোনার উসিলায়, দেশ মেধা হারাবে। ছয়-সাত মাসের লম্বা বিরতির মধ্যে অনেকেরই বিয়ের ডাক আসবে। বিয়ের হাতছানিতে কাবু হবেন অনেক অভিভাবক।
এখন প্রশ্ন– দুর্গত এলাকায় ১০ দিনের মধ্যে কি সব স্বাভাবিক?
বান্দরবানে এখনও (১৫ আগস্ট) মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে থাকছে। খুব সরল হিসাবে সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬ হাজার ৫৬৯টি ঘর ও ১৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখনও বিদ্যুৎহীন তিন উপজেলা। ঘর হারিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও অনেকের ঠাঁই হয়েছে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। কেউ উঠেছেন ভাড়া বাসায়। অনেকে শুরু করেছেন নতুন ঘর নির্মাণ। বন্যায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, আদালত ভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, গ্রন্থাগার, পানি শোধনাগার– কোনো কিছুই ডুবতে বাকি ছিল না। সেখানে পাহাড়ি ঢলে এখন পর্যন্ত ১০ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। নিখোঁজের তালিকা তৈরি হচ্ছে। বিচ্ছিন্ন দুই উপজেলা থানচি ও রুমার সঙ্গে যোগাযোগ পুনঃস্থাপনে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগবে।
বন্যার মৌসুম কি শেষ?
চলতি ভাদ্র মাসের পূর্ণিমার প্রভাবে আগামী ৩১ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের ১/২ তারিখের (ভাদ্র ১৩-১৫) দিকে আবারও জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদি ওই সময় বৃষ্টি হয় তাহলে পরিস্থিতি গত ৩ আগস্ট থেকেও ভয়াবহ হতে পারে এবং দেশের উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল পুনরায় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অমাবস্যায় জোয়ারের (১৬-১৮ আগস্ট) উচ্চতা গত পূর্ণিমার থেকে কম হলেও আগামী পূর্ণিমা কিন্তু কোনো ছাড় দেবে বলে মনে হচ্ছে না। যদি আসন্ন ব্লু মুনের জোয়ার সুপার মুনের জোয়ারকে ধরে ফেলে, তাহলে পরীক্ষার্থী নিয়ে আমাদের ‘প্ল্যান বি’ আছে কি? করোনার কারণে আমাদের এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আগের ধারায় ফেরা। বর্ষা-বন্যার আগেই পরীক্ষা শেষ করা। আমাদের উচ্চশিক্ষায় ভর্তির সঙ্গে সময়ের সমন্বয় করা। এসব নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।