নিপাহ ভাইরাস নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ২৯জানুয়ারি ২০২৩)
চলতি বছরে রাজশাহী ছাড়া অন্য কোথাও নিপাহ ভাইরাস শনাক্তের খবর আসেনি। রাজশাহীর ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে পরীক্ষা করেছেন। অন্য কোথাও হয়তো সেভাবে পরীক্ষা করা হয়নি অথবা পরীক্ষার কোনো সুবিধা নেই।
দেশে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয় মেহেরপুরে। সেটা ২০০১ সালের কথা। গত ২২ বছরে দেশের ৩২টি জেলায় নিপাহ ভাইরাসের প্রায় ৪১টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। নথির বাইরেও ঘটনা থাকতে পারে। শুরু থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে সরকারিভাবে ৩২৫ জনের দেহে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
তাঁদের মধ্যে ২৩০ জনই মারা গেছেন। গত বছর (২০২২) নিপাহ ভাইরাসে তিনজন আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে দুজনকে বাঁচানো যায়নি। তাঁদের একজন ছিলেন নওগাঁর, অন্যজন ফরিদপুরের। হিসাবের এ ধরন থেকে বলা যায়, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৭১ শতাংশই মারা যান।
২০ জানুয়ারি সকালে সাত বছরের শিশু সোয়াদ খেজুরের রসের স্বাদ নিয়েছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার জ্বর বাড়তে থাকে, সঙ্গে খিঁচুনি দেখা দেয়। একসময় শিশুটি জ্ঞান হারায়। বিকেলে তাকে ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে পরদিন সকালে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। দ্রুত অবস্থা খারাপ হতে থাকায় চিকিৎসকদের সন্দেহ হয়। তাঁরা নিপাহ ভাইরাসের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করেন। পরীক্ষায় নিপাহ ভাইরাস ধরা পড়ে। শিশুটিকে বাঁচানো যায়নি। আক্রান্ত হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ২৩ জানুয়ারি শিশুটি মারা যায়।
চলতি বছরে এখন পর্যন্ত (২৫ জানুয়ারি) রাজশাহী মেডিকেলেই নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হলো। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সেখানে মারা যান গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা এলাকার এক নারী।
তবে কি এবার শুধু রাজশাহীতে নিপাহ
চলতি বছরে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ও প্রকাশিত খবর অনুযায়ী রাজশাহী ছাড়া অন্য কোথাও নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়নি। রাজশাহীর ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে পরীক্ষা করেছেন। অন্য কোথাও হয়তো সেভাবে পরীক্ষা করাই হয়নি অথবা পরীক্ষা করার কোনো সুবিধা নেই। উপজেলা পর্যায়ে এমনকি জেলা পর্যায়েও নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। একজন সদ্য সাবেক সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ‘সন্দেহ হলে বা কেস স্টোরি শুনে খেজুরের রস পানের ঘটনা জানা গেলে আমরা দেরি না করে রোগীকে রেফার করে দিই।’
নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণের সঙ্গে অন্য নানা স্নায়ু এবং স্নায়বিক রোগের আলামতগত মিল থাকায় মাঠপর্যায়ের অনেক চিকিৎসকের পক্ষে চট করে রোগটি ঠাহর করা সম্ভব হয় না। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রাথমিকভাবে মাথাব্যথা, খিঁচুনি, গা ব্যথা, ঘাড় ও পিঠ শক্ত হয়ে যাওয়া, বমিবমি ভাব এবং গলাব্যথা হতে পারে। এরপর আক্রান্ত ব্যক্তি প্রলাপ বকা শুরু করতে পারে। এ ধরনের রোগী আলো সহ্য করতে পারে না। কখনো কখনো অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতির অবনতি হলে হঠাৎ হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া অথবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
শুধু কি খেজুরের রস থেকে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হয়?
দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশে প্রথম নিপাহ ভাইরাসের আলামত পাওয়া যায়, সেসব দেশে (যেমন মালয়েশিয়া/সিঙ্গাপুর) খেজুরের কাঁচা রস পানের তেমন প্রচলন নেই। গবেষকেরা বলছেন, শাকসবজি, ফলমূল থেকেও নিপাহ ভাইরাস ছড়াতে পারে। বাগানের বা বাজার থেকে আনা ফলমূল, শাকসবজি ভালো করে না ধুয়ে খাওয়া ঠিক নয়। বিশেষ করে প্রাণী বা পাখির আংশিক খাওয়া কোনো কিছুই খাওয়া যাবে না। অনেকেই আদর করে পোষা পাখি বা প্রাণীকে মুখের খুব কাছে নিয়ে খাইয়ে থাকেন। ফেসবুকে দেওয়ার জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক এটা অনুসরণ করা ঠিক নয়। বাদুড় ছাড়াও সংক্রমিত শূকর এবং সংক্রমিত মানুষের মাধ্যমে এটা ছড়াতে পারে।
অতীতে বাংলাদেশে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমণের অনেক ঘটনা ঘটেছে। ‘ফরিদপুর সংক্রমণের’ সময় (২০০৪ সালে) ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে এনআইভি বা নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ছবিটা খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। রোগীর যত্ন নেওয়া চার ব্যক্তি—মা, ছেলে, খালা এবং একজন প্রতিবেশী চিহ্নিত রোগীর প্রথম অসুস্থতার ১৫-২৭ দিন পরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগীর আক্রান্ত খালাকে কাছাকাছি গ্রামের যে হুজুর প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছিলেন, তিনিও ১৩ দিন পরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। গ্রামের সেই হুজুরের অসুস্থতা গুরুতর আকার ধারণ করলে, তার অনেক আত্মীয় এবং অনুসারীরা তাকে তার বাড়িতে দেখতে যান। দর্শনার্থীদের মধ্যে কমপক্ষে ২২ জনের মধ্যে নিপাহ সংক্রমণ হয়।
আক্রান্ত অনুসারীদের এই অনুগামীদের মধ্যে একজন অসুস্থ হওয়ার পর নিজের বাড়ি ফিরে গেলে সেখানে তার থেকে আরও তিনজন সংক্রমিত হন (দুজন পরিবারের সদস্য, যাঁরা তার সেবাশুশ্রূষা করেছিলেন আর একজন বন্ধু, যিনি দেখতে এসেছিলেন)।
পরে ওই ব্যক্তির অবস্থার অবনতি হলে তাকে যে ভ্যানচালক হাসপাতালে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন, তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফরিদপুরের ঘটনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, একজন থেকে প্রায় ৩৪ জনের মধ্যে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হয়। এদের অনেকে মারা যান।
একজন সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে পাঁচটি বিভিন্ন স্তরে থাকা এসব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত করোনার চেয়েও ভয়াবহ। এ রকম পরিস্থিতিতে খেজুরের রস থেকে দূরে থাকার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার ও শুশ্রূষার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে মাস্ক পরা ও ব্যক্তিগত হাইজিন বজায় রাখা খুবই জরুরি। পরিবারের সবাইকে অনেকটা কোভিডকালীন সতর্কতা মেনে চলা প্রয়োজন। নিপাহ ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকতে হলে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে লাগাম টানতে হবে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো বিকল্প নেই। (সূত্র: TRANSMISSION OF HUMAN INFECTION WITH NIPAH VIRUS Authors Stephen P. Luby, Emily S. Gurley, and M. Jahangir Hossain).
ফরিদপুরের সংক্রমণ থেকে কি আমরা শিক্ষা নিয়েছি
প্রাপ্ত তথ্য–উপাত্ত অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় আকারের নিপাহ সংক্রমণের ঘটনা ঘটে ২০০৪ সালে ফরিদপুর জেলায়। সে বছর ফরিদপুরে নিপাহ ভাইরাসে ৩৫ জন আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পরপরই আইইডিসিআর এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) সম্মিলিতভাবে এ ঘটনার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নামে। তখন এতে অর্থসংস্থান করে যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)।
এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে না, আমরা সেসব শিক্ষা আমলে নিইনি। এবারের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে লব্ধ জ্ঞান বা শিক্ষার প্রচার নেই। এমনকি মাঠপর্যায়ে চিকিৎসকেরা অনেকেই জানেন না ফরিদপুর থেকে আমরা কী শিখেছি। জানলে কে কয়জন (দুজন মতান্তরে পাঁচজন) মারা গেছেন তাঁদের পরিবারের সদস্য ও সেবাদানকারী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হতো। আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নেওয়ার বিলাসিতা আমাদের সাজে কি?
শিশু সোয়াদের আক্রান্ত হওয়া আর মৃত্যুর যে ঘটনা হাসপাতালের সূত্র ধরে পত্রিকায় এসেছে সেটা পড়লে মনে হবে সকালে রস পান করে শিশুটি সংক্রমণের শিকার হয়। অথচ বিজ্ঞান বলছে খেজুরের রস পানের ৮ থেকে ৯ দিন পর সংক্রমণের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের ক্ষেত্রে ৬ থেকে ১১ দিন পরে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। যদি প্রকাশিত খবরের বর্ণনা ঠিক হয়, তবে সেটাও আমলে নিয়ে নতুন করে পর্যবেক্ষণে যেতে হবে।
ভালো খবর
ধারাবাহিক অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যাচ্ছে, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত নারী সেরে উঠলে তার শরীরে যে নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধী উপাদান বা নিপাহ ভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, সেটা সংক্রমণ–পরবর্তী সময়ে জন্ম নেওয়া সন্তানদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। অর্থাৎ নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে যাওয়া নারীরা পরে গর্ভধারণ করলে তাঁর গর্ভের শিশুটির নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। ফরিদপুর জেলায় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পাঁচ বছরের কম বয়সী একটি মেয়ে এবং তার মা নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হন। মা গুরুতর স্নায়বিক জটিলতা নিয়ে বেঁচে গেলেও শিশুটি মারা যায়। বেঁচে যাওয়া মা ২০২১ সালের নভেম্বরে ফের গর্ভধারণ করেন। আগস্টে (২০২২) তাঁর একটি সুস্থ পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। প্রসবের আগে থেকেই মাকে জাতীয় নিপাহ সার্ভিল্যান্স কর্তৃপক্ষের নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছিল। সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠাদের দেখভাল বা ফলোআপের অংশ হিসেবে নবজাতকের দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পরীক্ষায় শিশুর দেহে নিপাহ ভাইরাসের অ্যান্টিবডি পাওয়া যায়। এভাবেই প্রথমবারের মতো নিশ্চিত হওয়া যায় যে মা থেকে সন্তানের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসের হিউমোরাল অ্যান্টিবডি পৌঁছায়।
আরও ভালো খবরের অপেক্ষায়
বেঁচে যাওয়া মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশু মনের খুশিতে খেজুরের কাঁচা রস পান করে আমাদের মতো শৈশব উদ্যাপন করতে পারবে, এটা আনন্দের কথা। এ সত্য অনুসন্ধানে গবেষকেরা নিশ্চয় আহ্লাদিত হবেন। সে আহ্লাদে আমরাও শামিল। কিন্তু আগামী শিশুর মা–বাবা, ভাই–বোনকে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তোলা খুব জরুরি। নিপাহ ভাইরাসের প্রতিষেধক সে কাজটা করতে পারে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোথাও নিপাহ ভাইরাসের টিকার কোনো খবর নেই।
আশার কথা, আইসিডিডিআরবি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শনাক্তকরণ, রোগের সংক্রমণের ধরন এবং মারাত্মক সংক্রমণের বিরুদ্ধে থেরাপিউটিকস এবং ভ্যাকসিন তৈরিতে নতুন তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহে বিশ্বের দীর্ঘতম নিপাহ ভাইরাস সার্ভিল্যান্স পরিচালনা করছে। সরকারের সঙ্গে অংশীদারত্বে পরিচালিত এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি সফল প্রচেষ্টা। আশা করা যায়, শিগগির এ উদ্যোগ নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার দিশা দিতে পারবে। রক্ষা করতে পারবে মানুষের জীবন।
তবে যত দিন সেটা না হচ্ছে, তত দিন জনসচেতনতা বাড়ানো একমাত্র ভরসা। খেজুরের কাঁচা রস, বাদুড়ে খাওয়া ফলমূল থেকে দূরে থাকতে হবে। বাজারের বা বাগানের (ছাদবাগানসহ) সব ফলমূল, শাকসবজি ভালো করে ধুয়ে খেতে হবে।