বাল্য বিবাহ এবং শিক্ষা নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৩)
কোভিডের পর ২০২১ সালের নভেম্বরে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি পরীক্ষা। কুড়িগ্রামের থানাহাট এ ইউ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের পরীক্ষাকেন্দ্রের মূল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক প্রবীণ নারী। কোলে তাঁর এক নবজাত শিশু।
পরীক্ষার্থী মা এই প্রবীণ নারীর নাতি। ধরা যাক, নাতির নাম সুমি। সুমির নানি জানান, সপ্তম শ্রেণিতে থাকতে সুমির বিয়ে হয়েছিল। সন্তান জন্মদানের অপারেশনের ঘা শুকায়নি এখনো সুমির, পরীক্ষা দিতে এসেছে। সুমিদের বাড়ি চিলমারী ইউনিয়নের চর শাখাহাতি এলাকায় হলেও থানাহাট ইউনিয়নে এসে পড়াশোনা করেছে। ভাবতে অবাক লাগে বাল্যবিবাহের শিকার এই মেয়ে কোথায় পেল এই জোর? কোন শক্তিবলে কোভিডের ধাক্কা সইয়ে এসএসসির পরীক্ষার হল পর্যন্ত চলে এল। সুমির মতো আরও চারজন শিশুমাতা সেই কেন্দ্রে ছিল। বাল্যবিবাহের শিকার এই মেয়েরা যে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সবাই সুযোগ পাচ্ছে না। সবচেয়ে ভালো হতো যদি বাল্যবিবাহ আর বাল্যকালে গর্ভধারণ বন্ধ করা যেত। কারণ, একটি মেয়ের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যায় এতে।
জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুসারে, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ নির্মূল এবং ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ এক-তৃতীয়াংশ কমানোর লক্ষ্য ছিল। বাল্যবিবাহ বন্ধে ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল চালু হয় সরকারি হটলাইন নম্বর ৩৩৩। এই নম্বরে দেশের যেকোনো জায়গা থেকে বাল্যবিবাহের তথ্য জানানো যায়। তথ্য পাওয়ার পর হটলাইনটির সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি ওই তথ্য সংশ্লিষ্ট থানা বা জেলা প্রশাসনকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন।
এত কিছুর পরও বাল্যবিবাহ বন্ধ দূরে থাক, এটাকে সম্মানজনক পর্যায়ে কমিয়ে আনাও দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। যার দরুন বাল্যবিবাহে এশিয়ার মধ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে সর্ব শীর্ষে বাংলাদেশ।
বর্তমানে ২০-২৪ বছর বয়সী ৫১ শতাংশ নারীই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছেন।
হটলাইন কতটা কার্যকর?
হটলাইনে অভিযোগ আসার পরও সব বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যাচ্ছে না। হটলাইনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রথম আলো একবার কয়েকজন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছিল (হটলাইন ৩৩৩, বন্ধ হচ্ছে বাল্যবিবাহ, ১৮ অক্টোবর ২০১৯)। জেলা প্রশাসকেরা সে সময় জানিয়েছিলেন, ‘অনেক সময় কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দেরি হয়, ততক্ষণে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাধার কারণেও বিয়ে ঠেকানো যায় না। তাঁদের মতে, বাল্যবিবাহের পেছনে অভিভাবকদের পাশাপাশি স্থানীয় নোটারি পাবলিক ও কাজিদের অসহযোগিতা অনেকটা দায়ী। আগের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে দাবি করা হলেও গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, কোনো সচেতন মানুষ বা প্রশাসনের কেউ যদি খবর পেয়ে বিয়ের মজলিশে উপস্থিত হন, তবে তাঁকে ‘ম্যানেজ করা’ বা বানানো নতুন জন্মসনদটা দেখানো হয়। আবার এ-ও বলা হয়, ‘বিয়ে ভেঙে গেলে মেয়েকে নিয়ে সমাজে মুখ দেখাতে পারব না।’ সেই সঙ্গে আছে নিরাপত্তার প্রশ্ন ও বখাটে বা রাজনৈতিক মাস্তানদের কাছে অসহায়ত্বও। আর পয়সাওয়ালা বা প্রবাসী পাত্রের প্রতি লোভ তো আছেই। তারপরও খবর পেলেই প্রশাসন পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিয়ে বন্ধ, জরিমানা, গ্রেপ্তার, জেল ইত্যাদি হচ্ছে।
সতীদাহ বন্ধের আইন আর বিধবা নারীকে পুড়িয়ে মারার অপরাধে শাস্তির বিধান হওয়ায় অনেকেই সাহস করে চিতা থেকে অনেক নারীকে উদ্ধার করেছিলেন। তবে সেই নারীদের ঠাঁই হয়নি আপন পরিবারে বা মন্দিরে। একইভাবে বাল্যবিবাহের বলি হওয়া মেয়েরা স্কুলে ফিরতে চাইলে ফিরতে পারছে না।
প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিয়ে বন্ধ কতটা টেকসই?
গত বছর (৪ অক্টোবর ২০২২) প্রথম আলোর প্রতিবেদনে জানা যায়, সাতক্ষীরায় প্রথমবার বন্ধ করার পরও গোপনে কমপক্ষে ৭৪ শতাংশ বাল্যবিবাহ হচ্ছে। তালা উপজেলায় সরকারি দপ্তরের বরাতে বলা হয়, এক বছরে বন্ধ করা ৮৮টি বাল্যবিবাহের ৬৫টি বিয়ে পরে হয়ে গেছে। এই ছবি শুধু তালার নয়, কমবেশি সারা দেশের। গত এক মাসে দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি উপজেলা ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে গোপন বিয়ের রমরমার অনেক নজির মিলেছে। বাল্যবিবাহকে অপরাধ হিসেবে তুলে ধরে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা এবং প্রশাসনের দৃঢ়তার কারণে গোপনে এমন বিয়েও হচ্ছে, পাড়াপড়শিও জানতে পারে না, সহপাঠীরাও থাকে আঁধারে। ফলে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সহপাঠীদের রুখে দাঁড়ানোর যে ঘটনা মাঝেমধ্যে আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখি, সেসবও অনেক জায়গায় করা সম্ভব হয় না। সহপাঠীদের প্রতিরোধ গড়ে তুললে যে ফল পাওয়া সম্ভব হতো, সেখানেও আমাদের আশাহত হতে হয়।
বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের বর্জন করা কি ঠিক হচ্ছে?
সতীদাহ বন্ধের আইন আর বিধবা নারীকে পুড়িয়ে মারার অপরাধে শাস্তির বিধান হওয়ায় অনেকেই সাহস করে চিতা থেকে অনেক নারীকে উদ্ধার করেছিলেন। তবে সেই নারীদের ঠাঁই হয়নি আপন পরিবারে বা মন্দিরে। একইভাবে বাল্যবিবাহের বলি হওয়া মেয়েরা স্কুলে ফিরতে চাইলে ফিরতে পারছে না। বলা হচ্ছে, ‘ওই মেয়েরা স্কুলে গিয়ে দাম্পত্য জীবনের গল্প করলে অন্য মেয়েরাও বিয়েতে বা যৌনতায় উৎসাহিত হতে পারে।’ বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা ক্লাসে ফিরলে সহপাঠীদের কী এমন ক্ষতি হবে, তা-ও এই মুঠোফোনের দুনিয়ায় এসে এই প্রধান শিক্ষকদের কে বোঝাবে?
আরও কয়েক জায়গায় স্কুল-মাদ্রাসায় নবজাতক শিশু কোলে নিয়ে কয়েকজন বালিকা মায়ের পরীক্ষা দিতে আসার খবর আর ছবি দেখে আপ্লুত হয়েছিলাম। শিক্ষকদের সাধুবাদ দিয়েছিলেন অনেকে। মাঠপর্যায়ে গিয়ে জানলাম নেহাতই ফরম পূরণ করছিল, তাই এই বদান্যতা দেখিয়েছে স্কুল। তার মানে তারা অষ্টম কি নবম শ্রেণির হলে স্কুলের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেওয়া হতো না?
নিজের ইচ্ছায় বা মা-বাবার চাপে বিয়ের বলি হওয়া অনেক বালিকা স্কুলে ফিরতে চায়। বাল্যবিবাহের একটা বড় অংশ আবার তালাকপ্রাপ্ত বা ‘বাপের বাড়িতে রেখে আসা’র শিকার। তালা উপজেলার যে ৬৫ বালিকাকে গোপনে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে ৬ জনেরই বিচ্ছেদ ঘটে অল্প দিনের মধ্যে। নওগাঁ জেলার এক বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ জানালেন, তাঁদের এলাকায় ৬০ শতাংশের মতো বাল্যবিবাহ টিকছে না। তাঁর পাশে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনিও মাথা নাড়লেন। এরা স্কুলে ফিরতে চায়। কিন্তু দরজা বন্ধ। অনেকেই বিয়ে টিকিয়ে রেখে স্কুলে ফিরতে চায়। ঝালকাঠির এক উপজেলার নারী ভাইস চেয়ারম্যান এক মেয়েকে নিজ উদ্যোগে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। বালিকাটিকে স্কুলে টিকতে দেওয়া হয়নি।
ভুল বিয়ের কারণে ঝরে পড়া বালিকাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে না পারলে আমরা পিছিয়ে পড়ব। আমরা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজির ৪ নম্বর লক্ষ্য থেকে ক্রমেই বিচ্যুত হব।