‘ঘূর্ণিঝড়’ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৩)
সর্বশেষ হামুনের সময় টের পাওয়া গেছে কক্সবাজার রাডার কেন্দ্রের অবস্থা কতটা খারাপ। স্থানীয় অধিকাংশ মানুষ বলছেন, ঘূর্ণিঝড় এতটা শক্তিশালী হবে, সে রকম কোনো তথ্য তাঁরা পাননি। এখনো দেশে ঝড়ের মৌসুম। সুতরাং আমাদের পূর্বাভাস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাজাতে হবে।
ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালামের অমিয় বাণীগুলোর একটি হচ্ছে এমন—‘বৃষ্টি এসে বুঝিয়ে দেয় ঘরের ছিদ্র কোথায়।’ দেশের ওপর দিয়ে সম্প্রতি বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় হামুন না এলে আমরাও জানতে পারতাম না, কক্সবাজারের আবহাওয়া অফিসের করুণ অবস্থার কথা।
অফিস আছে, দালান আছে, লোকবল আছে। আছে শানশওকত, বরকন্দাজ পাহারারক্ষী, প্রবেশ নিষেধের সাইনবোর্ড। শুধু অফিসের প্রাণভ্রমর রাডারটাই বিকল। অনেক সময় আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা কর্তাদের মাজায় গুঁজে রাখতে কেবল পিস্তলের কভারটা দেওয়া হয়। পিস্তল থেকে মালখানায়। দূর থেকে মনে হবে অফিসারের কোমরে পিস্তল আছে। কক্সবাজারের আবহাওয়া অফিসের অবস্থা অনেকটা সে রকম। ‘ওপর ওপর জিন্দা বাহার, ভেতরে সব আন্ধা লাশ।’
একবার শীতের রাতে ট্রেনে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে আখাউড়া স্টেশনে খুব বড় বড় কমলা দেখে বড্ড লোভ হলো। দামও ছিল সস্তা, দরাদরিতে আরও সস্তা হয়ে গেল। ট্রেন ছাড়ি ছাড়ি অবস্থায়। দুই হালি কিনে টাকা দিতে না দিতে ট্রেন ছেড়ে দিল। খেতে গিয়ে দেখি আটটার মধ্যে তিনটিই ভেতরে ফাঁকা। খোসা আছে, ভেতরে কোষ নেই। কক্সবাজারের আবহাওয়া অফিসের অবস্থা আখাউড়ার খদ্দের ঠকানো কমলার মতো। খোসা বা খোলস আছে, ভেতরের কোষ লাপাত্তা।
কক্সবাজারে কাজে বা বেড়াতে গেছেন কিন্তু হিলটপ সার্কিট হাউসের দক্ষিণে রাডার স্টেশনটির দিকে চোখ পড়েনি বা সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি—এমন মানুষ কমই আছেন। অনেক পর্যটন গাইড বই বা কক্সবাজার পরিচিতিতে হিলটপের এই আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটিকে দর্শনীয় বস্তুর তালিকা রাখা হয়েছে। আইয়ুব খান তখনকার পূর্ব পাকিস্তানকে চমকে দেওয়ার মতো অনেক ইমারত গড়ে তুলেছিলেন। এই স্থাপনাটি তাঁর ঘোষিত উন্নয়ন দশকের শেষ বছরে অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে উদ্বোধন করা হয়।
বলা বাহুল্য, এর এক বছর পরে আইয়ুব খানের গদি উল্টে যায়। সেনাবাহিনী ১৯৬৯ সালে আবার সরাসরি ক্ষমতা দখল করে তাঁকে বিশ্রামে পাঠিয়ে দেয়। যাই হোক, সেটা অন্য গল্প। হিলটপের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটি আসলে পাকিস্তানের বাজেট থেকে আসেনি, এসেছিল সুইডিশ শিশুকল্যাণ সংস্থা থেকে। সুইডিশ শিশুকল্যাণ সংস্থা আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও ক্রিসেন্ট সোসাইটির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলে তৎকালীন আইয়ুব খান সরকার। রাডার স্থাপন আর সেটা পরিচালনার জন্য লোকবল নিয়োগের কাজটিও ওই সংস্থা করে।
দেশব্যাপী ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, শৈত্যপ্রবাহসহ যাবতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস এখান থেকেই দেওয়া হয়। কক্সবাজারের রাডার স্টেশনটি ডপলার রাডার স্টেশন। সেই ১৯৬৮ সালের এই রাডার ব্যবস্থায় আমাদের নির্ভরতা অনেক। এ ধরনের রাডার স্টেশনের দম থাকে ১০ বছর। সর্বশেষ ২০০৭ সালে জাপান সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় এই রাডারের দম নবায়নের কাজ করা হয়। এরপর ১৫ বছরের বেশি সময় কেটে গেছে।
টুথ পেস্টের বাতিল টিউব থেকে পেস্ট বের করার কৌশল সব জায়গায় চলে না। এরপরও জোড়াতালি দিয়ে চালানোর চেষ্টা জারি ছিল। কিন্তু হামুনের অনেক আগে থেকেই রাডারটি একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কোনো ‘ঝাড়ফুঁক, পানি পড়া, চাল পড়ায়’ কাজ হয়নি। বলা হয়, ডপলার রাডারটি মাধ্যমে কক্সবাজার স্টেশন থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরবর্তী সমুদ্র এলাকার আবহাওয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এখন আর তা হচ্ছে না।
শক্তি নবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেটি এখন ‘শ্বেত হস্তী’ হয়েছে মাত্র। রাডারটি সুস্থ–স্বাভাবিক থাকলে কক্সবাজারের আবহাওয়া অফিস হামুনের গতিবিধির ওপর আরও নিবিড়ভাবে দৃষ্টি রাখতে পারত।
ঝড়ের দিন কক্সবাজার অঞ্চলে থাকা সবাই এক বাক্যে বলেছেন, তাঁরা এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। জীবনে হামুনের মতো ভয়াবহ তাণ্ডব তাঁরা আর দেখেননি। অবশ্য ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে এই হামুনের তুলনা চলে না। এরপরও এই অঞ্চলে সে সময়ের পর এমন ঘূর্ণিঝড় আর আঘাত হানেনি।
একানব্বইয়ের ভয়াল সেই ঘূর্ণিঝড়ের সময় যাঁদের বয়স চার-পাঁচ বছর ছিল, তাঁরা এখন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। তাঁদের সেই সময়ের তাণ্ডব মনে থাকার কথা নয়। আর এই অঞ্চলের যাঁদের জন্ম ১৯৯১ সালের পরে, তাঁরা তো ভালোভাবে জানেনই না, তুফান কী জিনিস। তাঁদের সবাই বলেছেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘূর্ণিঝড় হঠাৎ করে ভয়াবহ রূপ নেয়। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় পাননি তাঁরা। এমনকি দুর্যোগ–পূর্বকালীন কোনো সতর্কবার্তাও তাঁরা পাননি।
সতর্কবার্তা পেলে কি তাঁরা বুঝতেন?
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়ের কয়টি সতর্কবার্তা আছে, আর কী তাঁর অর্থ, সেটা ভালোভাবে জানতে প্রশ্ন করেছিলাম কক্সবাজারে কর্মরত এক বেতারকর্মীকে। বিপৎসংকেত ৫, ৬, ৭—এগুলোর মধ্যে যে ঝড়ের গতির কোনো রকমফের নেই, সেটা সেদিন তিনি প্রথম জানলেন। একইভাবে ৭, ৮, ৯ বিপৎসংকেত যে একই গতির ঝড়ের কথা বলে, সেটা জেনে তিনি তাজ্জব হলেন। বললেন, ‘এত প্যাঁচগোছ কেন?’
বিপৎসংকেতগুলো বন্দরভিত্তিক বন্দরের ডান বরাবর না বাঁ বরাবর নাকি মাঝ বরাবর—এসব নির্ণয় করতেই একই কাতারে রাখা হয়েছে ৫, ৬, ৭ আর ৮, ৯, ১০ বিপৎসংকেত। একটু দম নিয়ে আবার বলি, দম ফুরালে ১১ নম্বর। সেটাও ঝড়ের গতিকে নির্দেশ করে না; নির্দেশ করে সেই পরিস্থিতিকে, যখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আবহাওয়ার বিপৎসংকেত দেওয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে উপদ্রুত অঞ্চলের সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। স্থানীয় আবহাওয়া কর্মকর্তা এই পরিস্থিতিকে দুর্যোগপূর্ণ বলে মনে করেন। ঝড়ের প্রবলতা ছাড়াও অন্যান্য কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। নাশকতা থেকে শুরু করে নানা কারণে সেটা হতে পারে। এ রকম পরিস্থিতিতে স্থানীয় রাডারগুলো মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছানোর জন্য স্থানীয় বেতার কেন্দ্র আর কমিউনিটি বেতারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে পারে।
তা ছাড়া ‘দ্রুত উত্থান ও আবার দ্রুত পতন’ এমন স্বভাব নিয়ে জন্মানো হামুন কিছিমের ঝড়ের খবরাখবর জানার জন্য আর লোকালয়ের মানুষের কাছে ঝড়ের সঠিক গতিবিধি জানানোর ক্ষেত্রে উপদ্রুত অঞ্চলের কাছাকাছি থাকা রাডারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাডারটাই যদি ঝড়ের আগে শুয়ে পড়ে বা অকেজো হয়ে যায়, মেরামতের বাজেটের জন্য ‘দাতা হাতেম তাই’দের খুঁজতে হয়, তাহলে কীভাবে চলবে।
ডপলার রাডার শুধু ঝড়ের সময় নয়, বরং সারা বছর আবহাওয়ার নানা তথ্য–উপাত্ত দিয়ে কৃষি এবং বনায়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সে বিষয়টি আমলে নিয়ে রংপুরে একটি ডাপলার রাডার স্টেশন কাম আবহাওয়া অফিস বসানো হয়েছিল। জন্মনিবন্ধন কার্যালয়ের সার্ভার যেমন কথায় কথায় ‘ডাউন’ হয়ে যায়, তেমনি অকেজো ছিল রাডারটি।
রংপুরের রাডারের খবর হয়েছে
সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় থাকলে কী হতো আল্লাহ মালুম, তবে রংপুরের রাডারটিও গত ১২–১৩ বছর যাবৎ কোমায় ছিল। চলতি বছর (৩১ মার্চ) রংপুর আবহাওয়া অফিস প্রাঙ্গণে নতুন রাডার ভবনের কাজ শুরু হয়েছে।
এখানেও জায়গা আমাদের, আর টাকা জাপানের (জাইকা)। কাজ শেষ হতে বছর দু-এক লেগে যাবে। সব ঠিকঠাক চললে আগামী ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ ডপলার রাডার স্টেশনটি চালু করা সম্ভব হবে। এই রাডার কেন্দ্র স্থাপনে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার অনুদান থাকছে ১৯৫ কোটি টাকা। রাডারটি ঠিকমতো চালু রাখতে পারলে কৃষকদের কাছে আগাম বৃষ্টিপাতের তথ্য দেওয়া সম্ভব হবে। এসব তথ্য কৃষকদের ফসল রক্ষা এবং সময় ও জাত নির্বাচনে সহায়তা করবে। সেই সঙ্গে রংপুর অঞ্চলের আবহাওয়ার অবস্থা ও পরিবর্তনজনিত কারণগুলো গবেষণা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
আশা করা যাচ্ছে, নির্মাণাধীন এই রাডারের মাধ্যমে রংপুর আবহাওয়া কেন্দ্র থেকে চারদিকে ৪০০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়, মেঘের গতিবিধি, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, বজ্রপাতসহ আবহাওয়ার আগাম নানা তথ্য দেওয়া সম্ভব হবে। দুর্যোগের আগে তথ্য পাওয়ায় কৃষকসহ সাধারণ মানুষকে সঠিকভাবে পূর্বাভাস দেওয়া যাবে। কালবৈশাখী মেঘের অস্তিত্ব, টর্নেডোর মেঘ, বজ্রপাতের ধরন সম্পর্কে আগাম তথ্য দিতে পারবে এই রাডার।
তথ্য কৃষকের কাছে পৌঁছানোর কী বিধান
রাডার তথ্য দেবে, কর্মীরা সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে বার্তা তৈরি করবে। কিন্তু স্থানীয় মানুষের কাছে, কৃষকের কাছে তাঁদের প্রয়োজনের সময় সেই তথ্য পৌঁছাবে কীভাবে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মুন্সিগঞ্জের ৬৮টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছিল কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস তথ্যকেন্দ্র।
উদ্দেশ্য ছিল ঝড়বৃষ্টি,আর্দ্রতা আর খরার আগাম খবর কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়ন করেছিল বিশ্বব্যাংক। প্রতিটি তথ্য বোর্ড ও রেইন গেজ মিটার বসানো বাবদ ব্যয় হয় প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকা।
চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। মনে হচ্ছে, এটিও আরেকটি ‘খেল খতম পয়সা হজম’ মার্কা প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। কৃষকদের অভিযোগ, এই প্রকল্পের বিন্দুবিসর্গ তাঁদের জানা ছিল না। কৃষি কর্মকর্তারাও তাঁদের কিছু জানাননি। গণমাধ্যমকে স্থানীয় এক কৃষক জানিয়েছিলেন, বিগত কয়েক বছরে একবারের জন্যও এসবের দেখভাল করেনি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে কৃষি খাতের গুরুত্বপূর্ণ এসব যন্ত্র।
আমাদের দেশে সাধারণত বৈশাখ–জ্যৈষ্ঠ এবং আশ্বিন–কার্তিক–অগ্রহায়ণ—এই সময়ে ঝড়–ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। সুতরাং আমরা ঝড়ের মৌসুমে আছি। সুতরাং আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে পূর্বাভাস ব্যবস্থাপনাকে।
আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্রের কলকবজা বিগড়ে রেখে এটা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি শুধু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেই চলবে না। মানুষের বোধগম্য ভাষায় মানুষকে সম্পৃক্ত করে আমাদের পূর্বাভাস আর সতর্কীকরণ ব্যবস্থাপনা সাজাতে হবে।