‘ভবন করায় সেন্টমার্টিনের মাটির গভীরে আর প্রবালের অস্তিত্ব নেই, ঝুঁকিও বেশি’

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারে পত্রিকায় সঙ্গে সাক্ষাৎকালে এ তথ্য জানান গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ:১৩ মে ২০২৩ )

পৃথিবীর প্রবাল দ্বীপগুলো ঘূর্ণিঝড় থেকে নিরাপদ সবসময়। কারণ, এমন এক জায়গায় প্রবাল দ্বীপগুলো গড়ে ওঠে, যেখানে সাগর খুব শান্ত থাকে। তা না হলে প্রবাল দ্বীপ গড়ে উঠতে পারে না। কিন্তু, আমরা যেটা করেছি, সেন্টমার্টিনকে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করে অনেক ভবন গড়ে তুলেছি। সেখানে তো মাটির গভীরে প্রবালই ছিল। কিন্তু আমরা সেগুলো উঠিয়ে ফেলে ভবন তৈরি করেছি। সেখানে এখন আর প্রবালের অস্তিত্ব নেই। ফলে ঝুঁকিও এখন বেশি।

‘নিয়ম অনুযায়ী ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেওয়ার পরপরই নৌ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে। কেউ আর কোনোভাবেই আসতে পারবে না। তাদের যদি উদ্ধার করতে হয়, তাহলে এমন কোনো নৌযানের ব্যবস্থা করতে হবে, যেটা এই ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আসতে পারে।’

সেন্টমার্টিনকে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করে মাটির গভীরে থাকা প্রবাল ভেঙে ভবন নির্মাণ করায় এখন সেখানকার ঝুঁকি বেড়েছে। ফলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে সেখানকার উঁচু ভবনগুলো টিকে থাকবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোখা ঘিরে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা। তার মতে, এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ে শেষ মুহূর্তে হলেও মানুষগুলোকে সরিয়ে আনতে সরকারিভাবে যথাযথ কোনো পরিকল্পনাও নেই।


ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সেন্টমার্টিন থেকে যারা ইতোমধ্যে টেকনাফে চলে গেছেন, তাদের ভাগ্যবান উল্লেখ করে গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেওয়ার পরপরই নৌ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে। কেউ আর কোনোভাবেই আসতে পারবে না। তাদের যদি উদ্ধার করতে হয়, তাহলে এমন কোনো নৌযানের ব্যবস্থা করতে হবে, যেটা এই ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিয়ে আসতে পারে।’

‘এখন উড়িরচর বা নিঝুম দ্বীপে যে অন্তঃসত্ত্বা নারী আছেন, যে হাতিয়ায় না গেলে বিপদে পড়ে যাবে, তার কী হবে? এখানে আমাদের সেই ব্যবস্থাপনাটা রাখতে হবে যাতে যাদের জরুরি ভিত্তিতে সরানো দরকার, সেটা যাতে করা যায়। আমাদের অনেক হেলিকপ্টার আছে যার মাধ্যমে আমরা খাবার বিতরণ বা আগুন নেভানোর ভুল মোহরা দিয়ে থাকি। এখন সেগুলোর মাধ্যমে এমন একটা ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল যাতে জরুরি ভিত্তিতে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া যায়। সবাইকে তো আর আনার দরকার নেই বা সবাই আসবেও না। কিন্তু যাদের জরুরিভিত্তিতে দরকার, তাদের বিষয়টি আলাদাভাবে দেখা দরকার। ৩ নম্বর সংকেত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার নিয়ম থাকায় যাদের নিজেদের নৌকা আছে বা মোটামুটি কষ্ট হলেও যেতে পারত, তারাও তো যেতে পারবে না।’

‘তো সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে সেন্টমার্টিন থেকে যারা এসেছেন তারা ভাগ্যবান। কিন্তু সবার পক্ষে তো আসা সম্ভব না। সরিয়ে নেওয়ার এই পরিকল্পনাটা আমাদের কারো মধ্যে নেই।’

এবারের ঘূর্ণিঝড় কি সত্যিই অন্যবারের চেয়ে আলাদা বা বেশি বিপজ্জনক কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়টি কত বেগে আসছে, ঝড় কত বড়, সেটার ওপর বিপদ নির্ভর করে না। ঝড়ের পতনের সময়ের সঙ্গে জোয়ারের সময় এক হয়ে যাচ্ছে কি না, সেটা দেখতে হবে। ১৯৯১ সালের পরে এমনটি আর কখনো হয়নি। যখন জোয়ার এসেছে, সে সময় সাইক্লোন আঘাত হানেনি। যদি জোয়ারের সময় সাইক্লোন আঘাত হানে, তাহলে কম বাতাসের গতি থাকলেও বড় জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। যেমন: কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর কিছু জায়গা আছে, সেখানে বেড়িবাঁধও সেভাবে নেই। কুতুবদিয়ার একটি অংশে আছে, বাকি অংশ অরক্ষিত। ফলে সেখানে বড় ধরনের দুর্যোগ হওয়ার আশঙ্কা আছে। যদি বাতাসের গতিবেগ যদি ২৫০-২৬০ নাও হয়, কিন্তু যদি এটা জোয়ারের সঙ্গে কো-ইনসাইড করে, তাহলে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।’

জোয়ারের সঙ্গে মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে কি না? এই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সাইক্লোনের যাত্রা মাঝখানে কিছুক্ষণ থেমে গিয়েছিল, এখন আবার আসছে। এটা এত আগে ধারণা করা সম্ভব না। তবে স্থানীয়রা পারবে। ঢাকার দিকে তাকিয়ে না থেকে কুতুবদিয়ায় যিনি আছেন, কুতুবদিয়ায় যদি আবহাওয়া অফিস থাকে বা কুতুবদিয়ার ইউএনও তা বলতে পারবেন যে আজকে কয়টার সময় জোয়ার, কখন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে, তাকে এই সিদ্ধান্তটা নিতে হবে। আমাদের এখানে সবকিছু কেন্দ্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। ফলে যখন জানা যায়, তখন হয়তো উপদ্রুত অঞ্চলের সঙ্গে আর যোগাযোগ থাকে না। কিন্তু স্থানীয়ভাবেও জোয়ার আর সাইক্লোনের পতনের সময়টা হিসাব করা যায়।এখন যেটা বলা হচ্ছে, আজকে রাত থেকে কালকে সন্ধ্যার মধ্যে যেকোনো সময় সাইক্লোন আঘাত হানতে পারে সেই সঙ্গে জোয়ারের সময়টাও উল্লেখ করতে হবে। তাহলে ভয়াবহতার হিসাবটা কষা সহজ হবে। জোয়ারের তো একটা নির্দিষ্ট সময় আছে, জোয়ার সময় মেনেই আসে আগে বা পরে না।’

যেটা নিয়ে শঙ্কা হচ্ছে, তা হলো যদি তেমন বিপদ আসে, তাহলে সেই উঁচু ভবনগুলো টিকবে কি না। কোনো প্রবাল দ্বীপে এত বড় বড় স্থাপনা করলে প্রবাল দ্বীপ থাকবে না। মাটির নিচের প্রবাল ভেঙেই তারা ভীত করেছে, যা খুবই অন্যায়। প্রবাল দ্বীপমালার দেশ মালদ্বীপে বহুতল ভবন নিষিদ্ধ।

আঘাত হানার কতক্ষণ আগে সুনির্দিষ্ট করে বোঝা যাবে যে ঘূর্ণিঝড় ঠিক কখন আঘাত হানবে? জানতে চাইলে গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘৫-৬ ঘণ্টা আগে সেটা খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় জিনিসটা এরকম যে সেটা যেকোনো সময় থেমে গিয়ে আবার বাঁক নিয়ে শক্তি অর্জন করে এগোতে পারে। স্থানীয় অনেকগুলো বিষয়ের ওপর এটা নির্ভর করে। যেমন: এখন বান্দরবানে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, হয়তো কক্সবাজারেও বৃষ্টি শুরু হবে। বৃষ্টি শুরু হলে সাইক্লোনের আঘাত দেওয়ার ক্ষমতা অনেক কমে যাবে। ঢাকায় ৪ দিন আগে যে গরম ছিল, তা এখন নেই। আমার মনে হয় ওইসব অঞ্চলেও বৃষ্টি হওয়ার কারণে গরম কমে গেছে। যদি বৃষ্টি আরও হয়, তাহলে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত করার ক্ষমতা আরও কমে যাবে।’

সেন্টমার্টিনের স্থানীয় এক পর্যটন ব্যবসায়ী টেলিফোনে ৫ মিনিটের ব্যবধানে সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠার তথ্য জানালেন। সেই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব কমে যাবে। তখন হয়তো জোয়ারের সময় এসেছে। এটা খুব ভালো হয়েছে যে এবার সেন্টমার্টিন নিয়ে কথা হচ্ছে। পৃথিবীর প্রবাল দ্বীপগুলো ঘূর্ণিঝড় থেকে নিরাপদ সবসময়। কারণ, এমন এক জায়গায় প্রবাল দ্বীপগুলো গড়ে ওঠে, যেখানে সাগর খুব শান্ত থাকে। তা না হলে প্রবাল দ্বীপ গড়ে উঠতে পারে না। কিন্তু, আমরা যেটা করেছি, সেন্টমার্টিনকে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করে অনেক ভবন গড়ে তুলেছি। সেখানে তো মাটির গভীরে প্রবালই ছিল। কিন্তু আমরা সেগুলো উঠিয়ে ফেলে ভবন তৈরি করেছি। সেখানে এখন আর প্রবালের অস্তিত্ব নেই। ফলে ঝুঁকিও এখন বেশি। এখন যেটা নিয়ে শঙ্কা হচ্ছে, তা হলো যদি তেমন বিপদ আসে, তাহলে সেই উঁচু ভবনগুলো টিকবে কি না। কোনো প্রবাল দ্বীপে এত বড় বড় স্থাপনা করলে প্রবাল দ্বীপ থাকবে না। মাটির নিচের প্রবাল ভেঙেই তারা ভীত করেছে, যা খুবই অন্যায়। প্রবাল দ্বীপমালার দেশ মালদ্বীপে বহুতল ভবন নিষিদ্ধ।’

যথাসম্ভব পানীয় জল কনটেইনারে ধরে রাখতে হবে। কারণ, ঘূর্ণিঝড় শেষে খাওয়া, রান্না ও গোসলের পানির একটা অভাব হবে। এগুলো খুব সহজেই করা সম্ভব।

সর্বশেষ মোখা নিয়ে করণীয় বিষয়ে গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘ঝড় তো আমরা ঠেকাতে পারব না। কিন্তু ঝড়ের পরে কিছু কাজ করতে হবে। যেমন: যদি সত্যিই জলোচ্ছ্বাস হয়, তাহলে আমাদের সব পানির আধারগুলো লবণ জলে ঢেকে যাবে। এখন সেটার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। পাম্প রেডি করে রাখতে হবে। যাতে ঝড়ের পর বৃষ্টির পানিটা ধরে রাখা যায়, যেন মানুষ সেটা ব্যবহার করতে পারে।’

‘আর এখনো যতটুকু সময় আছে, যথাসম্ভব পানীয় জল কনটেইনারে ধরে রাখতে হবে। কারণ, ঘূর্ণিঝড় শেষে খাওয়া, রান্না ও গোসলের পানির একটা অভাব হবে। এগুলো খুব সহজেই করা সম্ভব। আর আমাদের স্কুলগুলো তো আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হবে। এখন ঘূর্ণিঝড় শেষ হওয়ার পরপরই যেন সেগুলো ব্যবহার করা যায়, যাতে স্কুল খুলতে বিলম্ব না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনিতেই ২ বছর বন্ধ ছিল।’ সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা সবাই ফেরত আসেনি। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় অনেকে দিক হারিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যেতে পারে, তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের তৎপর থাকতে হবে। গত ঝড়ে দিকহারা অনেক জেলে এখনো ইণ্ডিয়ার কারাগারে।’

আজ দুপুরে আবহাওয়া অধিদপ্তরে পরিচালক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোখা উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অর্থাৎ তা আমাদের টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ঝড়ের কেন্দ্রের পরিধি ৭৪ কিলোমিটার। এটি যদি সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ দিয়ে অতিক্রম করে তারপরও টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে কেন্দ্রের প্রভাব পড়বে।’

Leave a Reply