মঙ্গলের বর্ষা কেন অমঙ্গল বয়ে আনছে?

নৌ-দুর্ঘটনা’ নিয়ে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ:  ০৭ আগস্ট ২০২৩)

শনিবার রাত সোয়া ৮টার ঘটনা। বালুবাহী বাল্কহেড নামের নৌযানের ধাক্কায় ডুবে যায় পিকনিক-ফেরত যাত্রীভরা ট্রলার। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিখোঁজ পাঁচজন, মৃত আট। মর্মান্তিক ঘটনার ভেতরে যাওয়ার আগেই মাথায় প্রশ্ন জাগে, যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে সন্ধ্যার পর বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। তাহলে রাতের বেলা কীভাবে চলতে পারল এই যান? দোষ দেব কাকে? কর্তৃপক্ষকে, নাকি বাল্কহেডের মালিক-চালকপক্ষকে?

বৃষ্টিতে পা পিছলে পড়ে যাওয়া সহপাঠীকে বাঁচাতে গিয়ে লেকের পানিতে ডুবে মারা গেলেন গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) দুই শিক্ষার্থী। এই মৃত্যুর খবরে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে আমার এক প্রাক্তন ছাত্রী লিখেছে, ‘মরণফাঁদ তৈরি করে গেছেন ভিসি নাসির (কেএম নাসিরুদ্দিন)। এত এত বাজেটে… এত উঁচু ঢাল দিয়ে কীভাবে লেক বানাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? এ রকম মরণফাঁদের চারপাশে নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাই বা নেই কেন? সে জবাব কে দেবে?’

উদ্ধারে যাওয়া সহপাঠীরা জানিয়েছেন, অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়নি সময়মতো। দেহে জীবনের স্পন্দন থাকলেও উদ্ধারের পর সময় নষ্ট হয়েছে অনেক। তাই তাদের বাঁচানো যায়নি। পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক চিকিৎসা কেন শেখানো হয় না? পানিতে ডুবতে থাকা মানুষকে হাসপাতালে নেওয়ার আগে যেসব ব্যবস্থা নিতে হয়, সেগুলো কি মানুষকে শেখানো হয়? নাকি আমরা শুধু বিভাগ খুলছি নিজেদের চাকরি তৈরির জন্য? কার কাছে, কোন রাজনৈতিক পরিচয়ে এসব প্রশ্ন করা যাবে?

গড়াই নদীতে হারিয়ে যাওয়া তরুণকে পাওয়া যাচ্ছে না। টিভির স্ক্রলে লেখা আসছিল, কুষ্টিয়ার গড়াই নদীতে বন্ধুদের সঙ্গে নৌকায় পিকনিক করতে গিয়ে নদীতে পড়ে শুভ ইসলাম (১৮) নিখোঁজ হয়েছে। ঘটনার ২২ ঘণ্টা পরও নদীতে ফায়ার সার্ভিস ও খুলনা থেকে আসা ডুবুরি দল উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে।

বর্ষার দেশের মানুষ আমরা, সাঁতার জানব না; নদীর হালচাল বুঝব না; উদ্ধারের উপায় জানব না– তা কী করে হয়?

এসব দেখতে দেখতে রাত ১১টার দিকে আব্দুল কাদেরের ফোন আসে। বিরক্তির সঙ্গেই ফোনটা ধরি, সকালে আমাদের গাজীপুর যাওয়ার কথা। ‘যাত্রা বাতিল’ কথাটা লৌহজংয়ের রসকাঠির কাদেরের সবচেয়ে প্রিয় রসিকতা। কাদেরের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে ফোনে, ‘আমি খালপাড়ের কাছেই ছিলাম। হঠাৎ খুব জোরে শব্দ পাই। চিৎকার-কান্নাকাটি শুনে দৌড়ে খালপাড়ে গিয়ে দেখি এক ট্রলার ডুবতেছে। আর মানুষ বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার দিচ্ছে।’ রাত ১১টার মধ্যে আটজনের লাশ উদ্ধার হয়। নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারের কাজ বন্ধ হয়নি।

পরের ঘটনা একই চিত্রনাট্যের পুনরাবৃত্তি। বাল্কহেডটি আটক করা হয়েছে। কিন্তু চালকসহ বাকিরা পলাতক। পুলিশ তাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে জোর অভিযান চালাচ্ছে। পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে ইনশাআল্লাহ।

কাকে বলে বাল্কহেড

বাল্কহেড শব্দটি জাহাজ নির্মাণের অভিধান থেকে এসেছে। জাহাজের মধ্যে জলরোধক বেষ্টনী বা বিভাজক বা পার্টিশনকে বাল্কহেড বলে। মূলত জাহাজের কাঠামোগত অনমনীয়তা বাড়ানোর জন্যই বাল্কহেড ব্যবস্থার উদ্ভাবন; সেই নামে আমাদের নদীতে যেগুলো চলাচল করে। আসলে এসব স্রেফ বালুসহ বিভিন্ন মালপত্র বহনকারী ইঞ্জিনচালিত ট্রলার। নামের সঙ্গে চেহারা বা গড়নের কোনো মিল নেই।

রাতে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে মেঘনাসহ অধিকাংশ নদীতে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা লালবাতিই বাল্কহেডের অবস্থান নির্দেশ করে। নদীতে কোনোরকমে মাথা জাগিয়ে চলা এসব যানের রাতের চলাফেরায় একটা বেপরোয়া ভাব ফুটে ওঠে। বাল্কহেডের মারমুখী আর বেয়াড়া চলাফেরা শুধু যে বর্ষাতে ঘটে; তা নয়। সারাবছর তাদের নিত্য চলাচল আর দুর্ঘটনা।

২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের কলাগাছিয়ায় মেঘনা-ধলেশ্বরী নদীর মোহনায় ঢাকা থেকে বরিশালগামী লঞ্চ সুরভী-৭ এর সঙ্গে এক বাল্কহেডের সংঘর্ষ হয়। রাতের মেঘনায় চারদিকে অগণিত বাল্কহেডের টিপটিপ জ্বলতে থাকা আপাত দর্শনীয় লালবাতি যে কী ভয়ানক হতে পারে, সেটা আগে কখনও চিন্তায় আসেনি। পাঁচশর বেশি যাত্রী ছিল সেই লঞ্চে। দেখছি লঞ্চের বাঁ পাশ ধরে পাশাপাশি দুটি বাল্কহেড বেপরোয়া গতিতে ধলেশ্বরী নদীতে প্রবেশ করছে। ডান পাশ থেকে আসা আরেকটি পণ্যবাহী জাহাজ সামনে পড়ে যাওয়ায় একটা বাল্কহেড নিজেকে বাঁচাতে সুরভী-৭ লঞ্চের সামনে দিয়ে হঠাৎ আড়াআড়ি হয়ে অতিক্রম করতে শুরু করে। বাল্কহেডটি আচমকা সামনে পড়ে যাওয়ায় লঞ্চের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি সারেং। ফলে ধাক্কা লেগে বাল্কহেডটি ডুবে যায়। লঞ্চের সামনের দিকে ফুটো হয়ে যায়। হুহু করে পানি ঢুকতে থাকে। প্রবল ধাক্কা সামলাতে না পেরে অনেকে আহত হন। শেষ পর্যন্ত সারেং অনেক কসরত করে লঞ্চটি নিরাপদে তীরে ভেড়াতে পারলেও নদীর মধ্যে যে ভীতিকর অবস্থা আর আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল, তা সহজে ভোলার নয়। সংঘর্ষে বাল্কহেডের এক শ্রমিক পানিতে তলিয়ে যায়। লঞ্চের সার্চলাইটে সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য সেদিন যারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাদের অনেকে এখনও শিউরে ওঠেন।

বাল্কহেড নিয়ন্ত্রণ আর জবাবদিহির পরিবেশ তৈরি ছাড়া নদীপথ বিপদমুক্ত রাখা যাবে না। সন্ধ্যার আগেই সব বাল্কহেডকে তাদের চলাফেরা বন্ধ করে দিতে হবে। ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় সদরঘাটের একটা ঘরে বসেই কে কোথায়, তা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। অভিযোগ, বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পুলিশকে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা মাসোহারা দিয়ে মালিকরা বাল্কহেড পরিচালনা করছে। অভিযোগ খণ্ডনের দায়িত্ব অবশ্য কর্তৃপক্ষের। নকশা নিয়ে জটিলতা, হয়রানি ও বড় অঙ্কের উৎকোচ দাবি করা হয় বল অনেকে অনুমোদন বা নিবন্ধন নিতে আগ্রহী হয়নি– এমন অভিযোগও রয়েছে। নিবন্ধন ও নকশা অনুমোদনের কাজটা সহজ করলে মানুষ অযথা হ্যাপার মধ্যে যাবে না। নিবন্ধনহীন বাল্কহেড দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে গেলে তা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। কাউকে না কাউকে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা তো বাঁধতেই হবে।

Leave a Reply