মফস্‌সলের অসুখ কুষ্ঠ কমছে, না বাড়ছে?

চিকিৎসা’ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ:  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

প্রান্তিক খেটে খাওয়া ও অপুষ্টিতে ভোগা গরিব মানুষেরা সাধারণত কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হন। এ কারণে জনস্বাস্থ্যবিদেরা কুষ্ঠকে ‘অবহেলিত’ রোগ হিসেবে বিবেচনা করেন।

কিছুদিন আগে বন্ধুদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, এই শীতে ভেজালমুক্ত খেজুরের গুড়ের সন্ধানে কোথায় যাওয়া যায় তা নিয়ে। গুড়ের জন্য মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার নামডাক চিরকালীন। কিন্তু বন্ধুরা কেউ সায় দিল না। মেহেরপুর এখন রেড জোন। কুষ্ঠরোগ নাকি সেখানকার কয়েকটি এলাকায় এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে বাইরের কেউ আর সেদিকে যাচ্ছে না।

খবর নিয়ে জানা গেল, গাংনী উপজেলার কল্যাণপুর, করমদি, হিন্দা, মুজিবনগর উপজেলার সোনাপুর, শিবপুর, আনন্দবাসসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে এ রোগীর সংখ্যা। মেহেরপুর জেলায় ২০১৬ সাল থেকে কুষ্ঠরোগের ব্যাপক বিস্তার নজরে আসে। সে বছর হঠাৎ নাকি ৪০ জন রোগীর মধ্যে ভয়াবহ মাত্রায় কুষ্ঠরোগের সংক্রমণ পাওয়া যায় জেলার বিভিন্ন এলাকায়।

রেড জোন কী
প্রতি লাখ জনসংখ্যায় পাঁচজনের বেশি কুষ্ঠ রোগী থাকলে সেই এলাকাকে লাল চিহ্নিত এলাকা বা রেড জোন হিসেবে গণ্য করে স্বাস্থ্য বিভাগ। এমনই লালচিহ্নিত ১০টি জেলার মধ্যে সীমান্তবর্তী একটি জেলা মেহেরপুর। অন্য যে জেলাগুলো রেড জোন বলে ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট ও মৌলভীবাজার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত রোগীর হার প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে ১ জনের নিচে নামিয়ে আনা। প্রায় ২৬ বছর আগে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। বলে রাখা ভালো, পাশের দেশ ভারত এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে আমাদের অনেক পরে, ২০০৫ সালে। কুষ্ঠমুক্ত ঘোষিত হওয়ার পরও দেশের কোথাও কোথাও রোগটি থেকে যাওয়া এবং প্রতিবেশী দেশ থেকে মানুষের অবাধ আসা-যাওয়াকে রেড জোন এলাকার ব্যাপ্তি না কমার একটা কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।

গত জানুয়ারিতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে সিলেট কুষ্ঠ হাসপাতালের নানা সংকটের কথা জানা যায়। এ হাসপাতালে সহকারী স্টাফ নার্স হিসেবে পাঁচটি পদ থাকলেও সব পদই শূন্য। অফিস সহায়কের নয়টি পদ থাকলেও এর বিপরীতে কোনো লোক নেই। কুষ্ঠ রোগীদের জন্য বিশেষ জুতা তৈরির জন্য একজন কর্মী থাকার কথা হাসপাতালে, এই পদ ২০২১ সাল থেকে শূন্য।

যেকোনো ছোঁয়াচে রোগের নতুন সংক্রমণ বৃদ্ধি সব সময়ই চিন্তার বিষয়। কুষ্ঠরোগের মতো মহারোগের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। ভারতের ন্যাশনাল লেপ্রসি ইরাডিকেশন প্রোগ্রাম তাদের অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০১২-তে বলছে, কুষ্ঠমুক্ত ঘোষণার পাঁচ-ছয় বছর পর থেকে আবার নতুন কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ কিছু কিছু রাজ্যে নতুন কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা কমা তো দূরের কথা, আগের বছরগুলোর চেয়ে ক্রমে বেড়েই চলেছে। গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রতি বছর দুই লাখের ওপর নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এর ৫৬ শতাংশই শনাক্ত হয়েছে ভারতে। এরপর আছে ব্রাজিল (১৩.৬%), ইন্দোনেশিয়া (৮.৫%), নেপাল (১.৯%) ও বাংলাদেশ (১.৮%)। বাংলাদেশে সরকারের বাইরে কুষ্ঠরোগ নিয়ে কাজ করে—এমন বিদেশি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব মতে এখনো বছরে নতুন করে প্রায় চার হাজার মানুষ কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হচ্ছে বাংলাদেশে।

কাদের হয় এই রোগ
কুষ্ঠ ‘সভ্যতার মতোই প্রাচীন’। প্রান্তিক খেটে খাওয়া ও অপুষ্টিতে আক্রান্ত গরিব মানুষদের জাপটে এখনো এই রোগ টিকে আছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা কুষ্ঠকে ‘নেগলেকটেড ডিজিজ’ বা অবহেলিত রোগব্যাধি হিসাবে ব্রাকেটবন্দী করেছেন। কেন অবহেলিত? বলা যায়, কুষ্ঠ গরিবের রোগ। তাই গরিবের মতো এই রোগও অবহেলিত।

সিলেট বিভাগের সিভিল সার্জন অফিসের হিসাব দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। তাদের হিসাব বলছে, কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে মৌলভীবাজারে প্রায় ৯৮, সিলেটে ৬৫ ও হবিগঞ্জে ৭২ শতাংশ চা-শ্রমিক পরিবারের। বলা বাহুল্য, এরা ওই অঞ্চলের সবচেয়ে অবহেলিত দরিদ্র জনগোষ্ঠী। মেহেরপুরের গ্রামগুলোতেও গরিব মানুষদের মধ্যেই এই রোগ ছড়িয়েছে বেশি।

চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠ একটি মৃদু সংক্রামক রোগ, তবে দুর্বল প্রতিরোধক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিরা এ রোগে আক্রান্ত হয় বেশি। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, প্রচুর আলো-বাতাসের অভাব ইত্যাদি এই রোগ সংক্রমণের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। আগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কেবল বয়স্ক মানুষের দেখা যেত, এখন শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এটা দেখা যাচ্ছে।

শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা কীভাবে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, এটা একটা আলাদা করে চিন্তার বিষয়। নতুন সংক্রমণ যখন অপ্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ছড়ায়, তখন বুঝতে হবে নতুন করে আরেক প্রজন্মের ওপর এই রোগের থাবা পড়ল। যে পথেই সংক্রমণ হয়ে থাকুক, নতুন সংক্রমণ রুখতে, বিশেষ করে এই কিশোর-কিশোরীদের এ থেকে সুরক্ষার জন্য সংক্রমণের উৎসগুলোকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

কেন চিকিৎসকের কাছে যেতে বিলম্ব হয়
কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হলে এখনো শারীরিক যন্ত্রণার চেয়ে মানসিক ও সামাজিক যন্ত্রণা ও নিগ্রহের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই মানুষ অস্বীকারের ধাঁধায় বা ‘ডিনায়েল মুডে’ চলে যায়। অনেক ঘাটের পানি খেয়ে অনেক রাস্তা ঘুরে বেশ দেরি করেই সঠিক চিকিৎসকের কাছে তারা আসে বা তাদের আনা হয়। যদিও চিকিৎসকেরা বলছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে কুষ্ঠ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য একটি রোগ।

চিকিৎসা কি সহজলভ্য এবং যথেষ্ট
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯১৩ সালে প্রথম কুষ্ঠ নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন খ্রিষ্টান মিশনারিজরা। এই কেন্দ্র ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন কুষ্ঠ হাসপাতাল। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে ১৯৬৫ সালে সরকারিভাবে নীলফামারী, সিলেট ও মহাখালীর তিনটি হাসপাতালে কুষ্ঠরোগ চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এরপর তা থানা পর্যায়ে (বর্তমানে উপজেলা) সম্প্রসারণ করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৯৯৩ সালে জাতীয় কুষ্ঠ নির্মূল কর্মসূচি শুরু করে। বর্তমানে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা সেক্টর প্রোগ্রামের আওতায় যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগের জন্য একটি পৃথক বিষয়ভিত্তিক কর্মসূচি (অপারেশনাল প্ল্যান) রয়েছে। কর্মসূচিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা ও আশু চিকিৎসার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এসবই বড় আশাজাগানিয়া কথা। বাস্তব পরিস্থিতি আসলে কেমন?

গত জানুয়ারিতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে সিলেট কুষ্ঠ হাসপাতালের নানা সংকটের কথা জানা যায়। এ হাসপাতালে সহকারী স্টাফ নার্স হিসেবে পাঁচটি পদ থাকলেও সব পদই শূন্য। অফিস সহায়কের নয়টি পদ থাকলেও এর বিপরীতে কোনো লোক নেই। কুষ্ঠ রোগীদের জন্য বিশেষ জুতা তৈরির জন্য একজন কর্মী থাকার কথা হাসপাতালে, এই পদ ২০২১ সাল থেকে শূন্য। হাসপাতালের কুষ্ঠরোগ শনাক্তের অণুবীক্ষণ যন্ত্র থাকলেও সেটি বহু বছরের পুরোনো। রয়েছে বিশুদ্ধ খাবার ও দৈনন্দিন ব্যবহারের পানির সংকট। এসব সংকট কি একটি ‘অবহেলিত’ রোগের প্রতি কর্তৃপক্ষের অবহেলারই দৃষ্টান্ত?

Leave a Reply