মহিষেরা ফেরে, মানুষ ভেসে গেলে ফেরার পথ কই

বৈরী আবহাওয়ায় জেলেদের ভেসে যাওয়া নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২২)

একের পর এক মানববন্ধন করছে ভেসে যাওয়া আর ভারতে আটকে পড়া জেলেদের পরিবারগুলো। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন পটুয়াখালীর মহিপুর থানার বিপিনপুর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের শুক্কুর গাজীর ছেলে ইউনুস গাজী (৪৭) । তাঁর লাশ এখন হিমঘরে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধারণা হয়েছিল সাতচল্লিশের দেশভাগের যন্ত্রণা হয়তো ঘুচবে। ঘোচেনি, বরং বেড়েছে। যার যার বাড়ি ফেরার রাস্তা আরও বেঁকে গেছে। সীমান্তের কাঁটাতার দ্বিগুণ হয়েছে। তার চেয়ে কঠিন হচ্ছে আইনের কাঁটাতার। মনের তার কাটা থাকলে সব কাঁটাতার দ্বিগুণ হয়! রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী নীলবোনা গ্রামের মো. সেন্টু মিয়ার খামারের ২১টি মহিষের মধ্যে পদ্মায় ভেসে যায় ১৬টি মহিষ। গত ৭ সেপ্টেম্বর ঝড়–বৃষ্টির রাতে বাথানে থাকা মহিষগুলো মালিকের গোয়ালে হয়তো ফিরতে চেয়েছিল। পদ্মা নদীর স্রোত প্রবল থেকে প্রবলতর হলে তারা পেরে ওঠেনি; পোয়াতি মহিষসহ ভেসে যায় ১৬টি মহিষ।

সীমান্ত অঞ্চলের জীবনের বাস্তবতা ভিন্ন। সেখানে নিজের গবাদি প্রাণীরও জন্মনিবন্ধন করতে হয়। রাষ্ট্রের খাতায় তাদের নামধাম, সাকিন, সন, ক্ষণ লিখে রাখা হয়। হঠাৎ কারও বাড়িতে গবাদি প্রাণীর সংখ্যা বেড়ে গেলে বাড়ির মালিককে চোরাচালানি হিসেবে চালান দেওয়া হয়। সেই হ্যাপা এড়াতেই গবাদি প্রাণীর জন্মনিবন্ধনব্যবস্থা। তবে ভেসে যাওয়া মহিষ কূলে ফিরে এলেও খামারমালিক মো. সেন্টু মিয়ার কাছে গচ্ছিত অসত্যায়িত জন্মনিবন্ধন নথি কোনো কাজে দেয়নি। নদীর স্রোতে ভাসতে ভাসতে মহিষগুলো দেশের সীমানার মধ্যেই ভাটির নানা ঘাটে গিয়ে ওঠে। চারঘাটের ইউসুফপুর আর বাঘার আলাইপুরে তারা পায়ে মাটি পায়। আটক হয়ে যায় সীমান্তরক্ষীদের হাতে। মো. সেন্টু মিয়া কাগজ নিয়ে প্রমাণ নিয়ে সবার কাছে গেছেন। এমনকি মহিষগুলোর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। জানিয়েছেন কয়টা গাভিন, কয়টা কোন লিঙ্গের, কবে কে প্রসব করবে। বলা বাহুল্য, এসব তথ্যে কোনো কাজ হয়নি। নিলাম ঠেকানো যায়নি। সেটা–ই নাকি নিয়ম। প্রথম আলোর স্থানীয় সংবাদদাতাকে আটককারী কর্তৃপক্ষ বলেছে, আটক করা এবং কাস্টমসে হস্তান্তর করাই তাদের কাজ। এরপর আর বিষয়টি তাদের হাতে থাকে না।

মো. সেন্টু মিয়া এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ন্যায্যতার আশায়। হয়তো মহিষ নিলামের জটিলতা একদিন ঘুচবে, সেন্টু মিয়া টাকা ফেরত পাবেন। ১৬টি মহিষের একটি কেন নিলামে উঠল না, সেটা নিয়ে সেন্টু মিয়া কথা আর না বললেই হয়তো সুরাহা হবে চটজলদি।

সে যা–ই হোক, ভেসে যাওয়া মানুষগুলোর কী হবে? গত ১২ ও ১৮ আগস্টের বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে বাংলাদেশের জলসীমায় বেশ কিছু ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে। এসব ট্রলারের জেলেদের অনেকেই ভাসতে ভাসতে প্রতিবেশী দেশের জলসীমায় সে দেশের নানা বাহিনী বা অন্য জেলেনৌকার সহযোগিতায় রক্ষা পান। তবে বেশ কিছু ট্রলার ডুবে যায় ভারতের জলসীমায়। এ নিয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর ‘ঝড়ে হারানো জেলে: তারা ফিরবে, নাকি ফিরবে না’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি উপসম্পাদকীয় লেখা হয় ।

একের পর এক মানববন্ধন করছে ভেসে যাওয়া আর ভারতে আটকে পড়া জেলেদের পরিবারগুলো। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন পটুয়াখালীর মহিপুর থানার বিপিনপুর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের শুক্কুর গাজীর ছেলে ইউনুস গাজী (৪৭) । তাঁর লাশ এখন হিমঘরে। ভারতে থাকা জেলেদের ফিরিয়ে আনতে বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী ভারতে ছুটে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জেলেদের সঙ্গে দেখা করেন। কলকাতায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশনের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। ‘ব্যস্ত’ হাইকমিশন অফিসকে নাড়ানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেখান থেকে কেউ যাননি জেলেদের সঙ্গে দেখা করতে। গোলাম মোস্তফার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের একাধিকবার কথা হয়, তিনি তাঁর মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যজীবীদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনাইটেড ফিশারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সূত্রে জানা গেছে, সেখানকার জেলেরা যে ৯০ জন বাংলাদেশি জেলেকে উদ্ধার করেছেন, তাঁদের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৯০ জেলের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যজীবীরা। কাকদ্বীপে আছেন ৪৬ জন, কুলতলিতে ১৭ জন, মথুরাপুরে ১১ জন এবং কেনিং-২ ব্লকে রয়েছেন ১৬ জন বাংলাদেশি জেলে। বিপদে পড়া জেলেদের পাশাপাশি তাঁদের হাতছাড়া হওয়া জাল ও গ্যাস সিলিন্ডার, এমনকি ট্রলারও উদ্ধার করে নদীর চরে রাখা হয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে, জেলে সমিতির পক্ষে তিন বেলা এতগুলো মানুষের খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। নিরুপায় হয়ে সমিতি যদি তাঁদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করে, তাহলে জটিলতা আরও বেড়ে যাবে।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর পাথরঘাটা উপজেলা প্রেসক্লাবে ওই সব জেলে পরিবার উপস্থিত হয়ে এক মানববন্ধনের মাধ্যমে জেলেদের ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। ভারতে আটক জেলেদের স্ত্রী, সন্তান ও মা–বাবারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা জানান, কারও ছেলে, কারও স্বামী এবং কারও বাবাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য এ দুর্দিনেও ধারদেনা করে ট্রলার মালিককে টাকা দিয়েছেন।’

সচেতন পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে বাংলাদেশের জলসীমায় বেআইনিভাবে মাছ ধরার সময় আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ভারতীয় জেলেদের মুক্তির জন্য ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের লাগাতার প্রচেষ্টার কথা। পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের ফেয়ার বয়া থেকে ৩৫ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ অংশের গভীর সমুদ্র থেকে বাংলাদেশের জলসীমানায় অবৈধ প্রবেশ করে মাছ শিকারের দায়ে নৌবাহিনীর হাতে তারা আটক হয়। ভারতীয় ১৬ জেলেকে শেষ পর্যন্ত গত ১৪ সেপ্টেম্বর মুক্তি দেওয়া হয়। ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার সন্দীপ কুমার তাদের গ্রহণ করেন। পরে ওই জেলেরা পায়রা বন্দর থেকে নিজেদের মাছের ট্রলারে করে নৌপথে ভারতে চলে যান। তার মানে ইচ্ছা থাকলে উপায় আছে। মনের তারটা শক্ত করে বাঁধতে পারলে আটক জেলেদের দ্রুতই বাড়িতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

Leave a Reply