মাকসুদুলের পা গেছে, আমাদের পা কি আছে?

হঠাৎ বিস্ফোরণ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৩)

‘আমার পা তুলতে পারছি না কেন? পা কোথায়? পা দেখতে পারছি না তো।’

সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণে গুরুতর আহত মাকসুদুল আলম রোববার সকালে (৫ মার্চ) জ্ঞান ফেরার পর টের পান, তাঁর একটি পা নেই। তা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলতে থাকেন, ‘আমার পা তুলতে পারছি না কেন? পা কোথায়? পা দেখতে পারছি না তো।’

মাকসুদুলের পা গেছে, আমাদের পা কি আছে? থাকলে কোথায়? সেটা কি কোনো চোরাবালিতে অথবা ব্যর্থ ব্যবস্থাপনার পাকে আটকে আছে?

বছর না ঘুরতেই কীভাবে আবার ভয়াবহ বিস্ফোরণে অপ্রস্তুত সীতাকুণ্ড কেঁপে ওঠে? সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে সীমা অক্সিজেন লিমিটেড কারখানার বিস্ফোরণে মারা যান প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে থাকা একজন দোকানি। এখন পর্যন্ত ছয়জনের লাশ পাওয়া গেছে। হাত-পা হারিয়ে কমপক্ষে ২৫ জন কপালমন্দ শ্রমিক হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়েছে সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের কারখানা
মাকসুদুলের কান্নার খবরে হয়তো নজর রাখছিলেন ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকার এক ভবনে বসে এক পিতা। কয়েক মাস আগে তাঁর ছোট মেয়ে মারা যায়, মন খারাপ নিয়েও হয়তো দেখছিলেন সীতাকুণ্ডের খবর। হঠাৎ এক বিস্ফোরণে তিনিও চলে গেলেন চিরতরে। তিনজনের লাশ মিললেও ঠিক কতজন কীভাবে মারা গেছে, সেটা জানতে সময় লাগবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁরা শুনেছেন ১২ থেকে ১৩ জন আহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৪-৫ জনের অবস্থা গুরুতর। আরও শুনেছেন তিনজন মারা গেছেন।
কেন এত বড় বিস্ফোরণ হলো, সেটাও কেউ সঠিক করে বলতে পারছে না। প্রাথমিক ধারণা, বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে জমে থাকা গ্যাসে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তদন্ত শেষ হলে সঠিক কারণ জানা যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সেদিন (গত ১৯ ফেব্রুয়ারি) গুলশানের আগুনেও দুজনকে মরতে হয়েছে।

সায়েন্স ল্যাব এলাকায় বিধ্বস্ত ভবনে যখন উদ্ধারের জন্য আহত ব্যক্তিদের বাঁচানোর জন্য আশপাশের তরুণদের এগিয়ে আসার কথা, তখন তাঁরা মত্ত হলেন শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মারামারিতে। ঢাকা কলেজ, আইডিয়াল কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের সেই সংঘর্ষে পুলিশ বুঝতে পারেনি কী করতে হবে। কাকে ধরতে হবে আর কাকে সামলাতে হবে। ভোগান্তিতে নাকের জলে চোখের জলে ভিজতে থাকে সাধারণ মানুষ। জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যারা পথে থাকার হুংকার দেয় ঘন ঘন, তারাও ছিল নিরুদ্দেশ।

এসবের কি কোনো প্রতিকার নেই? দুর্ঘটনাগুলোর প্রকৃত কারণ কি কোনো দিন জানা যাবে না? সব সময় কি আমরা গাজীপুরে থাকব। কয়েক বছর আগে (২০১৭) গাজীপুরের কাশিমপুরের নয়াপাড়ায় মাল্টিফ্যাবস লিমিটেডের ডাইং সেকশনে বয়লার বিস্ফোরিত হলে চারতলা ভবনের এক পাশের দোতলা পর্যন্ত ধসে পড়ে। এ ঘটনায় কমপক্ষে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় মামলা হয়, আসামি করা হয় নিহত শ্রমিকদের তিনজনকে। অথচ গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. রায়হানুল ইসলাম ঘটনার পরদিন জানিয়েছিলেন বিস্ফোরিত বয়লারটির মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই।

সত্য পথে হাঁটার পা-টা পাক থেকে উদ্ধার না হলে মাকসুদুলদের হাঁটাচলার পাগুলো আমরা হারাতেই থাকব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *