‘রেল’ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩)
গত এক মাসে ‘সেরাম’ ছোটাছুটি করতে হয়েছে নানান আন্তনগর রেলে। বলতে পারেন ভোটের দিনে ধরে আনা অবিরাম দাঁড়িয়ে থাকা সেই কিশোরীর মতো ‘কিছুটা শখে’, ‘কিছুটা ঠেকায়’, ‘কিছুটা আনন্দে’, বাকিটা খুশিতে—দিনাজপুর থেকে কক্সবাজার, কমলাপুর থেকে কুষ্টিয়া কোর্ট।
নতুন কামরা (বগি), ঝকঝকে আসন, কোট-টাইয়ে মোড়া স্যুট-বুট পরা হুকুমবরদার। শয়ে শয়ে রেল পুলিশ আর ডিবি পুলিশ, সাজপোশাকে সজ্জিত হকার, পরিপাটি চেকার, গার্ড। মন খুশিতে বাগ বাগ হয়ে ওঠে।
তারপরও পা পিছলে পড়ছে মানুষ
সঙ্গে থাকা খবরের কাগজে চোখ আটকে যায়, ‘ট্রেনে কাটা পড়ে হাত-পা বিচ্ছিন্ন হয়ে স্টেশনমাস্টারের মৃত্যু’। এর আগে অভিজ্ঞ স্টেশনমাস্টারের করুণ মৃত্যুর খবর কখনো শুনিনি।
বাবার চাকরির সূত্রে রেলের কোয়ার্টারে বড় হওয়া এক সাবেক সচিবকে ফোন করে জানলাম, ১৯৬৪ সালে আত্রাই রেলস্টেশনের মাস্টার মারা গিয়েছিলেন ট্রেনে উঠতে গিয়ে। এ ছাড়া আর কোনো তথ্য কারও জানা নেই। সাবেক স্টেশনমাস্টারদের সন্তানদের মধ্যে জানামতে, সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ হাসান মীর (জাপান বেতার ও বাংলাদেশ বেতারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) প্রবল স্মৃতিশক্তি নিয়ে কোনো তথ্য জানাতে পারলেন না।
আত্রাইয়ের ঘটনা কোনো স্টেশনে দাঁড়ানো যাত্রীবাহী রেলগাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। স্ত্রীর প্রসব–যন্ত্রণার খবর পেয়ে তিনি আধা চলন্ত এক মালগাড়ির গার্ড ভ্যানে উঠতে গিয়ে পা পিছলে মারা যান।
কিন্তু পত্রিকা বলছে, স্টেশনমাস্টার আবদুস সোবহান আকন্দ মারা গেছেন নিজের স্টেশনে যাত্রীবাহী ট্রেনে চড়তে গিয়ে। মহিমাগঞ্জ স্টেশনে চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
বেলা ১১টার দিকে লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্টেশনের উদ্দেশে ছেড়ে আসা ট্রেনে উঠতে যান তিনি। পা পিছলে তাঁর হাত-পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা দুইটার দিকে তিনি মারা যান। এটা গত নভেম্বরের ঘটনা।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা চিলাহাটিগামী তিতুমীর এক্সপ্রেসে ওঠার সময় ফিরোজ কবির নামের এক যাত্রী পা পিছলে প্ল্যাটফর্মের নিচে পড়ে যান। এ ঘটনায় ট্রেনে কাটা পড়ে তাঁর দুই পা। স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে প্রথমে তাঁকে বিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, পরে দিনাজপুরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।
দেশের উত্তর আর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে প্রায় প্রতিদিনই ট্রেনে উঠতে গিয়ে পা ফসকে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। মারা গেলে বা গুরুতর আহত হলেই কেবল ঘটনা জানাজানি হয়। সপ্তাহে বা মাসে এক-দুইটা মৃত্যু বা হাত-পা হারানোর ঘটনা এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। গত মে মাসে (১৩ মে ২০২৩) সিলেট অঞ্চলের শমশেরনগর স্টেশনে (মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা) ট্রেনে উঠতে গিয়ে পা হারান বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কর্মী সুমন কুমার দাস।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে পঞ্চগড় থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেসে উঠতে গিয়ে পা পিছলে দুই যুবক ট্রেনের নিচে পড়ে যান। একজন মারা যান, অন্য যুবককে পাঠানো হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
দেওয়ানগঞ্জের পুরোনো ডাকাতিয়াপাড়ার মুর্শেদা বেগম চিকিৎসার জন্য ট্রেনে চেপে ঢাকা যেতে চেয়েছিলেন। গত ২৭ মার্চ পা পিছলে পড়ে যান। ট্রেনে কাটা পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
কেন এসব দুর্ঘটনা
আজকাল সড়ক দুর্ঘটনাকে বলা হচ্ছে কাঠামোগত হত্যা। মৃত্যুর ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে সড়কে সড়কে। কখনো চালক, কখনো গাড়ি, কখনোবা পথচারী পড়ছেন সেসব ফাঁদে। আমদানি করা রেলের ঝকঝকে কামরাগুলো (বগি) আগের তুলনায় অনেক উঁচু। রেল উঁচু হয়েছে কিন্তু ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন ছাড়া উত্তরের আর সিলেট অঞ্চলের প্ল্যাটফর্ম থেকে গেছে আগের উচ্চতায়। তা ছাড়া আগের রেলগাড়ি আর প্ল্যাটফর্মের মধ্যে ফাঁকটা এখনকার চেয়ে বেশি ছিল। কিছু পড়ে গেলে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সেটা টেনে তোলা যেত। এখন ট্রেন না যাওয়া পর্যন্ত সেটা সম্ভব নয়।
নিচু প্ল্যাটফর্ম থেকে উঁচু রেলে ওঠার সিঁড়ি এখন শুধুই খাড়া মই। বিরতির নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ট্রেনে ওঠানামা ‘জটলাপছন্দ’ পাবলিকের পক্ষে বেশ কঠিন। সিঁড়িগুলোও ‘জটলাবান্ধব’ হয়নি। এ দেশের যানবাহনে শুধু যাত্রী চড়ে না, তাকে ওঠাতে–নামাতে যায় এক সংসার লোক। সেই চাপও সইতে হয় স্টেশনকে, রেলের সিঁড়িকে। প্রতিটি কামরায় দুটি দরজা আছে। দুটি দিয়েই মানুষ একসঙ্গে ওঠানামার জন্য উতলা হয়ে কসরত করতে থাকেন। ওঠানামার পুরো ব্যবস্থায় গর্ভবতী নারী, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী আর শিশুদের কথা ভাবা হয়নি। ব্যবস্থা দেখে মনে হবে, দেশের সব মানুষ না হলেও রেলযাত্রীদের সবাই সামরিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত একেক জওয়ান। এখনকার ট্রেনগুলো সাইজে বড় হওয়ায় প্রায় স্টেশনেই সামনের দুই কামরা আর পেছনের দুই-তিন কামরা থেকেছে প্ল্যাটফর্মের একেবারে বাইরে। সেখানে ওঠানামার ফ্যাসাদ আরও জটিল।
তাহলে উপায় কী
সবচেয়ে ভালো হয় রাতারাতি দুনিয়ার তাবৎ অশরীরী কর্মঠদের কাজে লাগিয়ে প্ল্যাটফর্মগুলো উঁচু করে ফেলা। সেটা রূপকথায় সম্ভব হলেও আমলানির্ভর বর্তমান বাস্তবতায় প্রায় অসম্ভব। তবে ইচ্ছা করলে গুণগত মান বজায় রেখে দ্রুততম সময়ে কাজটি করা সম্ভব। সিলেটের বিধ্বংসী বন্যায় মেয়র আর সামরিক বাহিনী যৌথভাবে সিলেটের বিদ্যুৎব্যবস্থা রক্ষা করে সেটা দেখিয়ে দিয়েছিল। টেস্ট রিলিফ বা কাজের বিনিময়ে টাকা কর্মসূচি এখন নাকি কাজের ক্ষেত্র খুঁজে পায় না। এটা একটা ভালো ক্ষেত্র হতে পারে। শুধু রেলসচিবকে ত্রাণসচিবের সঙ্গে একটু বসতে হবে। ইগোর ঘোমটা নামিয়ে কাজটা তাঁরা চাইলেই করতে পারেন।
তবে যত দিন ঘি জুটছে না, তত দিন পর্যন্ত ‘রাধা’কে বসিয়ে রেখে প্রাণহানির রাস্তাগুলো খোলা রাখা ঠিক হবে না। প্ল্যাটফর্ম উঁচু করা ছাড়াও যেসব কাজ করা সম্ভব এবং প্রয়োজন, সেগুলো হলো:
১. প্রতিটি কামরার একটা দরজা ওঠার, আরেকটা দরজা নামার জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া। ওঠার দরজা দিয়ে নামতে গেলে দরজা কাজ করবে না—এমন ব্যবস্থা রাখা সম্ভব।
২. প্রতিটি কামরায় রেলকর্মীদের তত্ত্বাবধানে নামার সিঁড়ি রাখা। যেসব বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিনা মূল্যে ট্রেনের জন্য সিটকভার দিয়েছে, তারা খুশি মনে জনস্বার্থে এটা করবে।
৩. অনেকেই জীবনের সঞ্চিত সব মালামাল নিয়ে ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। এখানে একটা লাগাম টানা দরকার। মাথার ওপর মাল রাখার জায়গায় যেভাবে দশাসই আকারের স্যুটকেস আর ব্যাগ ইত্যাদি ঝুঁকির সঙ্গে রাখা হচ্ছে, তাতে হালকা দুর্ঘটনায় যেকোনো সময় বড় ক্ষতি হতে পারে।
৪. বিশাল বিশাল স্যুটকেসের মালিকেরা সাধারণত ক্ষমতাবান হন। কাজেই স্টেশন আসার আগেই তাঁরা দরজা বন্ধ করে মালামাল নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। রেলকর্মীরা থাকেন দর্শক হয়ে। রেলকর্মীদের উদ্যোগ নিতে হবে প্রতিবন্ধী, প্রবীণ আর শিশুদের পক্ষে।
৫. অনাহূতদের শক্ত হাতে প্রতিরোধ করতে হবে। এয়ারপোর্ট স্টেশন, রাজবাড়ী, পার্বতীপুরে রেলকর্মীদের টপকে বা তাঁদের প্রশ্রয়ে একশ্রেণির টিকিটবিহীন লাগেজহীন মানুষ যাত্রীবেশে উঠে পড়ে। তাদের বেশির ভাগই কম বয়সের ভবঘুরে। কমলাপুরের পথশিশুদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, তাদের অনেকেই হাত সাফাইয়ের কাজ করার জন্যই ট্রেনে ওঠে।
সুন্দর রেলগাড়িগুলো সুন্দর হোক। হোক প্রতিবন্ধী, প্রবীণ আর শিশুবান্ধব। শিশুদের পছন্দ হলেই আমদের ট্রেনগুলো টিকে যাবে।