শৈত্যপ্রবাহে করণীয়

শৈত্যপ্রবাহ জনস্বাস্থ্য

তীব্র শীতে মানুষ বিভিন্ন ধরনের অসুখে ভুগতে পারে। বিশেষ করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, অপুষ্টিতে ভোগেন তাদেরই রোগের আশংকা বেশি। টনসিলের প্রদাহ বা গলা ব্যাথা, ডায়রিয়া, আমাশয় জাতীয় পেটের অসুখ, বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ শীতের সাথে সম্পর্কিত সাধারণ রোগ। এছাড়াও কিছু কিছু অসুখে ভোগান্তির পরিমান শীতে বেড়ে যাবার আশংকা রয়েছে। যেমন- শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানী, কিডনির অসুখ, রিউমেটিক ফিভার, হৃদরোগ, ইত্যাদি।

শৈত্যপ্রবাহে সর্তকর্তামূলক পদক্ষেপ

শিশুদের সুস্থ রাখার জন্য করণীয়

  • সদ্যজাত শিশুদের ও মাকে ঠান্ডা পানিতে গোসল করানো যাবে না।
  • শিশুদের হাত ও পায়ে মোজা, গায়ে সোয়েটার ও মাথায় টুপি এবং পরিষ্কার কাপড় পরাতে হবে।
  • জরুরি প্রয়োজন ছাড়া শিশুকে বাড়ির বাইরে নেওয়া যাবে না।
  • ছয় মাসের কম বয়সী শিশুকে বার বার বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। 
  • ছয় মাসের বেশি বয়সী শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার খাওয়াতে হবে।
  • প্রয়োজনে শিশুকে হাল্কা গরম পানি দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে গোসল করাতে হবে।

প্রবীণদের সুস্থ থাকার ক্ষেত্রে করণীয়

  • প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়া।
  • সব সময় গরম কাপড় পরিধান করা।
  • নাক ও মুখ ঢেকে রাখা যেন ফুসফুস ধূলাবালি মুক্ত থাকা যায়।
  • অতিরিক্ত পরিশ্রম না করা।
  • মেঝেতে না ঘুমানো।
  • খালি পায়ে চলাচল না করা।
  • কাপড় এমনভাবে পরিধান করা যেনো শরীর তাপ ধরে রাখতে পারে।
  • সবসময় পরিষ্কার কাপড় পরা।

নিম্নবর্ণিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে অতিসত্বর শিশুকে হাসপাতালে নিতে হবে বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে

  • শ্বাসকষ্ট, কাশি, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে ও খিঁচুনি দেখা দিলে।
  • হঠাৎ করে শিশু বুকের দুধ ও তরল জাতীয় খাবার না খেলে।
  • শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় দ্রুত বুক ওঠা-নামা করলে ও শিশু বমি করলে।
  • শরীর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঠান্ডা হয়ে গেলে অথবা শিশু অজ্ঞান হয়ে গেলে।

শৈত্যপ্রবাহে কৃষি ও মৎস্য বিপর্যয় রোধে করণীয়

আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ পাল্টে দেয় কৃষকের সব হিসাব নিকাশ। ঘন ঘন শৈত্যপ্রবাহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি ডেকে আনে। শীত আর কুয়াশায় ইরি, বোরো ধানের চারা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রবিশস্য ও আলু, টমেটো, শিমসহ বিভিন্ন ফসলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শৈত্যপ্রবাহে পর্যাপ্ত রোদের অভাবে জলাশয়ের তলদেশের জলজ উদ্ভিদ মারা যেতে পারে। শীতকালে পুকুরের পানির গভীরতা কমে যায়, যেসব পুকুরে মাছের খাবার সরবরাহ করা হয় সেখানে অতিরিক্ত খাবার জলাশয়ের তলদেশে জমে পানি দূষণ ও জীবাণুর সংক্রমণ বাড়াতে পারে।  শীতজনিত রোগে (কোল্ড স্ট্রোকে) আক্রান্ত হয়ে ব্যাপক হারে পাঙ্গাশ, কই, তেলাপিয়া, দেশি মাগুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মারা যায়।

কি করবেন ?

  • পাতাসহ বড় বড় ডাল সবজির জমির চারপাশে পুতে রাখা যেতে পারে। শিশির বা কুয়াশা সরাসরি ক্ষতিকর হলেও পানি আকারে উপকারী। চাষাবাদে জৈব সার ব্যবহার করা যায়। এটা মাটির উষ্ণতা ধরে রাখতে সহায়তা করে। ছত্রাক দমনের জন্য তুঁত+চুনের মিশ্রণ ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • শীত শুরু হবার কিছু আগেই বীজতলা তৈরি করে রাখা যেতে পারে। ঘরে রক্ষিত বীজের মধ্যে নিমপাতা, বিষ কাঁঠালের পাতার গুঁড়ো রাখা যেতে পারে। কুয়াশা ও শিশির থেকে রক্ষার জন্য বীজতলা ঢেকে রাখা যেতে পারে। বীজতলা তৈরির পরও কিছু বীজ হাতে রাখা যেতে পারে। অতিরিক্ত ঠান্ডার সময় পোষা মৌমাছির চলাচল সীমিত রাখা যেতে পারে।
  • মাছ রোগাক্রান্ত হলে সেটিকে দ্রæত সরিয়ে নিতে হবে। রোগাক্রান্ত মাছ থাকলে পুকুরে তার মাধ্যমে রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। মাছের খাবার হিসাবে কুড়া ব্যবহার করতে হলে আগে শুকিয়ে নিন। ঠান্ডায় মাছের খাওয়ার ইচ্ছা কমে যায়, ফলে বৃদ্ধিও কমে যায়। এজন্য শীতকালে মাছকে সুষম খাবার সরবরাহ করতে হবে। এসময় জোঁক ও উকুনের আক্রমণ বেড়ে যায, জলাশয়ে ঝোপঝাড়/গাছের ডাল ফেলে রাখা যেতে পারে, যাতে গা ঘষে মাছ নিজেকে পরিস্কার রাখতে পারে। পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে পানি নাড়াচাড়া করে বা পানি সেচ দিয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে।
  • তীব্র ঠান্ডায় মাছ মারা যায়। কাজেই শীতের আগে বিক্রয়যোগ্য মাছ বিক্রি করে দিতে হবে। এসময় মাছের পোনা ছাড়া থেকে বিরত থাকুন। পুকুরের পানির পরিমাণ অনুযায়ী মাছের সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে।

শৈত্য প্রবাহে পোলট্রি গবাদি পশুর রোগবালাই থেকে রক্ষায় করনীয়

অতিরিক্ত ঠান্ডায় হাঁস-মুরগির ডিম পাড়ার পরিমাণ কমে যায়। রানীক্ষেত ও বসন্ত রোগের সংক্রমণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ঠান্ডায় বাচ্চা মারা যেতে পারে। এসময় গরু-ছাগলের মাঠে চরে খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। শৈত্যপ্রবাহের সময় যকৃত কৃমিতে গরু মারা যেতে পারে। শীতের সময় এই রোগের আক্রমণ বেশি ঘটে। এতে গরুর কলিজায় একধরনের কৃমির আক্রমণ ঘটে এবং গরুর রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় ও থুতনির নিচে পানি জমে যায়। এসময় গরুর খাবার গ্রহণও কমে  যায়, রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে এবং মৃত্যুহার বেড়ে যায়।

কি করবেন ?

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গবাদি পশু ও হাস-মুরগির জন্য সুষম খাবারের ব্যবস্থা করা।
  • খাবারের সাথে ভিটামিন এ ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। শীত প্রতিরোধের জন্য এসময় শক্তি উৎপাদনকারী খাবার দিলে ভালো হয়, যেমন তিলের খৈল।
  • খাবার সংকট এড়ানোর জন্য শীতের আগেই কিছু খাবার জমিয়ে রাখা যেতে পারে।
  • শীত প্রতিরোধের জন্য গবাদি পশুর শরীর চট দিয়ে ঢেকে দেয়া যেতে পারে।
  • গবাদি পশু ও হাসমুরগির ঘরে বাতাস প্রতিবন্ধক ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • কোনো পশু বা হাঁসমুরগি রোগাক্রান্ত হলে সংক্রমণ রোধের জন্য সেটাকে দল থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
  • এদের ঘর পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

শীতের সময় আগুন পোহাতে সতর্কতা

১) এক্ষেত্রে নারীরাই বিপদে পড়ে থাকে বেশি। গ্রামাঞ্চলে নারীরা সাধারণত শাড়ি পরেন সব সময়। হাড়কাঁপানো শীত সহ্য করতে না পেরে বাড়ির পাশেই খড়ের মধ্যে আগুন ধরিয়ে তাপ নেয়ার সময় কখন যে শাড়ির আঁচলে আগুন লেগে যায়, তা শীতের তীব্রতার কারণে বোঝা যায় না। এই ক্ষেত্রে শাড়ী ভালোভাবে পেঁচিয়ে তারপর বসুন।
২) শীতের মধ্যে এলাকার ছেলেরা কয়েকজন মিলে কৃষকের খড়ের পুঞ্জির পাশে আগুন পোহাতে গিয়ে সেই পুঞ্জি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কৃষকের জন্য এ ক্ষতি অপূরণীয়। কৃষকের খড় যেখানে আছে তার থেকে দূরে আগুন পোহালে ভালো, যদি সম্ভব হয় তাহলে আশেপাশে কৃষকে খড় বা কারো বাড়ি নাই এমন স্থানে আগুন পোহানো।
৩) আগুন পোহানো হয়ে গেলে আগুন ভালোভাবে নিভিয়ে দিন। না হয় অজান্তে কেউ সেখানে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।  
৪) যারা বার্বিকিউ পার্টি করছেন, যতোটা সম্ভব সাবধানে থাকুন। নিশ্চিত হোন আপনার ফায়ার প্লেসের আগুন পুরোপুরি নিভেছে কি-না। সামান্য আগুনের ফুলকা থেকেও বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।  
৫) বাড়ির ছোট সদস্যদের প্রতি বাড়তি নজর দিন। আগুন থেকে দূরে রাখুন। প্রয়োজনে বাড়তি গরম কাপড় পরিয়ে রাখুন।  

Leave a Reply