অগ্নিকান্ড নিয়ে আমাদের সময় পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৩)
আগুনের পর আগুন
আগুনের ঘটনা ক্রমেই এখন আবহাওয়ার খবরের মতো নিত্যদিনের খবরে পরিণত হচ্ছে। কেন আগুন লাগছে বারবার, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দানা বেঁধে উঠছে। অন্যকে দোষারোপের কালচার হয়তো ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব‘কেই বিশ্বাস করতে বলবে। ষড়যন্ত্রের তত্ত্বকে গ্রাহ্যের মধ্যে নেওয়ার জন্য নানা সূক্ষ্ম ও স্থূল আলামত দিয়ে বিশ্বাসের মোড়কে মোড়ানোর চেষ্টা হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে না দেওয়ার লক্ষ্যে ’৭০-এর দশকে পাটের গুদামে সেসব রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের কথাও তুলবেন অনেকে। বলে রাখা ভালো, ’৭০-এর ধারাবাহিক সেই অগ্নিকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা আজও হয়নি। বিমার ঝুঁকি বেড়েছে, বেড়েছে বিমার খরচ। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শক্ত শর্তের আওতা।
‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠার সুবিধা অনেক, নিজেদের কোনো দায়দায়িত্ব থাকে না। নিজেদের সীমাবদ্ধতা, গাফিলতি আর উদাসীনতাকে সহজেই পাশ কাটানো যায়। ঢাকার নিউমার্কেটের সর্বব্যাপী আগুনের যে কারণ ব্যাখ্যা করেছে অগ্নিনির্বাপক কর্তৃপক্ষ, সেখানে যে ঘাটতি তারা দেখেছেন তার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের গাফিলতি আর অবহেলাই প্রকট হয়ে উঠেছে। তারা বলেছেন, ‘মার্কেটটির ফায়ার সেফটি সিস্টেম ছিল অত্যন্ত দুর্বল। ব্যবসায়ীরা সিটি করপোরেশন থেকে একটি দোকান বরাদ্দ নিয়ে করিডরে আরও দুই থেকে তিনটি সাবদোকান দিয়েছিলেন। যার কারণে করিডরগুলো খুবই সংকীর্ণ হয়ে এক দোকান থেকে আরেক দোকানে কাপড়ের মাধ্যমে আগুন ছড়িয়েছে।
advertisement
এ ছাড়া মার্কেটের ফলস সিলিং, ওপরে প্লাস্টিক আইটেম ও ব্যানার-পোস্টারের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।’ তারা কিছু সাবধানতার কথা বলেছেন। জোরের সঙ্গে জানিয়েছেন, ব্যানার-ফেস্টুন পরিহারের কথা উত্তরের প্রয়াত মেয়র এসব ব্যানার ফেস্টুনের বিরুদ্ধে রীতিমতো জেহাদ শুরু করেছিলেন। মেয়রের সেই উদ্যোগ আমজনতার সমর্থন পেলেও দৃষ্টি আকর্ষণে আগ্রহী রাজনৈতিক নেতা আর ব্যবসায়ীদের খুব একটা পছন্দ হয়নি।
ফায়ার সেফটি সিস্টেম কী
অগ্নিনির্বাপক কর্তৃপক্ষ যে ফায়ার সেফটি সিস্টেমের কথা বলেছেন সেটার দায় মার্কেট কর্তৃপক্ষ, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আর দিনের শেষে মালিকের। অগ্নিপ্রতিরোধ, নকশা এবং নির্মাণ, প্রযুক্তি আর সরঞ্জামের ব্যবহার এবং প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার সর্বোত্তম অনুশীলন সবই ফায়ার সেফটি সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত। নিউমার্কেট, বঙ্গবাজার দুটোরই মালিক সিটি করপোরেশন। করপোরেশনগুলো আগুন নেভাতে না পারে, আগুন প্রতিরোধের ব্যবস্থা তো নিতে পারে। মার্কেট থেকে আয়ের কত অংশ মার্কেটের উন্নয়ন আর আগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যয় করে? সিটি করপোরেশন অগ্নিনির্বাপক কর্তৃপক্ষকে নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গত পঞ্চাশ বছরে কয়টি অগ্নিপ্রতিরোধ মহড়া করেছে? এসব প্রশ্নের জবাব চাওয়ার কেউ নেই।
অগ্নিনির্বাপক কর্তৃপক্ষের কাজের পরিধি আর ক্ষমতা বাড়াতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে ব্রিটিশ সরকার অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৯-৪০ অর্থ সালে দমকল ব্যবস্থা বা ফায়ার সার্ভিস গঠন করে। এর মধ্যে ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল বম্বে ডকে (ভিক্টোরিয়া ডক) এক বিভীষিকাময় আগুনের ঘটনা ঘটে। সেই আগুন নেভাতে গিয়ে সদ্য গঠিত ফায়ার সার্ভিসের ৬৬ জন অফিসার আর ৮৯ জন কর্মীসহ প্রায় ৭০০ জন সাধারণ মানুষের প্রাণ যায়। আগুন নেভাতে মানুষের এই বলিদান আর সর্বস্ব পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগকে সংগঠিতভাবে ব্যবহার করার জন্য দমকলের পাশাপাশি বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগ গড়ে তোলা হয়। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় কলকাতা শহরের জন্য কলকাতা ফায়ার সার্ভিস এবং সারা বাংলার জন্য বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিস কার্যরত ছিল। তখন জেলা শহর আর গুরুত্বপূর্ণ মহকুমা ছাড়া দমকলের অফিস ছিল না। পূর্ববাংলার দমকল অফিসগুলো নিয়ে এই অঞ্চলের ফায়ার সার্ভিসকে পূর্ব পাকিস্তান ফায়ার সার্ভিস নামে পুনর্গঠিত করা হয়। পরে ১৯৫১ সালে দেশবিভাগ-পূর্ব বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের আদলে পূর্ব পাকিস্তান সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর গঠিত হয়।
একই সময় সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীন রেসকিউ বিভাগ নামে ১টি বিভাগ সৃষ্টি হয়। এই বিভাগের কাজ ছিল সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের উদ্ধার ও নিরাপদ স্থানে পাঠানো। ১৯৮১ সালের ৯ এপ্রিল এই তিন বিভাগ, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরকে একীভূত করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন দেশের সব শিল্পাঞ্চলে এবং বেশিরভাগ উপজেলা শহরে দমকলের অফিস আছে। এই বিশাল কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরকে এখন একটি পূর্ণাজ্ঞ মন্ত্রণালয়ে রপান্তরিত করে সম্পূর্ণ পেশাদারদের দিয়ে পরিচালিত করতে হবে।
আমাদের আগুন বিপন্নতা যে চরম সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তাতে কমবেশি সব বিশেষজ্ঞ একমত। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার অধিকাংশ ভবনে আগুন নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। ঢাকার বাইরের ঘরবাড়ি, বাজার-হাটের অবস্থা একইরকম। ২০১৯ সালে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী বলেছিলেন, ঢাকার প্রায় ৬৬ শতাংশ ভবন বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করেছে এবং তাদের বেশিরভাগেরই সঠিক অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালে ঢাকায় সহস্রাধিক ভবন পরিদর্শন করে এবং ১৩৬টি ভবনকে ‘খুব ঝুঁকিপূর্ণ’ এবং ৪৯৯টি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে, প্রায় ৬০ শতাংশ ভবন অগ্নিব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ বা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু খুলনা বিভাগের প্রকাশিত এক হিসাব অনুযায়ী সেখানে গত এক বছরে ২০৩৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে পাঁচটির বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে দমকল বাহিনীর প্রয়োজন হয়েছে।
ওই বিভাগে এসব ঘটনায় কমপক্ষে ২৬৫ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। ঝিনাইদহের একজন ফায়ার স্টেশন ম্যানেজার কোভিডের আগে ২০১৯ সালে সপ্তাহে দুই দিন রবি ও বৃহস্পতিবার স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন হাটবাজারে এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার এবং ভূমিকম্পে করণীয়সহ আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের বিষয়ে মহড়া দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন। এ রকমের কর্মযজ্ঞ ছাড়া অবস্থার দ্রুত উন্নতি আর দুর্ঘটনা সচেতন সমাজ গড়া সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাকে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ঢেলে সাজানোর কাজটি শুরু করতে হবে এখনই।
তালিকা তৈরি ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, ‘এই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যাতে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যাপ্ত অনুদান দেবেন। পাশাপাশি, আমরাও আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অনুদান দেব। ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকেও ব্যবসায়ীদের আর্থিক অনুদান দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। সেজন্য আমরা যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছি আপনারা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে আগামী শনিবারের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করুন। আমরা আপনাদের পাশেই আছি।’
ব্যবসায়ে স্বচ্ছতা দুর্ঘটনার রক্ষাকবচ
বঙ্গবাজারের আগুনে ব্যবসায়ী আর দোকান কর্মীদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠলে মানুষের হৃদয়ে ঘা লাগে। অনেকেই তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তকে শনাক্ত করা কঠিন। যার নামে দোকান তিনি দোকানি নন। যিনি দোকানি তিনি মালিক নন। মালিককে যে তিনি ভাড়া দেন তার কোনো প্রমাণ দোকানির কাছে নেই। দোকানের মালিক ভাড়ার কোনো রসিদ দেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন ভাড়া নিয়ে আরেকজনকে ভাড়া দিয়েছেন। কেউ কেউ ভেবেছিলেন দোকানিদের চেয়ে বেশি কষ্টে আছে কর্মচারীরা, টাকাটা আমরা তাদের হাতে পৌঁছাব। সেখানেও অনেক ফ্যাকরা। কর্মচারীদের কোনো তালিকা কোথাও নেই। নিয়োগপত্র-বেতন সব মুখে মুখে।
বিমা কোম্পানিগুলো ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াতে পারত কিন্তু তারাও নাচার। কারও কোনো বিমা নেই। বিমা করার প্রাথমিক কাগজপত্র, আয়কর সনদ, আয়ের ঘোষণা কেউ করতে রাজি নন। টাকা বাক্সের মধ্যে পুড়ে খাক হয়ে গেছে। রাতে কেউ টাকা নিয়ে বাড়ি যাওয়ার সাহস করে না। নিরাপত্তা নেই। সান্ধ্য ব্যাংকিংয়ের কোনো সুযোগ নেই। কারও দাবিও ছিল না।
রাতের বিক্রিবাট্টার পর দোকানিরা যদি টাকাটা ব্যাংকে রেখে যেতে পারত, দোকানগুলোর যদি বিমা থাকত তা হলে আজকের ছবিটা ভিন্ন হতে পারত। দোকানের ভাড়াটেদের তালিকা হাল নাগাদ থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত বাছাই করা সহজ হতো, দোকানকর্মীদের তালিকা থাকলে, নাম-ঠিকানা-বয়স থাকলে তাদের পাশে দাঁড়ানো কত সহজ হতো। দিন যত যাবে তালিকায় মতান্তর ততই বাড়বে। এখনই তিন পক্ষের তিন তালিকা। হিসাব মেলে না।
জনগণের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকেও ব্যবসায়ীদের আর্থিক অনুদান দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মেয়র।
তালিকা তৈরিতে সততা আর নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে বলেছেন মেয়র। তাকে কেন সে কথা বলে দিতে হবে। তালিকায় দোকানের প্রকৃত মালিক, মালিকের মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংযুক্ত থাকবে। আর দোকান যদি ভাড়া দেওয়া হয়ে থাকে তা হলে মালিকের পাশাপাশি ভাড়াটিয়ার নাম, মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংযুক্ত করতে বলেছেন মেয়র। এমন একটা তালিকা তো দোকান মালিক সমিতির কম্পিউটারে থাকা উচিত। আমরা না ডিজিটাল স্মার্ট।
এখন থেকে ফায়ার সার্ভিসকেও হাল নাগাদ তালিকা রাখতে হবে। যে কোনো ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে সেই তালিকাটিকেই সিদ্ধ তালিকা মনে করা হবে। এমন হলে ফায়ার সার্ভিসকে মানুষ পাত্তা না দিয়ে পারবে না। ফায়ার সার্ভিসের জনগণকে সম্পৃক্ত করে আগুন প্রতিরোধ ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তারা তখনই সেটা করতে পারবে যখন তাদের ক্ষমতা বাড়ানো হবে। বাস্তবতার নিরিখে তৈরি হবে সাংগঠনিক কাঠামো। আর সেটা চালাবে একদল পরীক্ষিত পেশাদার।