‘সাপে কাটা’ নিয়ে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৩)
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় ৯ লাখ মানুষকে সাপে দংশন করে। এর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ১৬ থেকে ২০ জনের মৃত্যু হয়। বছর শেষে সেই হিসাব ছয় হাজারে গিয়ে ঠেকে! (সূত্র: বাসস, ২৯ এপ্রিল ২০২২)
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায় সাপের দংশনে তমা (৬) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে গত ১২ সেপ্টেম্বর। খুবই মামুলি একটি খবর। এমন খবর ভেতরের পাতায় তিন ইঞ্চি জায়গারও দাবিদার নয়। তমা এখন সাপে কাটা মৃতদের ‘গ্রুপ অব সিক্স থাউজেন্ড’-এর একজন।
তমা ‘খুন’ হয়েছে অবহেলা আর অসহযোগিতার ফলে। খবরটার একটু গভীরে যাওয়া যাক। দিগনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী তমা সেদিন রাতে খাবার খেয়ে মায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমন্ত অবস্থায় এক বিষধর সাপ তাকে দংশন করে। চিকিৎসার জন্য তমাকে প্রথমে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন না থাকায় চিকিৎসকরা তাকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। সেখানেও ওষুধ না থাকায় তারা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু হয়। ওষুধ কি আদতেই ছিল না?
সরকারি কাগজে-কলমে সব উপজেলা আর জেলা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন রয়েছে বা থাকার কথা। সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস গত বছরের ২৯ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা দপ্তরের বরাত দিয়ে জানায়, ‘দেশে এখন পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম মজুত রয়েছে। সারাদেশের ৮০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিভিল সার্জন কার্যালয়, জেলা সদর হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪১ হাজার ৪৭০ ডোজ প্রতিষেধক সরবরাহ করা হয়েছে। আরও প্রচুর মজুত রয়েছে।’ একই খবরে বাসস আরও নিশ্চিত করে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তাদের জানিয়েছেন, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় অ্যান্টিভেনম সরবরাহের পাশাপাশি চিকিৎসকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। খুবই পরিষ্কার কথা। তাহলে তমাকে কেন মরতে হলো? ওষুধ আছে, প্রশিক্ষণ আছে, রোগীও অহেতুক ওঝা-ফকিরের কাছে ছোটাছুটি না করে হাসপাতালে ছুটে এসেছিল। তবে কি অ্যান্টিভেনম নিয়ে চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে, নাকি মন্ত্রণালয় আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কথা-কাজে গরমিল আছে? নাকি ওষুধ সবার জন্য নয়?
অ্যান্টিভেনমের অভাবে তমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর শৈলকুপার লাগোয়া উপজেলা হরিণাকুণ্ডুতে সেলিনা বেগমকে সাপে কাটে। ৩০ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে সেলিনা বেগমকে সাপে কাটে। মাকে সাপে কেটেছে শোনার পর বড় ছেলে মোটরসাইকেলে করে রাতের বেলায়ই তাঁকে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। হতে পারে সেলিনা বেগমের ছেলে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত বলেই হয়তো ভালো মনোযোগ পেয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসকের একটি কথায় খটকা থেকেই যাচ্ছে, তিনি জানিয়েছেন, ‘অ্যান্টিভেনম দিতে হয়নি।’ তবে কি হরিণাকুণ্ডু উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম আছে বা ছিল কিন্তু দিতে হয়নি?
মাস কয়েক আগে এক সেমিনারে কথা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানালেন, অ্যান্টিভেনমের মজুত থাকা সত্ত্বেও অনেক জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকরা নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক সময় অ্যান্টিভেনম দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। তাদের ধারণা, অ্যান্টিভেনম প্রয়োগে রোগীর শরীরে তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে; যার ব্যবস্থাপনা করার মতো সক্ষমতা তাদের নেই। হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা অনেকে বলেন, ‘আমাদের এখানে কনসালট্যান্ট বা অ্যানেসথেশিওলজিস্ট না থাকায় অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না।’ বছর দুয়েক আগে (সেপ্টেম্বর ২০২১) দৈনিক ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদককে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা হাসপাতালের আরএমও জানিয়েছিলেন, আমদানি করা অ্যান্টিভেনমে ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। রোগী মারা গেলে চিকিৎসকরা হামলার আতঙ্কে থাকেন। তাই ঝুঁকি এড়াতে উপজেলা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয় না। আরেকজন অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন বলেছিলেন, ভারত ও ইউরোপের সাপ থেকে বাংলাদেশের সাপের ধরন কিছুটা আলাদা। তাই সেখান থেকে আমদানি করা অ্যান্টিভেনম অনেক সময় কাজ করে না। এ জন্য দেশি সাপের অ্যান্টিভেনম জরুরি। এগুলো ওজর না সত্যি, মিথ না বাস্তব– সেটি নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা হওয়া উচিত।
টাঙ্গাইলের মধুপুরের জলছত্র খ্রিষ্টান হাসপাতাল ১৯৫৮ সাল থেকে অ্যান্টিভেনম দেওয়া শুরু করে। বৃহত্তর ময়মনসিংহে টানা ছয় দশক এটিই ছিল সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসায় একমাত্র নির্ভরযোগ্য হাসপাতাল। এ হাসপাতালে সাপে কাটা চিকিৎসার ওপর মানুষের খুব ভরসা ছিল। ২০১৪ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জেলা সদর ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে জলছত্র হাসপাতাল সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। হাসপাতালের একজন পরিচালক অ্যান্টিভেনম ভীতি দূর করার জন্য ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে টাঙ্গাইলের ১২ উপজেলার ২৪ জন ডাক্তারকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। তাঁর কষ্টের কথা হলো, ‘সরকার প্রচুর অ্যান্টিভেনম আমদানি করছে। তাহলে কেন উপজেলা হাসপাতালের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তাররা সাপে কাটার অ্যান্টিভেনম পুশ না করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে রোগীকে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলেন, তা বোধগম্য নয়।’ তমাকে বাঁচানোর চেষ্টা কেউ করেনি। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে তাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত হওয়া উচিত শৈলকুপা ও ঝিনাইদে অ্যান্টিভেনম না থাকার তথ্য আসলেই সঠিক কিনা। হরিণাকুণ্ডুতে থাকলে শৈলকুপা বা ঝিনাইদহে থাকবে না কেন? আরেক তমাকে সাপে কাটার আগেই এই অনুসন্ধান শেষ করতে হবে। অ্যান্টিভেনম নিয়ে কোনো মিথ থাকলে সেটি ভাঙতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মী আর চিকিৎসকদের এ ব্যাপারে দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। তমারা কিন্তু ছাড়বে না। অবহেলায় মৃত্যুর সব কথা তারা আল্লাহকে বলে দেবে নিশ্চয়।