‘সাপের কামড়ে মৃত্যু ‘ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৩)
মানুষের বসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গল, জলাভূমি কমেছে। ফলে সাপের বিচরণভূমিও দিন দিন সীমিত হয়ে আসছে। যেসব সাপ বসতবাড়ির কাছাকাছি অন্যান্য প্রাণীর করা গর্ত, সুড়ঙ্গ দখলে নিয়ে বসবাস করত তাদেরও সংকট বেড়েছে। মানুষ এখন ঘরবাড়ির নির্মাণশৈলীতে পরিবর্তন এনেছে, আগের মতো কাদামাটির বাড়িতে বসবাস তেমন একটা নেই। মোদ্দা কথা, সাপের বসবাসের অনুকূল পরিবেশ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে, হবে। এ রকম বৈরী পরিবেশে সাপের সংখ্যা কমে যাওয়ার কথা, কমার কথা সাপে কাটার ঘটনা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী হচ্ছেও তাই কিন্তু মৃত্যু বাড়ছে। আগের চেয়ে সাপে কাটা মানুষকে বাঁচানো যাচ্ছে কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে সাপের কামড়ের ঘটনা বছরে সাত লাখ থেকে কমে চার লাখ হলেও মৃত্যু বেড়েছে। মৃত্যু এখন গড়ে ৬ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৭ হাজার। অনেক বড় রোগব্যাধিতেও বছরে এত মৃত্যু হয় না। তবে কি সাপ আগের চেয়ে বেশি বিষধর হয়ে উঠেছে? নাকি সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় কোনো গাফিলতি বা অব্যবস্থাপনা আমাদের গ্রাস করছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্যহীনতা এবং বাস্তুসংস্থানের অভাবে বিষধর সাপ লোকালয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। অন্যভাবে বলা যায়, লোকালয় সাপের বসবাসের আঙিনায় চলে যাওয়ায় বিপত্তি বাড়ছে। গবেষকরা বলেন, সাপ নিজে আক্রান্ত না হলে মানুষকে কামড় দেয় না। তবে কি মানুষ প্রাণিজগতের প্রতি আগের থেকে বেশি মারমুখী আর নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। নানা কারণে মানুষের মনে ছোটকাল থেকেই ‘সর্পভীতি’ বাসা বাঁধে। সাপ আমাদের যে উপকারও করে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই ধারণাটা আমাদের মর্মে নেই। মনের গভীরে থাকা ‘সর্পভীতি’ থেকে সাপের প্রতি আমাদের নির্দয় করে তোলে। যদিও তথ্য বলছে, বেশিরভাগ সাপই নির্বিষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাপের কামড়ের সব ঘটনার মধ্যে এক-চতুর্থাংশ বিষাক্ত। আমাদের দেশে রাজ গোখরো, পদ্ম গোখরো, খৈইয়া গোখরো, কালাচ, শঙ্খিনী, কালকেউটে, দাঁড়াশ, অজগর, ঘরগিন্নি, ঢোঁড়া, বেত আচরা, কালনাগিনী, বালি, কমলাবতীসহ দেশে প্রায় নব্বই প্রজাতির সাপ আছে। এর মধ্যে মাত্র ছাব্বিশ প্রজাতির সাপ বিষধর।
বিষধর সাপ কি বাড়ছে?
সর্পভীতি থেকে সাপের প্রতি মারমুখী হয়ে থাকা মানুষের হাতে নিরীহ ও উপকারী সাপ যেমন দাঁড়াশ, ঘরগিন্নি, ঢোঁড়া, বেত আচরা প্রভৃতি সাপ এখন দুর্লভ প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। বলা যায়, প্রায় নির্বংশ হয়ে গেছে। কিন্তু নতুন নতুন বিষধর প্রজাতির সাপের দেখা মিলছে। রাসেলস ভাইপার ওরফে চন্দ্রবোড়া এখন নতুন ‘সর্প সন্ত্রাস’-এর নাম হয়ে উঠেছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করলেও সাপের করেনি বরং তথাকথিত ‘নোম্যান্স’ ল্যান্ডগুলো তাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। তা ছাড়া বন্যার পানি কাঁটাতারের বেড়া মানে না। বন্যার সময় অনেক প্রজাতির সাপ এ দেশে ভেসে আসে। রাসেলস ভাইপার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় ২০০০ সালের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ভয়াবহ ও অভূতপূর্ব বন্যার পর। বাংলাদেশে প্রায় ১০০ বছরে এই সাপের অস্তিত্বের কথা জানা যায়নি। বর্তমানে এ সাপের কামড়ে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এই সাপে কামড় দিলে খুব কম সময়ের মধ্যে রক্তে এর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়, কিডনি বিকল করে দেয়। রক্তচাপ কমিয়ে দেয়। মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। নতুন আবির্ভূত রাসেলস ভাইপার নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। গবেষকরা বলছেন, এ কারণেই দেশে মোট সাপে কামড়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। অনেকে রাসেলস ভাইপারের কামড়ের চিকিৎসায় দেশে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনমের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে ধারাবাহিক গবেষণা ছাড়া এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।
আমাদের গাফিলতি আছে কি?
দেশে সাপে কামড়ের ৯৫ ভাগ ঘটনা ঘটে গ্রামে। খুলনা ও বরিশালে সাপে কামড়ে প্রাণহানি দুই থেকে তিনগুণ বেশি। সাপের বিষের প্রভাবে ১০.৬ শতাংশ শারীরিক ও ১.৯ শতাংশ মানসিক অক্ষমতা দেখা যায়। সাপের কামড়ের ঝুঁকি পুরুষদের বেশি। নারীদের তুলনায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি পুরুষ সাপের কামড়ের ঝুঁকিতে থাকে। জুলাই-আগস্ট মাসে সাপের উৎপাত বাড়ে। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে ন্যায্যতার সঙ্গে কার্যকরী করার ক্ষেত্রে এসব তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের জানা। কিন্তু তার পরও মৃত্যুর হার বাড়ছে। ‘হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন’ এটাই বেশি লেখা বা বলা হচ্ছে সাপে কাটার খবরে।
সমীক্ষা অনুযায়ী সাপে কাটা রোগীদের মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে আসে। তাও আসে সংকটাপন্ন অবস্থায় শেষ মুহূর্তে ওঝার হাত ঘুরে। আমাদের দেশে এখনো বহু মানুষ সাপে কাটার পর ডাক্তারদের তুলনায় ওঝা, ঝাড়ফুঁকের ওপর বেশি ভরসা রাখে? ভরসা রাখার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে, দেশের বেশিরভাগ সাপই নির্বিষ, তাদের কামড়ে মানুষ মরে না। কিন্তু ‘সর্পভীতি’ থেকে মানুষ দৌড়ায় ঘরের কাছের ওঝার কাছে। যে সাপের বিষ নেই তার কাটা রোগীকে সারিয়ে তুলতে ওঝার তুকতাক ভালোই কাজ করে। ‘ঝড়ে বক মরে আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে।’ চিকিৎসক ও সাপ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরীসৃপ প্রাণীর কামড়ে আক্রান্ত হওয়ার পর বেশিরভাগ সময় আক্রান্ত ব্যক্তি আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। আক্রান্ত ব্যক্তিকে আশ্বস্ত করতে হবে, ভয়ের কিছু নেই। এর চিকিৎসা রয়েছে। সাপের কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো ওঝা বা কবিরাজের কাছে নিয়ে সময় নষ্ট করার পরিবর্তে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
মানুষ কেন হাসপাতালে যায় না?
এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে হাসপাতালগুলো আস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট যে কোনো কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করলেই গড়গড়িয়ে বলে দেবেন, ‘আমাদের প্রতিটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং জেলা সদর হাসপাতালে সাপের কামড়ের প্রতিষেধক (অ্যান্টিভেনম) আছে। সব জায়গায় আমাদের প্রশিক্ষিত জনবল আছে। আমরা নিয়মিত চিকিৎসকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সরাসরি এবং এক বছর ধরে আমরা অনলাইনে এ বিষয়ে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। প্রায় প্রতিটা প্রশিক্ষণে স্নেক বাইট বিশেষজ্ঞরা প্রায় প্রত্যেকে উপস্থিত থাকেন। এই প্রশিক্ষণ প্রতি মাসের প্রথম বুধবার দুপুর বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি কর্মকর্তাদের কথা ঠিক হয় তা হলে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের কৃষক শামসুল হককে কেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দরজা থেকে ওষুধ নেই বলে ফিরিয়ে দেওয়া হলো? পরে শামসুল হককে নেওয়া হয় ৫০ কিলোমিটার দূরের দিনাজপুর জেলা সদর হাসপাতালে। যদিও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাকে মৃত ঘোষণা করেন সেখানকার চিকিৎসকরা। এটা যে শুধু কৃষক শামসুল হকের ক্ষেত্রে ঘটেছে তাই নয়।
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী বাজারে অফসেট প্রেসের মালিক শাহাদাত শেখের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। রাতে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় শাহাদাতকে বিষধর সাপ কামড় দেয়। পরে রাতেই তাকে কাশিয়ানী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে অ্যান্টিভেনম না থাকার কথা বলে তাকে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিতে বলা হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে দ্রুত খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। সেখানে শাহাদাতের মৃত্যু হয়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাপুড়ে নজরুল ইসলাম মারা যান গত জুলাই মাসে। সাপে কাটার পর নজরুল ইসলাম জীবন্ত সাপসহ ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যান। নজরুলের ভাই লালন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সেখানে অ্যান্টিভেনম ছিল না। বত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে বাইরে থেকে কিনে দুই ডোজ অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়। এক রাত, দুই দিন ওই হাসপাতালে থাকার পর চিকিৎসকরা ৩৫ বছর বয়সী নজরুল ইসলামকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন।
এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা যাবে। হাসপাতাল যে রোগীকে ফিরিয়ে দেয় তার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। ওষুধ থাকলেও ফিরিয়ে দেয়, না থাকলেও দরজা বন্ধ করে দেয়। নবাবগঞ্জের কৃষক শামসুল হকের ঘটনা থেকে জানা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম ছিল। পুশ করার চিকিৎসক না থাকার অজুহাতে দেওয়া হয়নি রোগীকে। সাপের কামড়ের শিকার বেশিরভাগ মানুষের অভিজ্ঞতাই শামসুল হকের মতো। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অজুহাতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় রোগীকে। সেদিন ঢাকার এক সেমিনারে সে কথা অবলীলায় স্বীকার করলেন এক কর্মকর্তা।
দাম বেড়েছে ওষুধের
সাপের কামড় এবং মৃত্যুর উচ্চ প্রকোপ সত্ত্বেও, স্থানীয়ভাবে কোনো অ্যান্টিভেনম উৎপাদিত হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দান আর ইন্ডিয়া থেকে আমদানি করা ওষুধ দিয়েই আমাদের চলছে। চট্টগ্রামে জার্মানির সহযোগিতায় অ্যান্টিভেনম প্রকল্পের গল্প অনেক লম্বা। সেটা আরেকদিন বলা যাবে। সরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম নাই নাই করায় প্রায়ই রোগীর পরিবারকে চড়া দামে খোলাবাজার থেকে তা কিনতে হচ্ছে। এখন ১ ডোজ মানে ১০ ভায়াল অ্যান্টিভেনমের দাম ১৬ হাজার টাকা হয়েছে। গত বছরও ১ ডোজের দাম ছিল ১০ হাজার টাকা। বাজারের ওষুধের মান নিয়ে জীবন দিয়ে প্রশ্ন রেখে গেল সাপুড়ে নজরুল ইসলাম।
সোনালি একশ বা গোল্ডেন রুল অব ১০০ কী?
সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০০ মিলিলিটার অ্যানটিভেনম শরীরে প্রবেশ করালে রোগী বেঁচে যাবেÑ এটাকেই বলা হয় ‘গোল্ডেন রুল অব ওয়ান হানড্রেড।’
আমাদের দেশের তুলনায় অস্ট্রেলিয়ায় অনেক বেশি বিষধর সাপ থাকলেও মৃত্যু হয় পাঁচ বছরে সাকল্যে দুই থেকে তিনজনের। আমাদের দেশে রোগীর গুরুত্বপূর্ণ প্রথম এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট (গোল্ডেন আওয়ার) বিনা চিকিৎসায় নষ্ট হয়ে যায়।
এ কথাটা জোরেশোরে প্রচার করতে হবে। কিন্তু তার আগে ব্যাপকভাবে স্বচ্ছতার সঙ্গে জেলায় জেলায় প্রচার করতে হবে কোন হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম আছে। এই তথ্যটা গোপন রাখার কারণ কী?