সাইক্লোন সিত্রাং ও গাছচাপায় মৃত্যু নিয়ে দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২২)
এবারও বেশিরভাগ মানুষ মারা গেছে গাছচাপায় : মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ যে আশ্রয়স্থল- সেই ঘরের ওপর গাছ পড়ে, কোথাও সরাসরি গাছচাপায় সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যে ৩৫ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে ১৪ জন সরাসরি গাছচাপায় মারা গেছেন।
আমাদের অনেকেরই একটু বাড়িয়ে বলার অভ্যাস আছে। তিলকে তাল করার চর্চা এখন আর বিস্ময়ের সৃষ্টি করে না। সেই অভ্যাসেই কি একটা ক্রান্তীয় ঝড়কে সুপারসাইক্লোন বলে ঢাক-ঢল পেটালাম? সিত্রাংয়ের লম্বা লম্বা সিং দেখেছিলেন অনেকেই। বাঘ এলো বাঘ এলো বলে সবকিছু এলোমেলো করে কী লাভ হয়? মানুষের আস্থা আর বিশ্বাসে চিড়টা ক্রমেই বড় হয়। তার পর যেদিন সত্যিই বাঘ আসবে, সেদিন মানুষ গড়িমসি করবে, আগাবে না। বিশ্বাস করবে না পূর্বাভাসের একটি বর্ণও।
এখন আবহাওয়াবিদরা বলছেন, আমরা ঠিক ঠাহর করতে পারিনি বর্ণচোরা ছিল সিত্রাং। শুরু থেকেই সে পাগলাটে আচরণ করেছে। পাল্টেছে গতিপথ বারবার। ঠিকমতো বোঝা যায়নি। আসতে পথে বৃষ্টি ঝরিয়ে নিজের শক্তি ক্ষয় করেছে। যেমন চট করে এসেছে, তেমন চটজলদি চলে গেছে। এর কোনোটায় গোপনে করেনি সিত্রাং। স্কুল-কলেজ পাস না করা আবহাওয়াবিদরা ঠিকই টের পেয়েছিলেন সিত্রাংয়ের ‘শক্তি’। দুবলারচর থেকে মহেশখালী- যেখানেই ২৪ অক্টোবর সকালে যোগাযোগ হয়েছে, সেখান থেকে একই আওয়াজ এসেছে ‘তুফান আসার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে আর ভয় নাই।’ সাইক্লোনের মাপ বোঝার এটা একটা তরিকা। স্থলভাগ গরম থাকলে সাইক্লোন তাকে ঠাণ্ডা করার জন্য ছুটে আসে। কিন্তু বৃষ্টি-বাতাসে স্থলভাগ ঠাণ্ডা হয়ে গেলে সাইক্লোন আর নিশানা পায় না। মানুষ যে আমাদের থেকে বেশি জানে, ঝড়কে বেশি বোঝে- সেটি আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। মনে করি, মানুষের কাছে শেখার কিছু নেই!
যদি কোনো নিম্নচাপ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার গতিবেগ অর্জন করে, তা হলে সেটি আঞ্চলিক ঝড় বলে মনে করা হয় এবং তখন সেটির নাম দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে, নাম দিলেই সেটি কেউকেটা হয়ে যায় না। ঝড়ের গতি যদি ঘণ্টায় ১১৯ কিলোমিটার (৭৪ মাইল) গতিবেগ অর্জন করে- তা হলেই কেবল সেটিকে হারিকেন, টাইফুন বা সাইক্লোন বলে ডাকা হয়। কেউ কেউ দাবি করেছেন, সিত্রাংয়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল (দমকা হাওয়ায়) ৮৫ কিলোমিটার- যা ঘণ্টায় প্রায় ৫০ মাইলের মতো। স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই দেশের উপকূলের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন বেগে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। প্রকৃতপক্ষে উপকূল অতিক্রমের সময় এর গতিবেগ ছিল ৬২ থেকে ৭০ কিলোমিটার। তবে গোপালগঞ্জে সব থেকে বেশি ৭৫ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানে। এটিই সর্বোচ্চ গতিবেগ বলে রেকর্ড করেছে আবহাওয়া বিভাগ। আগের দিন সোমবার ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় যখন ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং দেশের উপকূলে আঘাত হানছিল, তখন কক্সবাজারে প্রতিঘণ্টায় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ৭৪ কিলোমিটার রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার প্রথম থেকেই (২২ অক্টোবর) এ ঝড়টিকে একটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় হিসেবে আখ্যায়িত করে এসেছে। মোদ্দা কথা, কোনো বিবেচনাতেই সিত্রাংকে কুলীন সাইক্লোন বলা যাবে না। বড়জোর এটাকে একটা সাধারণ সাইক্লোন বলা যেতে পারে কিংবা বলা উচিত ছিল বড় এক কাইতান আসছে। তাতে মানুষের পক্ষে প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হতো। উপকূলে সুপারসাইক্লোনের বাজনা বাজিয়ে মানুষকে বরং বিভ্রান্তই করা হয়েছে। কক্সবাজার, হাতিয়া, মোংলার সাইক্লোনে টাঙ্গাইলের ১৫ হাজার হেক্টর জমির কলাবাগান মাটির সঙ্গে মিশে যাবে কেন? যদি বলা হয়তো সারাদেশে ৫০ মাইলের বেশি বেগে ঝড় হবে, থাকবে মুষলধারার বৃষ্টি এবং জানানো যেত বাতাসপ্রবাহের দিকটা- তা হলে মানুষ তৈরি হতে পারত।
কার্তিক মাসে ক্রান্তীয় ঝড় এ দেশে নতুন কিছু নয়। আশ্বিনে আইতান, কার্তিকে কাইতান, বাংলা বদ্বীপে ঝড়-বৃষ্টি- এই দিনপঞ্জি কৃষকের অজানা নয়। কার্তিকে টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হয়, উথাল-পাথাল বাতাস বয়। এসবই শীতের আগমনী বার্তা। কার্তিকের এ বৃষ্টিকেই কাইতান বলে। অঞ্চলভেদে উচ্চারণের রকমফের থাকতে পারে। বাগেরহাটে যেটা ‘ক্যাতেন’, ময়মনসিংহ অঞ্চলে সেটিই ‘কাইতেন’। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় কাইতানের কথা আছে। তার বেড়ে ওঠা নেত্রকোনায়। বোধ করি শৈশবে নেত্রকোনায় তিনি কাইতান দেখেছেন নিবিড়ভাবে। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’তেও কাইতানের সন্ধান মেলে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাড়াও সুনামগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুরে কৃষকরা কাইতান বোঝেন এবং মেনেই চলে। কার্তিকের অমাবস্যা-পূর্ণিমায় কাইতান এলে তারা প্রস্তুত হতেন ভিন্নভাবে।
কালবৈশাখীর মতো কাইতান স্থানীয় ঝড়-ঝঞ্ঝা নয়। একটা জেলায়, একটা উপজেলায়, একটা গ্রামে কালবৈশাখী আসতে পারে। কিন্তু কাইতান আসে বড় পরিসরে। উপকূলের কাছের-দূরের অনেক জেলাকে সে ভিজিয়ে দেয় এবং গাছপালা ও দুর্বল বাড়িঘর তচনছ করে দিতে পারে। কৃষকদের হিসেবে কাইতান যেন নাইয়রে আসে। এক-দুই দিনে তার সাধ মেটে না। তিন দিন, পাঁচ দিন বা সাত দিন ধরে ঝরতে থাকে। মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়া ছাড়ে। তাতে নাজুক গাছপালা উপড়ে যায়। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বলেন, বর্ষার পানিতে গাছপালার শিকড় নরম মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই জোরে দমকা হাওয়া হলেই সে কাবু হয়ে যায়।
এবারও বেশিরভাগ মানুষ মারা গেছে গাছচাপায় : মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ যে আশ্রয়স্থল- সেই ঘরের ওপর গাছ পড়ে, কোথাও সরাসরি গাছচাপায় সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যে ৩৫ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে ১৪ জন সরাসরি গাছচাপায় মারা গেছেন। বাকিরা মারা যান পানিতে বা নৌযান ডুবে। জীবনহানি ছাড়াও এসব গাছ পড়ে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়, ভেঙে পড়ে বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থা। মহাসড়কে গাছ পড়ার কারণে সোমবার রাতে ঢাকার সঙ্গে খুলনা ও বরিশালের সড়ক যোগাযোগ কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে দক্ষিণের জেলাগুলোর অনেক এলাকা বলতে গেলে সোমবার সন্ধ্যা থেকেই বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে। নিমেষে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় ৮০ লাখ মানুষ অন্ধকারে ডুবে যায়। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী স্বীকার করেন, ‘… গাছ উপড়ে, পোল ভেঙে পড়ে অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছে…।’
এই সময় শুধু পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডেরই আটশর বেশি বিদ্যুতের খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী এলাকার বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থা বলতে গেলে একেবারেই ভেঙে পড়ে।
ঝড়ের রাতে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষের সূত্রে জানা গেছে- রাজধানীর হাতিরঝিল, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, গণভবনের সামনে, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, শ্যামপুর ও নীলক্ষেতসহ ১৮টি স্থানে গাছ উপড়ে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা রাস্তা পরিষ্কারের চেষ্টা করেন প্রায় সারারাত। গাছ পড়ে যাওয়ার কারণে রামপুরা উলনে বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রের একটি গ্রিড বন্ধ করে দেওয়া হয়। রামপুরা থেকে বিকল্প উপায়ে লাইন চালু রাখার চেষ্টা করা হয়।
কেন এত গাছ উপড়ে পড়ে : দেশের অন্তত ১০টি জেলায় উপড়েপড়া গাছের ছবি আর সরেজমিন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভেঙে পড়া বেশিরভাগ গাছ ছিল দ্রুতবর্ধনশীল অদেশি গাছ। যেমন- চাম্বল (চা বাগানে ছায়াবৃক্ষ হিসেবে আমদানি করা গাছ), কৃষ্ণচূড়া (মাদাগাস্কার থেকে রেল কোম্পানির আনা গাছ), লম্বু, রেন্ডি কড়াই বা রেইন ট্রি ইত্যাদি। এসব গাছ তাড়াতাড়ি বাড়ে আর তুলনামূলকভাবে লম্বা হলেও দুর্বল এবং এর শিকড় মাটির নিচে বেশিদূর যায় না। কথিত গাছগুলো এতই ভঙ্গুর কিসিমের যে, সামান্য ঝড়োবাতাসে ভেঙে পড়তে পারে।
ঝড়ের সপ্তাহ তিনেক আগে (৪ অক্টোবর ২০২০) সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে বেড়াতে গিয়ে গাছচাপায় এক নারী (৩০) দর্শনার্থীর মৃত্যু হয়, আহত হয় ১২ বছরের এক শিশু। জাতীয় স্মৃতিসৌধ ঘুরে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে তারা পরম বিশ্বাসে গাছের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। এমন সময় বাহারি চাম্বল গাছ ভেঙে পড়ে তাদের মাথার ওপর।
কোনো রকম ঝড়-বৃষ্টি ছাড়াই ২০১৬ সালের ৭ মার্চ রাজধানীর ধানমন্ডিতে কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালের নিচে চাপা পড়ে বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা খালিদ মাহমুদ মিঠুর মৃত্যু হয়। সেদিন দুপুরে নিজের বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামার পর আকস্মিক একটি গাছের ডাল ভেঙে তার মাথায় পড়ে। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘গহীনে শব্দ’ মুক্তি পেয়েছিল ২০১০ সালের ২৬ মার্চ। এই ছবির জন্য সেরা পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছিলেন মিঠু। শুধু ভুল জায়গায় একটা ভুল গাছ তার মৃত্যুর কারণ হয়ে থাকল। সিডোরের পর থেকেই ভুল গাছের বিষয়ে আওয়াজ তুলেছিলেন পরিবেশ আর উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা। সে কথা কেউ কানে তোলেননি এবং তুলছেনও না। বড় বড় সাইক্লোন শেল্টারের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক জায়গায় ঠিক গাছটা লাগাতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এটাও একটা আবশ্যিক উপাচার।
ভোগান্তি বাড়িয়েছে পয়ঃনিষ্কাশন : সিত্রাংয়ের আঘাতে আক্রান্ত প্রায় সব শহরে জলবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ায় জনদুর্ভোগ মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। দুপুর না যেতেই বৃষ্টিতে পুরান ঢাকার বংশালে রাস্তায় হাঁটুসমান পানি জমে যায়। এর পর বিমানবন্দর সড়ক, মিরপুর, বসুন্ধরা, গুলশান, মহাখালী, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় পানি জমে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হতে থাকে।
গ্রিন রোড সংলগ্ন সড়কে কোমরপানি হয়ে যায়। ব্যস্ততম সড়ক পান্থপথ সিগন্যাল থেকে গ্রিন রোডমুখী সড়কের পুরোটাই পানিতে তলিয়ে যায়। কাঁঠালবাগানের রেস্তোরাঁ ও জুরাইনের মসজিদে পানি ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শহীদ স্মৃতি হলের নিচতলার ডাইনিং রুম বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায়। ফকিরাপুল মোড় থেকে নটর ডেম কলেজ পর্যন্ত সড়কটি রাত ১০টার পরও পানিতে তলিয়ে থাকে।
কাঁঠালবাগান, বেগম রোকেয়া সরণির কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়ার অধিকাংশ বাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে পড়ে। জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় কিছু ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখেন ভবনমালিকরা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন- যতই দিন যাবে সিত্রাংয়ের মতো ঝড়-ঝঞ্ঝার আনাগোনা বাড়বে। তাই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে সব সময় সব দিকে, মানুষের অভিজ্ঞতা আর বিজ্ঞানকে আমলে নিতে হবে এবং ঠিক কাজটা ঠিক সময় করতে হবে।