প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত আগস্ট, ১৯৭১ সালে কুষ্টিয়ায় গণহত্যার ওপর লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা, প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২২
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিল কুষ্টিয়ায়। ১৯৭১ সালের ৩০ ও ৩১ মার্চের সেই যুদ্ধে কর্মকর্তাসহ শতাধিক হানাদার সেনার প্রাণ যায়। কুষ্টিয়া যুদ্ধে আমাদের পক্ষে প্রাণ হারান ছয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন যুদ্ধের অভিজ্ঞতাহীন কিশোর–তরুণ। আশপাশের থানা (এখন উপজেলা), মহকুমা (এখন জেলা) থেকে আসা এসব সাহসী তরুণ ছিলেন সেদিনের যুদ্ধের মূল শক্তি। সেই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন কুমারখালীর দুধকুমড়া গ্রামের ওমোদ আলীর ছেলে হামেদ আলী, মিরপুরের আলম হোসেনের ছেলে দেলোয়ার হোসেন, মেহেরপুরের বামনপাড়া গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে খন্দকার আবদুর রশিদ, নাসির উদ্দিনের ছেলে ফজলুর রহমান, হাছেন আলী খানের ছেলে আশরাফ আলী খান ও মিরপুরের নজীর শেখের ছেলে গোলাম শেখ।
অনভিজ্ঞ তরুণদের কাছে পরাজয়ের গ্লানিতে অন্য রকম জিঘাংসা তৈরি হয় হানাদারদের মনে। পরাজয়ের ঘায়ে নুনের ছিটা পড়ে যখন সাংবাদিক ড্যান কগিন বিখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিনের ১৯ এপ্রিল ১৯৭১ সংখ্যার প্রচ্ছদ রচনা করেন কুষ্টিয়া যুদ্ধকে উপজীব্য করে। কুষ্টিয়া পুনর্দখলের সব কটি চেষ্টা ছিল ভয়ংকর রকমের ধ্বংসাত্মক। পাল্টা–আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদাররা বিমান ব্যবহার করে।
জনসমাগম নজরে এলেই খুব নিচ দিয়ে উড়ে মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়ে মানুষ হত্যা করে তারা। নদীতে পানি কম আর পর্যাপ্ত নৌকা না থাকায় অনেক মানুষ হেঁটেই শুকনা নদী পার হয়ে গ্রামের দিকে ছুটছিল। গ্রামমুখী মানুষের ওপর নির্বিচার গুলি চলে ১১ এপ্রিল। সেদিন কুষ্টিয়া ও কুমারখালীর গড়াই নদের বুকে কতজন নিহত হয়েছিল, তার কোনো হিসাব নেই।
পরের দিন ১২ এপ্রিলের বিমান হামলা ছিল আরও ভয়াবহ। কুষ্টিয়া শহরের রাস্তাঘাট, দৃশ্যমান স্থাপনা, এমনকি মানুষের বাড়িঘরে বারবার বিমান থেকে গুলি ছোড়া হয়। কোনোরকম প্রতিরোধের আলামত না পেয়ে বিমানগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
একপর্যায়ে আগের চেয়ে অনেক নিচু হয়ে উড়তে থাকে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধমূলক বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণে একটি জঙ্গিবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিন দিন পর ১৫ এপ্রিল বিমানবহরের ছত্রচ্ছায়ায় পাকিস্তানি পদাতিক বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাস্তার দুই পাশে আগুন দিতে দিতে ঝিনাইদহের বিশাখালী পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
একই সময়ে আরেক পদাতিক বাহিনী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে নগরবাড়ী ঘাট পার হয়ে পাকশি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের অপর পাড়ে এসে অবস্থান নেয়। পদাতিক বাহিনীর এই দলটি বিমানবাহিনীর সমর্থন নিয়ে ভেড়ামারা-কুষ্টিয়া সড়ক আর রেলসড়কের দুই পাশের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এ সময় আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকা শত শত নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ওই দিন ভেড়ামারার অদূরে চণ্ডীপুরে একই পরিবারের ১৪ জনকে একসঙ্গে হত্যা করে তারা। পরবর্তী ১৪ দিনে (১৬ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল) কুষ্টিয়া জেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। নষ্ট ও লুট করা হয় কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এই ধ্বংসযজ্ঞের খতিয়ান মেলে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছিল ‘কথিত অভিযানে শহরের প্রায় ৯০ ভাগ বাড়ি, দোকান, ব্যাংক প্রভৃতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে।’
জিঘাংসা চরিতার্থের সেই ‘পোড়ামাটি’ হামলার প্রথম ১৪ দিন ছিল ‘যাকে পারো যত পারো’ হত্যা করার দিন। এই নীতির বলি হয় শহর–গ্রামের ২০ হাজার শিশু–নারী–পুরুষ। ভেড়ামারা উপজেলার দিক থেকে শহরে ঢুকলে প্রথমেই সামনে পড়ে নিবিড় জনবসতির থানাপাড়া। এখানকার প্রতিটি বাড়িতে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এন্তাজ আলী, তাঁর ছেলে আনসার আলী, তাঁদের প্রতিবেশী জন মেহের বিশ্বাস। পাশের বাড়িতে খুন হন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রফিক, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) মকবুল আলম। রক্তের হোলি খেলায় মত্ত হানাদার বাহিনী একের পর এক বাড়ির দরজা ভেঙে গণহত্যা চালাতে থাকে। তাদের হাতে নিহত হন আছিয়া খাতুন, ব্যবসায়ী শাহজাহান, আবদুল হামিদ খান, আবদুস সাত্তার। একদল অবাঙালি হানাদারদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পুরো শহরটাকে নিমেষেই নরক বানিয়ে ফেলে। সন্ধ্যার পরও চলতে থাকে পাড়ায় পাড়ায় হত্যা, বাড়িঘরে আগুন আর লুটপাট। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সন্ধ্যার দিকে আগুনে পুড়তে থাকা শহর থেকে পরিবার নিয়ে বের হতে গিয়ে হারিয়ে যান শিক্ষক আবদুল লতিফ। তাঁর সন্ধান আর মেলেনি। এক দিনে শহর থেকে চিরতরে হারিয়ে যান প্রায় এক হাজার মানুষ। শহর একেবারে বাঙালিশূন্য হয়ে যায়।
হানাদার বাহিনী এরপর মন দেয় তাদের স্থানীয় সহায়ক শক্তি গড়ে তোলার কাজে। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃতে গঠিত হয় শান্তি কমিটি। গড়ে তোলা হয় অবাঙালিদের প্রাধান্যে রাজাকার আর মুজাহিদ বাহিনী। অবাঙালিপ্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিত শহর আর বসতি (সৈয়দপুর, ঈশ্বরদী, শান্তাহার) থেকে দলে দলে দাঙ্গাবাজ লুটেরা কিছিমের লোকদের জন্য খুলে দেওয়া হয় শহর। যেখানে যা খুশি করার ছাড়পত্র ছিল তাদের। লুটপাট, দোকান দখল, গুম–খুন ছিল তাদের প্রধান কাজ।
এদের ভয়ে গ্রাম থেকে, বিশেষ করে গড়াই নদের অপর পার থেকে শহরের জোগান বন্ধ হয়ে যায়। শহরের কাঁচাবাজার, ডিম–দুধের সরবরাহ চালু রাখার জন্য হানাদারদের প্রশাসন নির্বিচার হত্যার লাগাম টানতে বাধ্য হয়। কিন্তু ‘টার্গেট কিলিং’ চলতে থাকে। বধ্যভূমি, বন্ধ ঘর, গুম, মার্শাল ল কোর্ট চলতে থাকে পুরোদমে।
সরকারি কর্মচারীদের কাজে যোগ দিতে বলা হয়। কাজে যোগ দিতে এসে পথেই বা অফিস থেকে ডেকে নিয়ে ‘বন্ধ ঘর’–এ আটকে রাখার ঘটনা ঘটতে থাকে। কুষ্টিয়া যুদ্ধে কার কী ভূমিকা ছিল, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করার পর আটক ব্যক্তিদের ভাগ্য নির্ধারণ করা হতো। পুলিশ লাইনসের সেই ‘বন্ধ ঘর’ থেকে অনেকেই আর কোনো দিন ঘরে ফেরেননি। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ‘বন্ধ ঘর’ খোলা ছিল। বন্ধ ঘরে দুই সপ্তাহ আটক থাকার পর অলৌকিকভাবে মুক্তি পাওয়া টেলিফোনকর্মী সিরাজুল ইসলাম নান্নু তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন প্রথমা প্রকাশিত ‘একাত্তরের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে।
জুন মাস থেকেই শহরের পরিত্যক্ত বাড়িঘর আর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দালাল বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে বিলিবণ্টনের কাজ শুরু করে দেয় দখলদার প্রশাসন। ভয় আর আতঙ্কের মুখে শহর ছেড়ে চলে যাওয়া অনেকে জুলাই মাসের দিকে ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য পরিবারের দু–একজনকে শহরে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করে। শান্তি কমিটির সদস্যরা এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পরিচিত প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে গ্রামে চলে যাওয়া মানুষজনের কাছে ফিরে আসার বার্তা ও আশ্বাস দিতে থাকে তাঁরা। এসবই ছিল হানাদারদের পাতা ফাঁদ। প্রতিটি পরিবারের যুবকদের শেষ করে দেওয়ার সেই ‘টার্গেট কিলিং’–এর ফাঁদে অনেকেই ধরা দেন। অনেকে দিনে থাকলেও রাতে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ে চলে যেতেন। আগস্টের ভয়াবহ বন্যার কারণে সেই চলাফেরাটাও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।
১৯৭১–এর আগস্ট মাসে কুষ্টিয়ায় বড় ধরনের বন্যা হয়। কোর্টপাড়া, হাউজিং এলাকাসহ শহরের প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ এলাকা বুকসমান পানিতে তলিয়ে যায়। প্রথমবারের মতো গোরস্তান বন্ধ করে দেওয়া হয়। সীমিত আকারে চালু করা হয় মজমপুরের পুরোনো গোরস্তান। তবে শহরে মানুষ কম থাকায় গোরস্তানের প্রয়োজন তেমন ছিল না।
বন্যার সময় কুষ্টিয়া শহরে দুটি রোমহর্ষ গণহত্যার ঘটনা ঘটে। প্রথমটি আগস্ট মাসের ২৮ তারিখ রাতে আর দ্বিতীয়টি সেপ্টেম্বরের ১৮ তারিখ রাতে। আগস্টের ২৮ তারিখে থানাপাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে ৮–১০ জন যুবককে ধরে এনে ছয় রাস্তার মোড়ে জড়ো করা হয়। তাঁদের অনেকেই এপ্রিল থেকে এ যাবৎ গ্রামে গ্রামে কাটিয়েছেন। শান্তি কমিটি আর পরিচিত অবাঙালিদের উপর্যুপরি আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ফিরে এসেছিলেন তাঁরা। ফেলে যাওয়া বাড়িঘর দেখাশোনা আর মেরামতের জন্য তাঁরা মাত্র কয়েক দিন আগে শহরে ফেরেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্যবসায়ী আবদুস সবুর, তাঁর আত্মীয় আক্কেল মোল্লাসহ দুইজন সহকারী, ভেড়ামারা হাইস্কুলের তরুণ বিজ্ঞান শিক্ষক কামাল উদ্দিন শেখ, তাঁর ছোট ভাই নুরুল ইসলাম শেখ ও ব্যবসায়ী ওবায়দুর রহমান বুলু।
ব্যবসায়ী ওবায়দুর রহমান বুলুর পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তাঁদের প্রতিবেশী কুষ্টিয়া শহর রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার এবং ‘পাক রেস্তোরাঁর’ মালিক উর্দুভাষী নেসার খাঁ ও কুষ্টিয়া শান্তি কমিটির প্রধান সাদ আহমদ সেই রাতে ছয় রাস্তার মোড়ে অবস্থান করে হত্যার দিকনির্দেশনা দেন। এই নেসারই ওবায়দুর রহমান বুলুকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যান। এ ঘটনার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন তাঁর ছোট ভাই শওকত হায়াত শ্যামা। তিনি তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র। ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে নেসারদের হাতে ধরা পড়ার আগেই ছোট ভাইকে অন্য দরজা দিয়ে বের করে দেন বুলু। শওকত হায়াত পাশের বাসায় আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যান। বলে রাখা ভালো, থানাপাড়া গণহত্যার হোতা সাদ আহমদ তরুণ বয়সে শহীদ ওবায়দুর রহমান বুলুর বাবা খান বাহাদুর শামসুজ্জহার হাত ধরে তাঁদের বাড়িতে থেকেই আইন ব্যবসার প্রাথমিক তালিম পেয়েছিলেন।
আগস্ট মাসের সেই গণহত্যায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া কেরোসিন বিক্রেতা দিন মহাম্মদ ওরফে দিনুর ভাষ্য থেকে জানা যায়, আটক ব্যক্তিদের জিকের ঘাটে (যেখানে এখন শেখ রাসেল সেতু নির্মিত হয়েছে) নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে গড়াই নদে ফেলে দেওয়া হয়। তাঁদের লাশের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। দিনুর বয়ান অনুযায়ী, কুষ্টিয়ার তৎকালীন জামায়াত নেতা মহিউদ্দিন ওই হত্যাকারীদের সঙ্গে ছিলেন।
দিনুসহ সাতজনকে যখন নদের ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ঘাটে বাঁধা জ্বালানি কাঠের (খড়ি) নৌকার লোকজন জেগে গেলে নৌকায় থাকা তিনজনকে হত্যা করা হয়। নৌকায় থাকা অন্য দুজন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গুলির হাত থেকে বাঁচলেও পরবর্তী সময়ে তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা জানা যায়নি। জনশূন্য জ্বালানি কাঠের সেই নৌকা অনেক দিন দাবিহীন পড়েছিল ঘাটে।
শহরের দ্বিতীয় গণহত্যায় প্রাণ যায় কর্মচারীসহ একই পরিবারের ১৬ জন নারী–পুরুষ ও শিশুর। কুষ্টিয়া শহরের রজব আলী খান চৌধুরী লেনের ‘কোহিনুর ভিলায়’ ১৮ সেপ্টেম্বরের গণহত্যায় অবাঙালিরা অংশ নেয়। ‘কোহিনুর ভিলা’র বাসিন্দা রবিউল হক মল্লিক ও আরশেদ আলী মল্লিক দুই ভাই তাঁদের পরিবার–পরিজন নিয়ে শহর ছেড়ে সদর উপজেলারই জিয়ারুখী ইউনিয়নের গোপালপুর কমলাপুর গ্রামে আশ্রয় নেন।
শহরের বেকারি ব্যবসায় এই দুই ভাই ছিলেন সেরা। কোহিনুর মিলকো ব্রেড অ্যান্ড বেকারির মালিক ছিলেন তাঁরা। শহরে ফিরিয়ে আনার জন্য পরিচিত অবাঙালিরা গ্রামে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করে। ‘আপনারা আমাদের প্রতিবেশী’ বলে আশ্বাস দেয়। বলে, ‘আমরা থাকতে আপনাদের কিছু হতে দেব না। আপনারা এসে আবার ব্যবসা শুরু করেন। কোনো সমস্য হলে আমরা দেখব।’
প্রতিবেশী অবাঙালিদের আশ্বাসে রবিউল হক মল্লিক ও আরশেদ আলী মল্লিক পরিবারসহ নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। কিন্তু সপ্তাহখানেক পরই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। কুষ্টিয়া শহরের ঘৃণিত রাজাকার মজিদ কসাই, ফোকু কসাই ও কোরবান বিহারির নেতৃত্বে ২৫–৩০ জন বিহারি মিলে জোট বেঁধে কোহিনুর ভিলায় প্রবেশ করে। তখন গভীর রাত। সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলে। সজোরে দরজার কড়া নাড়লেও প্রথমে কেউ দরজা খোলেনি। পরে হালিম বিহারি বারবার নিজের পরিচয় দিয়ে দরকার আছে বলে দরজা খুলতে বলে। একপর্যায়ে আরশেদ আলীর বড় ছেলে আশরাফ দরজা খুলে দেয়। ওই রাতে কোহিনুর ভিলায় বেকারির কর্মচারী আকুল ছিলেন। তিনি ওই দিনের গণহত্যায় একমাত্র বেঁচে যাওয়া সাক্ষী। আক্রমণের একটু আগে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন তিনি। বাড়ির ভেতরে চিৎকার–চেঁচামেচি শুনে রুটি তৈরির তন্দুর ঘরের মাচায় উঠে সারা রাত বসেছিলেন।
ভোরে উঠে তিনি বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন। বহুদিন তিনি আর শহরে আসতেন না ভয়ে। পরে কয়েকবার পরিচিত কারও কারও সঙ্গে হঠাৎ দেখা–সাক্ষাৎ হলেও আর খোঁজ পাওয়া যায়নি তাঁর।
এসব গণহত্যার অনেক সাক্ষী ও আলামত থাকার পরও কোনো তদন্ত কিংবা বিচার হয়নি। হত্যাকারীদের অনেকেই স্বাধীন দেশে মুক্তভাবে চলাফেরা করেছে। তথ্য তালিকাসহ এসব ঘটনা যথাযথভাবে নথিভুক্ত করা প্রয়োজন।