‘ঘাতক তুমি সরে দাঁড়াও, এবার আমি লাশ নেব না’

পোশাকশিল্পে অস্থিরতা’ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ:  ১২ নভেম্বর ২০২৩)

গাজীপুরের পোশাককর্মী আঞ্জুয়ারা গুলিতে মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যু কি পোশাককর্মীদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে? স্বল্প বেতনের কারণে দুই সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারেননি। মা–বাবা থাকতেও অনাথের জীবন যাপন করছে তারা। তাদের মতো অসংখ্য পোশাককর্মীর সন্তানদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের পথ কি আমরা করে দিতে পারছি?

আজকাল পুলিশের গুলির খবরে আমাদের কোনো হেলদোল হয় না। বিষয়টা যেন আমাদের গা–সওয়া হয়ে গেছে। অথচ পাকিস্তান আমলে ক্যাম্পাসে গুলি চলেছে, এই খবরে একদিন পুরান ঢাকার দোকানপাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানুষের মৃত্যুর খবরে তাঁরা ছুটে গিয়েছিলেন ফুলবাড়িয়া ছাড়িয়ে আজকের জগন্নাথ হল পর্যন্ত (তখনকার প্রাদেশিক পরিষদ)।

কারফিউ দিতে হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে। পূর্ব পাকিস্তানের সেই উজিরে আলার কবর হয় করাচিতে। দেশের মাটি তাঁর কপালে জোটেনি। দেশের মানুষের সঙ্গে গাদ্দারি করলে নাকি দেশের মাটিও প্রতিশোধ নেয়। ভাসানী তাঁর দেশজাগানো ভাষণে এ কথা বলতেন।

পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে, গ্রাম থেকে আসা আঞ্জুয়ারা খাতুনেরা গুলি খেলে কারও মনে কোনো রেখাপাত করে না। তাঁরা হয়ে যান অনেক সংখ্যার ভিড়ে নিতান্তই আরেকটি সংখ্যা। এখন এসব নিহত মানুষকে কেউ আর শহীদও বলে না।

গাজীপুরের কোনাবাড়ীর ইসলাম গার্মেন্টসে সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন মোসাম্মৎ আঞ্জুয়ারা খাতুন। তাঁর পরিচয়পত্র বলছে, মাত্র এক মাস আগে তিনি যোগ দিয়েছিলেন এই তৈরি পোশাক কারখানায়। এর আগে কাজ করতেন তেজগাঁওয়ের এক কারখানায়।

স্বামী–স্ত্রী দুজনই কাজ করতেন কাছাকাছি দুই কারখানায়। দুজনই কাজ করলেও দুই শিশুসন্তানকে নিজেদের কাছে রাখার তকদির তাঁদের হয়নি। কলিজার টুকরাদের রাখতে হতো দাদার বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের চরগিরিশ গ্রামে। মেয়ে ছোট, ছেলে বড়। ৮ বছর বয়সী ছেলে মো. আরিফ পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। সাত বছরের মেয়ে জয়া খাতুন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী।

ছোট্ট মেয়েকে বুঝ দিতে পারলেও ছেলেটা প্রায়ই বাবা–মায়ের কাছে থাকার জন্য জেদ ধরত। এবার দুর্গাপূজার ছুটিতে মা-বাবার কাছে বেড়াতে এসেছিল দুই ভাই-বোন। চরগিরিশ গ্রামের আরিফের অবরুদ্ধ ঢাকা সম্পর্কে ধারণা অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের ফটিকের মতো। সে বোন জয়াকে না–চেনা অনেক কিছুই চিনিয়ে দিত। সে অ্যাম্বুলেন্সের নাম দিয়েছিল ‘অ্যাঁও অ্যাঁও’ গাড়ি। সস্তা প্লাস্টিকের একটা ‘অ্যাঁও অ্যাঁও’ গাড়ি ছিল তার। গত ঈদে বাবা ঢাকা থেকে তার জন্য সেই গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। তখন সে কি জানত, ঢাকা থেকে ‘অ্যাঁও অ্যাঁও’ গাড়িতে চড়ে সে একদিন ফিরবে চরগিরিশ গ্রামে? বন্ধুদের সামনে তার স্কুলের পথ পেরিয়ে?

গত বুধবার ৮ নভেম্বর রাতে মা আঞ্জুয়ারার মরদেহের সঙ্গে ‘অ্যাঁও অ্যাঁও’ গাড়িতে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের চরগিরিশ গ্রামে ফিরতে হলো ছোট্ট আরিফ ও জয়াকে। অনেক লোকের ভিড় দেখে হঠাৎ চার বছর আগের আরেক ভিড়ের কথা মনে পড়ে তার। সেদিন তার নানা মো. মন্টু মিয়া মারা গিয়েছিলেন। তখন নানি তার মা আঞ্জুয়ারাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। ঠিক একইভাবে এখন জয়াকে বুকে জড়িয়ে তিনি কাঁদছেন। নানার মৃত্যুর পর নানি মাজেদা খাতুন তাঁর দুই নাবালক ছেলেকে নিয়ে সিরাজগঞ্জে থাকেন। তাঁদের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আঞ্জুয়ারা।

গত বুধবার আঞ্জুয়ারা মিছিলে নয়, কারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় ছেলে–মেয়ের কাছে ফিরছিলেন। হয়তো ভাবছিলেন, আরিফ আর জয়াকে চমকে দেবেন। ঘটনার আগে কারখানার সামনেই স্বামী জামালের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়।

পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ শুরু হওয়ায় মো. জামাল নিজের কর্মস্থল থেকে বেরিয়ে স্ত্রীর খোঁজ নিতে যান। সকাল আটটার দিকে মাইকে আঞ্জুয়ারাদের কারখানার ছুটির ঘোষণা আসে।

তখন স্ত্রী আঞ্জুয়ারাকে বাসায় যেতে বলেন মো. জামাল। স্বামীর পরামর্শে বাসায় যাওয়ার সময় হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়। একটি গুলি এসে তাঁর মাথায় লাগে। প্রথমে তাঁকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

আঞ্জুয়ারার মৃত্যুর কারণ নিয়ে ‘গবেষণা’
‘মরদেহ সরিয়ে ফেলা’, ‘গুম করে দেওয়া’, ‘গুলিতে নয়, হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে পদপৃষ্ট হয়ে মারা গেছে’—এমন প্রচার ১৯৫২ সালের মতোই প্রাচীন। মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকে সেটা স্পষ্ট হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হলে মরদেহ নিয়ে এসব কূটকাচালি বন্ধ হবে। নাহ, আমাদের সেই ধারণা ভুল। আঞ্জুয়ারার মৃত্যুর বিষয়ে পুলিশ পুরোনো সেই পথে হাঁটছে। বলছে, তিনি গুলিতে নয়, মানুষের পায়ের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছেন। গুলিতে মরলে নাকি তদন্ত হয়, কার গুলিতে মরেছে তাকে শনাক্ত করতে হয়। সংবিধান থাকা সভ্য দেশে নাকি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাব দিতে হয়।

এখন আর এসব হ্যাপার দরকার কী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া সংবাদমাধ্যমকে আগে জানিয়েছিলেন, গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দুজনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আঞ্জুয়ারা নামের এক নারীকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেছেন। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকে জানানো হয়েছে।

গুলিবিদ্ধ অন্যজন ছিলেন একই কারখানার সুপারভাইজার জালাল উদ্দিন। তাঁর বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বাসাটি গ্রামে। আঞ্জুয়ারার স্বামী মো. জামালের বর্ণনার সঙ্গে এটা মিলে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তা একটি ইংরেজি দৈনিককে বলেছিলেন, তৈরি পোশাককর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলে তারা নিরাপদ স্থানে সরে যায়। কিন্তু হঠাৎ এক নারী শ্রমিক মাথায় গুরুতর আঘাত পান। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি মারা গেছেন।

আর কত শিশু দেখবে মায়ের লাশ
গুলিতে আঞ্জুয়ারার নিহত হওয়ার খবর আর তাঁর দুই শিশুসন্তানের কথা কানে আসতেই মনে পড়ছিল ফিলিস্তিনি শিশুদের কথা, মৃত মায়ের পাশে দুধের আসায় কান্না ভুলে যাওয়া শিশুদের কথা।

মনে পড়ছিল শিশু হাদিসের কথা। ২০১৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁওয়ের চৌফলদণ্ডী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণপাড়ার শিশু হাদিস পুলিশের গাড়িতে উঠে পড়েছিল মায়ের মরদেহ দেখার জন্য। সে সময় পুড়িয়ে মারা এক গৃহবধূর মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হচ্ছিল।

হাদিসের সেই ছবিটি সংবাদমাধ্যমে ছাপানো হয়েছিল। সাড়া ফেলেছিল সারা দেশে। প্রত্যাশা করি, পুলিশের গাড়ি বা ‘অ্যাঁও অ্যাঁও’ গাড়ি অথবা খাটিয়া কিংবা চিতায় মায়ের লাশ দেখার অভিজ্ঞতা যেন আর কোনো শিশুর না হয়। যাঁরা গুলি করেন অথবা আগুন দেন, আপনার নিজের ঘরের শিশুটির কথা কি একবার ভাববেন?

‘পোশাকশিল্পীদের’ শিশুরা বড়ই হতভাগ্য
তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত মায়েরা তাদের শিশুদের কাছে রাখতে পারেন না। আরিফ–জয়ার মতো তাঁদের শিশুরা থাকে আত্মীয়স্বজনের ‘হেফাজতে’। দাদি–নানির কাছে অথবা চাচি–মামির আশ্রয়ে। সাভারে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার আগে বিষয়টি গবেষকেরাও খেয়াল করেননি।

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে অসংখ্য শিশু সেখানে ছুটে গিয়েছিল। নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংস্থার তালিকা থেকে এমন তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। রানা প্লাজা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার পর নানা সংগঠন হতাহত মায়েদের সন্তানদের জন্য আশ্রয়শিবির খুলে একরকম বিপদে পড়ে যায়। তারা আবিষ্কার করে এক করুণ সত্য। মা–বাবা থাকতেও অনাথের জীবনযাপন করছে এই দেশের প্রায় দুই কোটি শিশু। এসব মা–বাবা পোশাকশিল্পসহ নানা খাতে যুক্ত। এসব শিশু শৈশবে বেড়ে উঠছে এক বৈরী পরিবেশে। হাত-পা বেঁধে বৈরী আশ্রয়ে রেখে আসা ছাড়া কি এসব শিশুর জন্য আমাদের কিছুই করার নেই?

অনেক মায়ের কাছে অচেনা শিশু
গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, পোশাকশিল্পে ৩৫ বছর বয়স হলেই বেকার হওয়ার শঙ্কা থাকে পোশাকশিল্পের নারী কর্মীদের। এই নারী যখন ফিরে যান গ্রামে, তখন নিজের সন্তানদের সঙ্গে তাঁর পুনর্মিলন সব সময় প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না।

ওই প্রতিবেদনে ফায়েজা বেগম (৪৮) নামের এক পোশাককর্মীর গল্প আছে। তিনি প্রথম আলোকে বলছিলেন, বিয়ের পর একমাত্র শিশুসন্তানকে পরিবারের সদস্যদের কাছে রেখে কারখানায় কাজে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কাজে কাজেই জীবন গেল। কোনো দিন লেট (দেরি) করলাম না, অসুস্থ হলেও কাজে আসতাম। তা-ও চাকরি গেল।’

ফায়েজার চাকরি নেই, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে। এখন ছেলের সঙ্গে থাকেন। হিসাব কষলে দেখা যাবে, আসলে পোশাকশিল্পে নারীর চাকরির গড় সময়সীমা ছয় বছর।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আওয়াজ ফাউন্ডেশন ও কনসাল্টিং সার্ভিস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ‘কর্মীর কণ্ঠ ২০১৯ (দ্য ওয়ার্কার্স ভয়েস)’ উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, কারখানার বেঁধে দেওয়া লক্ষ্য পূরণে পুরুষের চেয়ে নারীকে বেশি লড়াই করতে হয়। অতিরিক্ত কাজের চাপে তাঁদের স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে ৬৯ শতাংশ কর্মী জানিয়েছেন। অর্থাৎ ভাঙা মন আর ভাঙা স্বাস্থ্য নিয়ে ছেলে–মেয়েদের কাছে ফিরে যাওয়াটা আরেক বিড়ম্বনা।

ন্যায্য মজুরি আর কারখানার সুস্থ পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের সন্তান অর্থাৎ আগামীর জনশক্তির বিকাশের পথটা খুলে রাখত হবে।

সবার অলক্ষ্যে মায়ের মরদেহ দাফনের পর আরিফ একটা ‘অদ্ভুত’ কাজ করেছে। তার হাতে থাকা ‘অ্যাঁও অ্যাঁও’ গাড়িটা সে পুকুরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার, তার চোখে কোনো জল ছিল না।

কেন তার এমন আচরণ, তার জবাব কোনো মনোবিজ্ঞানী দিতে পারবেন। তবে এসব শিশুর যে মনঃসামাজিক সহায়তা প্রয়োজন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা কাজটি করতে পারেন। কিন্তু বিষয়টি তাঁদের জানতে হবে। এখানে কিছু বিনিয়োগ দরকার।

এসব শিশুর পাশে সহমর্মিতার সঙ্গে দাঁড়াতে না পারলে তারা শখের ‘অ্যাঁও অ্যাঁও’ গাড়িটির মতো সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিতে চাইলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কবি শামসুর রাহমানের মতো যদি বলতে পারতাম—

‘আর পারি না, দাও ছড়িয়ে পদ্মকেশর

বাংলাদেশে।

ঘাতক তুমি সরে দাঁড়াও, এবার আমি

লাশ নেব না।

নই তো আমি মুর্দাফরাশ। জীবন থেকে

সোনার মেডেল,

শিউলিফোটা সকাল নেব।

ঘাতক তুমি বাদ সেধো না, এবার

আমি গোলাপ নেব।’

Leave a Reply