পরীক্ষার্থীদের আত্মহত্যা কেন থামেনি

এসএসসি পরীক্ষা ২০২৫ সালের ফলাফল প্রকাশের ২৪ ঘন্টায় ১৬ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যায় মৃত্যু এবং আরো ৯ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার চেষ্টায় হাসপাতাল ভর্তি। এই নিয়ে বিশ্লেষনধর্মী লেখা লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা, প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ২০ জুলাই

১০ জুলাই মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সংবাদমাধ্যমগুলো পরের তিন দিনে (১২ জুলাই পর্যন্ত) মোট ১৬ জনের আত্মহত্যার খবর নিশ্চিত করেছে। ফল প্রকাশের প্রথম চার ঘণ্টার মধ্যে আত্মহত্যা করে ৯ জন। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এখনো ৯ থেকে ১০ জন চিকিৎসাধীন। তারাও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।

বলে রাখা ভালো, আত্মহত্যার বা আত্মহত্যাচেষ্টার সব খবর ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছায় না। মনে রাখতে হবে, তাদের সবাই কিন্তু অকৃতকার্য নয়। যেমন আশা করেছিল, তেমন ফল হয়নি বলে তাদের অনেকেই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। এর আগে কখনোই একযোগে এতজন কিশোরী–কিশোরের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি।

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায় জিপিএ-৫ না পাওয়া যে কিশোরী ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে, সে তার ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিল। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল সে। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, বিদ্যালয় থেকে ১৩ জন জিপিএ-৫ পেলেও ফার্স্ট গার্ল সেই তালিকায় নেই। সে ৪ দশমিক ৮৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। ফল প্রকাশের দিন কিশোরী ছিল ঢাকায়, বোনের বাসায়। কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে তার মন খারাপ ছিল। পরদিন শুক্রবার বাবা তাকে বাড়ি নিয়ে যান। এক দিন পর, ১২ জুলাই বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সে আত্মহত্যা করে।

মনে পড়ে বরিশালের কিশোর সর্বজিৎ ঘোষের করুণ কাহিনি। ২০২২ সালের কথা। পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে সবাই খুব আশাবাদী ছিল; শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধুরা আর সর্বজিৎ নিজেও। সবাই বেশ উত্তেজিত ছিল ফল প্রকাশের দিন সকাল থেকেই। কিন্তু ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, একটি বিষয়ে সর্বজিৎ কৃতকার্য হতে পারেনি। তাকে অকৃতকার্য দেখানো হয়েছিল। আশ্চর্য, হতাশ, ক্ষুব্ধ সর্বজিৎ সবার অগোচরে আত্মহত্যা করে বসে। কিন্তু পুনর্নিরীক্ষণের পর সংশোধিত ফলাফলে দেখা গেল, সর্বজিৎ ঘোষ কোনো বিষয়ে অকৃতকার্য হয়নি। সে ৪ দশমিক ৬৭ জিপিএ নিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

সব সময় যে শিক্ষার্থীই অকৃতকার্য হয়, তা কিন্তু নয়; সর্বজিৎ ঘোষের মতো ঘটনা অন্যের ক্ষেত্রেও ঘটে। যন্ত্রের ত্রুটি, পরীক্ষকের অসাবধানতার মতো অনেক দুর্ভাগ্যজনক ভুল—যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে পরীক্ষা করা কোনো তুচ্ছ বিষয় নয়। তারা সত্যিই অকৃতকার্য হয়েছে কি না, তা জানার কোনো সহজ উপায় নেই। তাদের শিক্ষাজীবনের মাঝখানে একটি ছেদ চিহ্ন, মানে পুরো জীবনের সমাপ্তি।

সর্বজিৎ আর কখনো ফিরে আসবে না। ফল প্রকাশের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কি আরও একটু সতর্ক হবেন? শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন হলো, তাঁরা কি পুনর্নিরীক্ষণ প্রক্রিয়াটি দ্রুত, সহজ ও সহজলভ্য রাখবেন?

অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহারিকের নম্বর বোর্ডে পাঠাতে ভুলে গিয়েছিল

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, গাজীপুরের শ্রীপুর, যশোরের পুলেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষার পর নেওয়া ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর বোর্ডে পাঠানো হয়নি। পরীক্ষার পরপরই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বোর্ডে এগুলো পাঠিয়ে দেওয়ার কথা। ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীরা দেখে তারা বাংলা, ইংরেজি, অঙ্কে কাঙ্ক্ষিত নম্বর পেয়ে কৃতকার্য হলেও অন্য সব বিষয়ে অকৃতকার্য। জীবননগরের হাসাদহ বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক ছাত্র ১০ জুলাই জানায়, ‘সব বিষয়ে ভালো নম্বর পেয়েছি, তবু সবকিছু শেষ। কার কী দোষ, আমি জানি না। ভালো পরীক্ষা দিয়েও কেন ব্যবহারিকে ফেল এসেছে, জানি না। বিষয়টি তদন্ত করে সমাধান করা হোক।’ সমাধান চেয়ে হতাশ, ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে। একই কারণে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার মজিদিয়া আলিয়া মাদ্রাসার ভোকেশনাল শাখার সব পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। যশোরের পুলেরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রে ৩২৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের ৪৮ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়।

হতাশ ও বিস্মিত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকের জেরার মুখে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বোর্ডে ব্যবহারিকের নম্বর না পাঠানোর বিষয়টি স্বীকার করে। শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের কাছে ধরনা দিলে ইউএনও বা শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রথমে মনে করা হয়েছিল, গা ঢাকা দেওয়া বা নিরুদ্দেশ স্কুল কমিটি কিংবা দখল নেওয়া নব্য কমিটির নয়া বন্দোবস্তের চক্করে পড়ে এসব অঘটন ঘটেছে। কিন্তু পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে দেখা গেল, ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর সময়মতো সঠিক জায়গায় না পাঠানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর খাসলতে পরিণত হয়েছে। আগের বছরগুলোতেও এমন হয়েছে নানা জায়গায়। পরে চাঁদা তুলে খরচ মিটিয়ে শিক্ষা বোর্ডে দৌড়ঝাঁপ করে সংশোধিত ফলাফল আনা হলেও তদন্ত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা দায়ী শিক্ষকদের চিহ্নিত করে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়নি।

এই গাফিলতি ‘কালচার’ এখন কেবল স্কুলের গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২ সালের মাস্টার্স শেষ পর্বের পরীক্ষা শুরু হয় চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি। দুটি গ্রুপে ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয় ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ এপ্রিল। এরপর গত ৪ জুন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা যায়, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের পরীক্ষার্থীরা সবাই অকৃতকার্য হয়েছেন। শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানতে পারেন, তাঁদের ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষার ফল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে না পাঠানোর কারণে সবাই অকৃতকার্য হয়েছেন।

এ ধরনের অবহেলা শিক্ষার্থীদের যে মানসিক চাপের মধ্যে ফেলে হঠকারী পথে হাঁটতে উদ্বুদ্ধ করে, সে খবর আমরা রাখি না। আমাদের অবহেলা যে একজনের মৃত্যুর কারণ হতে পারে, সেটা আমরা ভাবি না। অভিযোগ আছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের জন্যই নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে যান তাঁরা।

শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা জরুরি

গত বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সন্ধ্যার মধ্যে ৯ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া গিয়েছিল। এবার সেই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। মৃত্যুর খবর এখনো আসছে। আবার আত্মহত্যাকারীদের বেশির ভাগই কিশোরী (মৃত্যুতালিকায় একজন ছাড়া সবাই কিশোরী, বেঁচে গিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যেও কিশোরীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ)। কেন কিশোরীরা? অনুমান বা ধারণার ওপর ভিত্তি করে এর জবাব দিতে চাননি মনোবিজ্ঞানীরা। সমস্যা বুঝতে হলে এ ক্ষেত্রে ধারাবাহিক গবেষণা প্রয়োজন। প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের পাশে থাকা।

গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে। এবারের পরিস্থিতি অনুধাবন করে মাসখানেক আগে থেকেই টেলিভিশন চ্যানেল আর সংবাদমাধ্যমগুলোকে আমরা নানাভাবে আত্মহত্যারোধী অনুষ্ঠান করার জন্য উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলাম। প্রথম আলোসহ কয়েকটি পত্রিকা সাড়া দিলেও সার্বিকভাবে তেমন একটা সাড়া পাওয়া যায়নি। চ্যানেল ২৪ আর মাছরাঙা টেলিভিশন ছাড়া কেউ অনুরোধের উত্তরও দেয়নি। ইংরেজি সংবাদপত্রের সাড়া একেবারেই ছিল না। কৃতকার্য–অকৃতকার্যনির্বিশেষে সবার পাশেই আমাদের উৎসাহ আর সহানুভূতি নিয়ে দাঁড়ানো উচিত।

এবার ছয় লাখের বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। মনের মতো ফল না পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এর সঙ্গে যোগ করলে সার্বিকভাবে মন খারাপ শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাত থেকে আট লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তাদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। শিক্ষকদের অবহেলা মাপার ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁদের জবাবদিহির আওতায় নিতে হবে।

দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

কয়েক মাসের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশিত হবে। সেখানেও অনেকের মন খারাপ করা রেজাল্ট হবে। এখন থেকে এ বিষয়ে নানা মাধ্যমে কথা বললে আমরা অনেক কিশোর-কিশোরীকে অকালে ঝরে পড়া থেকে রক্ষা করতে পারব।

শিক্ষক–অভিভাবকসহ সমাজের সবার কাছে আমরা এসব কথা পৌঁছে দিতে পারি—

• সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের প্রতি সমাজের সব স্তর থেকে সদয় ভাব দেখাতে হবে।

• ব্যবহারিক পরীক্ষার ফলাফল বোর্ডে পাঠাতে যেন কোনো প্রতিষ্ঠান ভুলে না যায়। এমন কাজকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা।

• ফল প্রকাশের পর প্রথম কয়েকটা দিন আত্মহত্যার ঝোঁক খুব বেশি থাকে, তাই পরীক্ষায় সন্তান অকৃতকার্য হলেই মা-বাবা, পরিজন—সবাই যেন তার সঙ্গে সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেন। একা থাকতে দেওয়া ঠিক নয়। তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে।

• অকৃতকার্য শিক্ষার্থীকে ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে হবে।

• দ্রুত পরীক্ষার খাতা পুনর্নিরীক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কেননা অনেক সময় হিসাব-নিকাশে সামান্য ত্রুটির কারণে ফল খারাপ আসে।

• শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক মিলে পরীক্ষায় কেন আশানুরূপ ফল করতে পারল না, তার হিসাব-নিকাশ করতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক (wahragawher@gmail.com)

Leave a Reply