পরীক্ষায় কম ফল মানেই জীবনের শেষ নয় – আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার প্রচেষ্টা প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান

একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর আত্মহত্যা করলো, তার দায় কার? শুধু সেই শিক্ষার্থীর? না কি আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে এর সঙ্গে জড়িত? শিক্ষাব্যবস্থা, পরিবার, সমাজ, কেউই কি দায়িত্ব এড়াতে পারে?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর আত্মহত্যার কারণে প্রাণ হারায় প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। এর মধ্যে একটি বড় অংশই হচ্ছে তরুণ-তরুণী এবং শিক্ষার্থীরা। আত্মহত্যার পেছনে নানা কারণ রয়েছে, মানসিক অবসাদ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বুলিং, বৈষম্য এবং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি কারণ হলো পাবলিক পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পাওয়া।

দুই বিপরীত চিত্র: উল্লাস বনাম হতাশা

এসএসসি, এইচএসসি, দাখিল, আলিম কিংবা সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের সময় আমরা দেখতে পাই একপক্ষ আনন্দে মেতে ওঠে। পত্রিকার প্রথম পাতায় উঠে আসে জিপিএ–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের হাসিমুখ। অথচ আরেকপাশে থাকে এক গ্লানিময়, এক অদৃশ্য বাস্তবতা, যেখানে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা চরম হতাশা ও লজ্জায় নিজেদের শেষ করে দেওয়ার পথ বেছে নেয়। পরীক্ষায় ভালো না করা মানেই যে একজন শিক্ষার্থী ব্যর্থ, তা নয়। কিন্তু সমাজ, পরিবার এমনকি শিক্ষাব্যবস্থার দৃষ্টিতে পরীক্ষার ফলই হয়ে ওঠে যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি। ফলে অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের মন ভেঙে যায় এবং কেউ কেউ আত্মহননের মতো চরম সিদ্ধান্ত বেছে নেয়।

আমরা সবসময় সাফল্যের গল্প সামনে নিয়ে আসি, কিন্তু যেসব শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ে, তারা কেন অকৃতকার্য হলো, সেই প্রশ্নটা খুব কমই করি। এর পেছনে কি মানসিক চাপ, পারিবারিক সহানুভূতির অভাব, না কি আরও গভীর কোনো সামাজিক কাঠামোগত সমস্যা আছে, সে বিষয়ে আমাদের গবেষণা বা কার্যকর উদ্যোগ খুবই সীমিত।

বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের জীবনে অভিভাবকের প্রত্যাশা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সন্তান যেন ভালো রেজাল্ট করে, এটা প্রত্যেক মা–বাবার স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন যদি পরিণত হয় অন্ধ প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়ার চাপে, তাহলে শিক্ষার্থীর মনে জন্ম নেয় ভয়, ব্যর্থতার আতঙ্ক ও আত্মঘৃণা। “আমি যদি ফেল করি, মা বাবাকে কী মুখ দেখাব?” এই প্রশ্ন অনেক সময় তাদের মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়। শুধু সন্তানের ভালো ফলই নয়, পরিবারের উচিত তার মানসিক সুস্থতা এবং জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির বিষয়েও সমান মনোযোগ দেওয়া।

অনেকে ধীরে সুস্থে চিন্তাভাবনা করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তাঁদের ক্ষেত্রে ইঙ্গিত পাওয়া সহজ, কিন্তু হঠাৎ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আগাম আলামত আঁচ বা অনুমান করা সহজ নাও হতে পারে। তবে কাছের মানুষ, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের পক্ষে টের পাওয়া সহজ বলে মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন। সাধারণত যেসব আলামত দেখা যায় বলে গবেষকেরা মনে করেন, সেগুলো হলো—

এসব আলামতের একটিও দেখা না গেলে মন খারাপের চাপে যেকোনো শিশু–কিশোর আত্মহত্যার ঝুঁকি নিতে পারে। তাই ঘনিষ্ঠদের উচিত হবে এ ধরনের মানুষের সঙ্গে আন্তরিক আচরণ করা। একা থাকতে না দেওয়া।

এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। দ্রুত এই অর্থহীন ফলাফলের দৌরাত্ম্য বন্ধ হওয়া আবশ্যক! যা করার আমাদেরই করতে হবে। শিশুদের বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের। দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি আর তাৎক্ষণিক যেসব পদক্ষেপ নেয়া যায়:

১। পরীক্ষাপদ্ধতি এবং রেজাল্ট-পদ্ধতির আশু পরিবর্তন।

২। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগে থেকেই অভিভাবক ও মা-বাবাকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য প্রচারণা। পরিবারে পরীক্ষার্থী থাকলে তাকে সব সময় চাপমুক্ত রাখতে হবে। ফলাফল প্রকাশের পর বিপন্ন শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা এবং তাদের প্রতি যত্নবান ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।
৩। ফেসবুক ও নানা সামাজিক মাধ্যমে উদযাপনের মাত্রা উসকানিমূলক পর্যায়ে চলে যায়। এই ধরনের   উদযাপন বন্ধ করা।

৪। যেহেতু আত্মহত্যার তালিকায় মেয়েদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেশি, তাই মেয়েদের বিষয়টি আলাদাভাবে ভাবতে হবে।

৫। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাসহ একজন প্রশিক্ষিত মনোসামাজিক সহায়ক থাকবেন।

৬। অভিভাবক-শিক্ষক সংঘ, ছাত্র-শিক্ষক ক্লাব ইত্যাদির সভায় বিষয়টিকে আলোচনার তালিকায় রাখা। এবং আত্মহত্যানিরোধক পদক্ষেপ গ্রহণ।

৭। এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরির জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী দল বা কার্যকর কোনো সংগঠিত স্বেচ্ছাসেবী দল থাকলে তাদের সহযোগিতা নেওয়া।

৮। সব ধরনের প্রচারমাধ্যমে বিষয়টিকে সারা বছর আলোচনায় রাখা।
তবে সব ছাপিয়ে যে বিষয়গুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত তা হলো: ক. সমাজের সব স্তরে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন খ. শিক্ষার্থী-অভিভাবক-শিক্ষক সবারই মনোসামাজিক পরিচর্যা গ. আত্মহত্যার চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়াদের সুরক্ষা।

আমাদের শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে, জীবন একটা দীর্ঘ যাত্রা, আর পরীক্ষার ফলাফল তার ক্ষণিকের এক মুহূর্ত মাত্র। সফলতা মানে শুধুই জিপিএ-৫ নয়। একজন কৃষক, শিক্ষক, অথবা শ্রমিকও সফল, যদি সে তার কাজকে ভালোবাসে, সততার সঙ্গে জীবনযাপন করে।

সফলতা মানে বড় চাকরি বা নামজাদা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা নয়, সফলতা হলো নিজেকে, নিজের কাজকে সম্মান করা, অন্যকে সম্মান করা এবং জীবনের প্রতি ভালোবাসা বজায় রাখা। যদি একজন শিক্ষার্থী বুঝতে পারে যে সে অন্যের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে আছে, বা তার জীবনে অর্থপূর্ণ কিছু করার সুযোগ এখনো আছে, তাহলে আত্মহত্যার পথ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভালোবাসা। একজন শিক্ষার্থী যদি পরিবার, শিক্ষক, এবং সমাজের ভালোবাসা ও সমর্থন অনুভব করে, তাহলে হতাশা যত গভীরই হোক না কেন, সে ফিরে আসবে।

পরীক্ষায় ফল খারাপ হওয়া মানেই জীবন ব্যর্থ নয়। বরং সেটাই নতুনভাবে শুরু করার একটি সুযোগ। আমাদের উচিত শিক্ষার্থীদের শেখানো যে তারা যেমন আছে, ঠিক তেমন করেই তারা মূল্যবান। প্রতিটি শিশু আলাদা, প্রতিটি শিক্ষার্থীর সক্ষমতা ভিন্ন। আসুন, আমরা সবাই মিলে এমন একটি সমাজ গড়ে তুলি, যেখানে ফলাফল নয়, জীবনের প্রতি ভালোবাসা থাকবে সবার আগে। শিক্ষার্থীদের পাশে থাকুন। কারণ একটি জীবন, একটি ভবিষ্যৎ, তার চেয়েও মূল্যবান আর কিছু নয়।

Image: shutterstock

Leave a Reply