পরীক্ষার্থীদের আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করি

এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবনতা থেকে রক্ষা ও এই বিষয়ে অভিভাবকসহ সকলের সচেতনতা নিয়ে লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা (প্রকাশ:  ১০ জুলাই ২০২৫, আমাদের সময় পত্রিকায়)

আজ মাধ্যমিক (এসএসসি) পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হচ্ছে। আমার কেবলই মনে পড়ছে বরিশালের কিশোর সর্বজিৎ ঘোষের কথা; সেটা ২০২২ সালের কথা। পরীক্ষার ফল নিয়ে সবাই খুব আশাবাদী ছিল; শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধুরা আর সর্বজিৎ নিজেও। সবাই বেশ উত্তেজিত ছিল সকাল থেকেই। কিন্তু ফল প্রকাশের পর দেখা গেল একটি বিষয়ে সর্বজিৎ পাস করতে পারেনি। তাকে ফেল দেখানো হয়েছিল। তাই হতাশ-ক্ষুব্ধ সর্বজিৎ সবার অগোচরে আত্মহত্যা করে বসে। কিন্তু পুনঃনিরীক্ষণের পর সংশোধিত ফলাফলে দেখা গেল সর্বজিৎ ঘোষ কোনো বিষয়ে ফেল করেনি। সে ৪.৬৭ জিপিএ নিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সর্বজিৎ আর কখনও ফিরে আসবে না।

পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগাম খবর ময়রাদের খুব উপকারে আসে। তারা মিষ্টির উপাদান সংগ্রহ-মজুদ করার সুযোগ পান। রাত জেগে মিষ্টি বানান। ফল প্রকাশের দিন দুপুর বারোটার মধ্যে মিষ্টির দোকানগুলো মিষ্টিহীন হয়ে যায়। ‘কর্তৃপক্ষ’-এর বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো এখন তারিখের ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত। তবে অপেক্ষা প্রধান উপদেষ্টার সম্মতির ওপর। তিনি যেদিন সময় দেবেন সেদিনই ফল প্রকাশিত হবে। আগে গণভবন ঠিক করত দিনক্ষণ, এখন করবে যমুনা। এটাই নতুন বন্দোবস্ত। নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থীদের জীবনে এসএসসি একটা গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। রাষ্ট্র এটাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীকে যুক্ত করে শানশওকতের সঙ্গে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতেই পারে। ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, নেপাল না করলে কী হবে, আমাদের খুশি আমরা করতেই পারি।

পরীক্ষার ফল ঘোষণার দিনটির গুরুত্ব রাষ্ট্র বুঝলেও যাদের বেশি বোঝার কথা সেই অভিভাবকদের অনেকেই বুঝতে চান না। যেসব পরীক্ষার্থী তাদের মনের মতো ফল পায় না তাদের জন্য এটি একটি কঠিন দিন হয়ে ওঠে। এই সময়ে বাবা-মা এবং অভিভাবকদের তাদের পাশে থাকা উচিত। গত বছর অন্তত দুজন পরীক্ষার্থী মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে দেখে বাড়ির সবাই দূরে এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছে। একা বাড়িতে মনের কষ্টে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

পরিবারের পক্ষ থেকে মিষ্টি বিতরণের পাশাপাশি অনেকে তাদের সন্তানের ‘কৃতিত্ব এবং আনন্দের’ এই খবরটি সোশ্যাল মিডিয়ায় অতি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে একটার পর একটা পোস্ট করতে থাকে। তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার দেয়ালগুলো অতি অভিনন্দন এবং দীর্ঘ শুভেচ্ছা বাণীতে উপচে পড়ে। একবারও ভেবে দেখেন না এসব বিজ্ঞাপনমূলক আচরণ সর্বজিৎ ঘোষের মতো পরীক্ষার্থীদের মনের ওপর কী নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

অনেক সময় অভিভাবকরা তাদের পরীক্ষার্থীদের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে বেফজুল বাহাসে মেতে ওঠে। গত বছর কেউ লিখেছিল যে, তাদের প্রার্থী ‘গোল্ডেন জিপিএ’ পেয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় আরেকজন মন্তব্য বিভাগে লিখেছিল, ‘ওই নামে (গোল্ডেন জিপিএ) কিছুই নেই।’ কেউ চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল, যদি কারও সন্তান ‘গোল্ডেন জিপিএ’ না পায়, তা হলে তারা ঈর্ষা করে গোল্ডেন জিপিএ’র অস্তিত্বকে উপেক্ষা করে। বিতর্ক চলতে থাকে। বিতর্ক এবং মিষ্টি বিতরণের মাঝে পরীক্ষায় ‘ভালো’ করতে না পারা শিক্ষার্থীদের জীবন একে একে ঝরতে থাকে। কেউ ফল ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কেউ একদিন অপেক্ষা করে, কেউ দুই দিন। কেউ ১৫, কেউ ১৬, কেউ ১৭ বছর বয়সী। গত বছর ২০২৪ সালে ফল প্রকাশের প্রথম ছয় ঘণ্টার মধ্যে শতাধিক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা করে, মারা যায় নয়জন। এদের মধ্যে ছয়জন মেয়ে। তার আগের বছর প্রথম ছয় ঘণ্টায় মারা যায় চারজন মেয়েসহ মোট ছয়জন।

বলা বাহুল্য, গণমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যার খবরই সব খবর নয়। যারা আত্মহত্যা করে ব্যর্থ হওয়ার চেষ্টা করে, তাদের গল্প সাধারণত গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। সব পক্ষই মানুষকে ঘটনাটি জানা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। ঘটনাটি গোপন করার জন্য, তাদের মানসিক সংকটকে অস্বীকার করা হয়। তাদের চিকিৎসার বিষয়টিও উঠে আসে না।

সুইসাইড অ্যাওয়ারনেস ভয়েসেস অব এডুকেশন (SAVE) তাদের সংগৃহীত প্রমাণের ভিত্তিতে জানাচ্ছে, আত্মহত্যার চেষ্টাকারী প্রতি ২৫ জনের মধ্যে মাত্র একজন সফল হয়। যখন এটি রিপোর্ট করা হয় তখন আমরা কেবল এটুকুই জানি। আমরা ২৪ জন বেঁচে যাওয়া ব্যক্তির সম্পর্কে জানি না। যদি তাদের চিকিৎসা না করা হয় বা মানসিক-সামাজিক সহায়তা না দেওয়া হয়, তা হলে তারা আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, দ্বিতীয়বার আত্মহত্যার চেষ্টাকারী ব্যক্তিদের মধ্যে সাফল্যের হার অনেক বেশি।

ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরাম গত বছরের নয়টি ঘটনার তদন্ত করে দেখেছে যে, আত্মহত্যা করা কোনো শিক্ষার্থীই তথাকথিত ‘খারাপ ছাত্র’ ছিল না।

অনেক শিক্ষার্থী কেবল একটি বিষয়ে ‘খারাপ’ করে এবং বাকি বিষয়ে ‘এ প্লাস’, ‘এ’ অথবা ‘এ মাইনাস’ পায়। তাদের মধ্যে একজন জিপিএ-৫ না পেয়ে পেয়েছিল ৪.৮৯। স্কুলের শিক্ষকরা সবাই আশা করেছিল সে জিপিএ-৫ পেয়ে স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে। সে তা করতে পারেনি। অনেক শিক্ষার্থী এই ধরনের অবাঞ্ছিত চাপ সহ্য করতে পারে না।

সব সময় যে শিক্ষার্থী ফেল করে তা কিন্তু নয়। সর্বজিৎ ঘোষের মতো ঘটনা অন্যের ক্ষেত্রেও ঘটে। যন্ত্রের ত্রুটি, পরীক্ষকের অসাবধানতার মতো অনেক দুর্ভাগ্যজনক ভুলÑ যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে পরীক্ষা করা কোনো তুচ্ছ বিষয় নয়। তারা সত্যিই ফেল করেছে কিনা তা জানার কোনো সহজ উপায় নেই।

তাদের শিক্ষাজীবনের মাঝখানে একটি ছেদচিহ্ন মানে পুরো জীবনের সমাপ্তি। হতাশ পরীক্ষার্থী এমন কাউকে দেখতে পায় না যে, তাদের ছন্দে ফিরিয়ে আনতে পারে। সর্বজিৎ আর কখনও ফিরে আসবে না। ফল প্রকাশের সঙ্গে জড়িতরা কি আরও একটু সতর্ক হবেন? শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন হলো, তারা কি চেকিং বা পুনঃনিরীক্ষণ প্রক্রিয়াটি দ্রুত, সহজ এবং সহজলভ্য রাখবেন?

যখন কোনো ছাত্র প্রত্যাশিত নম্বর পেতে ব্যর্থ হয়, তখন বেশির ভাগ সময় অভিভাবকরা এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ান না। অভিভাবকরা যদি একটু চেষ্টা করেন এবং তাদের সন্তানদের পাশে দাঁড়ান, তা হলে অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছর নয়জনের মধ্যে অন্তত দুজন শিক্ষার্থী চরম হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল যখন তারা দেখতে পেয়েছিল যে, তাদের বাবা-মা অন্য আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। অভিভাবকদের বোঝা উচিত যে, এসএসসি হলো একজন শিক্ষার্থীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলোর মধ্যে একটি। এসএসসির ফল ঘোষণার দিনটি একজন কিশোরের জীবনের একটি বিশেষ দিন। তাই এই দিনে বাবা-মায়ের পাশে থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে না থাকা অবহেলার শামিল। এই ধরনের অবহেলা সহ্য করা সহজ নয়।

এই বছরের এসএসসির ফল প্রকাশিত হবে আজ। মিষ্টি বিক্রি এবং বিতরণ করা হবে কিন্তু আমাদের প্রিয় হৃদয়, আমাদের সন্তানদেরও রক্ষা করা উচিত। সব শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাবে না, অনেকে আবার কিছুই পাবে না। এই বছর ‘খারাপ ফলাফল’ ঢাকতে এবং ‘মেকআপ’ ফলাফল দেখানোর জন্য ‘গ্রেস মার্কস’ যোগ করার কোনো নির্দেশনা জারি করা হয়নি। যেসব পরীক্ষার্থী প্রত্যাশিত নম্বর পাবে না তাদের ভাবা উচিত নয় যে, তারা আর প্রাসঙ্গিক নয়।

আমরা কীভাবে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা দিতে পারি

১. ফল ঘোষণার ২-৩ দিন আগে থেকে ফল ঘোষণার পর পর্যন্ত বাবা-মা বা অভিভাবকদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকা উচিত, তাদের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত এবং তাদের মানসিক সাহস ও আশ্বাস দেওয়া উচিত।

২. ফলাফল প্রত্যাশা অনুযায়ী না হলে কোনো অবস্থায়ই শিশুকে তিরস্কার করা, অপমান করা বা অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়।

৩. ভবিষ্যতের জন্য শিশুর পাশে থাকার বার্তা দিন, সাহস জোগান এবং আশাবাদী মনোভাব গড়ে তুলুন।

৪. আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীদের আচরণ ব্যঙ্গাত্মক বা অপমানজনক হওয়া উচিত নয় বলে অভিভাবকদের সচেতন করুন।

৫. ফল ভালো হলে অতিরিক্ত আনন্দ প্রকাশ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবেন না যা অন্যদের ক্ষতি করতে পারে

এই বছর সাফল্যের হারে ঘাটতি থাকবে। অনেক অভিভাবক হতাশ হবেন। কেউ একজন বলেছেন, সব ঘাটতিই সংকট নয়। কিন্তু এটা কি ভুল যে, এটিও খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দেয়? শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাক এবং শিক্ষার্থীদের হতাশার হার কমুক।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও শিক্ষক
wahragawher@gmail.com 

Leave a Reply