বর্তমান পরিস্থিতি

চলতি বছরের ১৯ থেকে দেশের ভেতরে টানা বৃষ্টি এবং উজান হতে নেমে আসা ঢলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ ১৩টি জেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যায় আক্রান্ত জেলাসমূহ হলো ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বরিশাল, রাঙ্গামাটি, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে গত ২০ আগষ্ট থেকে কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী ও মৌলভীবাজার এই ৬টি জেলা সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

২১ আগস্ট ২০২৪ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ছে। কুশিয়ারা, মনু, ধলাই, খোয়াই, মুহুরী, ফেনী ও হালদা নদীর পানি সাতটি স্টেশনে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির চাপ অব্যাহত থাকায় নিম্নাঞ্চলের আরো কিছু জেলায় বন্যার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। ২১ আগষ্ট ফেনীতে ৩১২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। (সূত্র: আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী)।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সকালে এক তথ্য বিবরণীতে জানায়, চলতি বন্যায় ছয়টি জেলার প্রায় ১৮ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গত ২০ আগস্ট থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে জানায়, এখন পর্যন্ত বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ৬টি। সেগুলো হলো, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী ও মৌলভীবাজার)। এসব জেলার ৪৩ উপজেলা বন্যা প্লাবিত। এই ছয় জেলায় মোট ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬৬৩টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্রায় ১৭ লাখ ৯৬ হাজার ২৪৮ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

১৯ আগষ্ট থেকে এখন পর্যন্ত (২২ আগষ্ট) ১১ জনের মৃত্যু ঘটেছে এর মধ্যে শিশু ৪ জন। বিদ্যুৎপৃষ্ঠে ২ জন, পানিতে ডুবে ৩, পাহাড় ও ঘর ধস ৫ এবং গাছ পড়ে ১ জন নিহত হয়েছে। (সূত্র: সংবাদ মাধ্যম)

ভয়াবহ বিপর্যয় ফেনী, কুমিল্লা ও লক্ষীপুর জেলা

ফেনী

বন্যায় সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ফেনী জেলার তিন উপজেলা পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ায়। প্লাবিত হয়েছে এই তিন উপজেলার শতাধিক গ্রাম, পানিবন্দী লক্ষাধিক মানুষ। সর্বশেষ ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন ফেনীর বাসিন্দারা। গত ৩৬ বছরে অনেকবার বন্যা হলেও এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। এবারের বন্যায় পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার ৯০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

কুমিল্লা

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২২ আগস্ট ২০২৪, সকাল ৭টায় কুমিল্লায় গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের দেয়া তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লায় ১৮০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আরও ৪৮ ঘণ্টা বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।

লক্ষীপুর

লক্ষ্মীপুর জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় দুই লাখ পরিবার। সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার রামগতি ও কমলনগর, রায়পুর ও সদর উপজেলার মেঘনা উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা। নোয়াখালী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত ২১-২২ আগস্ট পর্যন্ত নোয়াখালীতে ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি আরও ৪৮ ঘণ্টা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যেগ নেয়া হয়েছে

  • ২১ আগষ্ট ২০২৪ থেকে বন্যা এলাকায় উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়েছে সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, ফায়ার ব্রিগেড এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। বন্যাকবলিত জেলাগুলোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের সব কর্মীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়েএবং পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলেছে।
  • দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দিতে মোট ১ হাজার ৩৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ১৭ হাজার ৮৮২ জন লোক এবং ৩ হাজার ৪৮৬টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ছয় জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৩০৯টি মেডিক্যাল টিম চালু হয়েছে।

উদ্ধার কাজ ও ত্রাণ বিতরণসহ এই মুহূর্তে যে সকল বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন

  • উদ্ধারকাজে চট্টগ্রাম জেলার সকল ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সকে বন্যা এলাকায় নিযুক্ত করা।
  • এই মুর্হূতে মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু রাখা খুব জরুরি, অনেকে প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারছেনা। ত্রাণ সামগ্রীর তালিকায় মোবাইল চার্জার বিতরনে অগ্রাধিকার দিন। এই কাজে মোবাইল কোম্পানীকে সংযুক্ত করা যেতে পারে। 
  • দূর্ঘটনা এড়ানোর জন্য বিদ্যুতের তাঁর ও খুঁটি থেকে থেকে সবাইকে দূরে থাকার সতর্কতা দিতে হবে।
  • ত্রাণ কার্যক্রমে শিশুদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিতে হবে। এই মুহুর্তে রুটি বা চাপাতি বিতরণ করার চেয়ে নরম খিচুড়ি সরবরাহ করতে পারলে ভাল। স্থানীয় মানুষের নেতৃতে গ্রাম/মহল্লা/আঁটি ভিত্তিক খাবার ঘর (লঙ্গরখানা) ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো, এতে করে রান্না করে খাবার সরবরাহ করা সম্ভব।
  • শুকনো খাবার বিতরণ করার সময় প্রতিটি জিনিস আলাদা প্যাকেটে দিতে হবে, যেমন: আলু, চাল যেন এক প্যাকেটে দেয়া না হয়, এতে আলু নষ্ট হয়ে যাবে।
  • মোমবাতি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে। কারণ বেশিরভাগই মোমবাতি স্টেরিন (প্রাণী বা উদ্ভিজ্জ চর্বি) বা প্যারাফিন (পেট্রোলিয়াম বর্জ্য) থেকে তৈরি করা হয়। এটি পরিবেশ এবং শিশু উভয়ের জন্যই খারাপ। এর বিকল্প হিসেবে ব্যাটারীচালিত টর্চলাইন বা কেরোসিনে কুপি সরবরাহ করা যেতে পারে।
  • নিরাপদ পানির জন্য ফিটকিরি সরবরাহে কি পরিমাণে ব্যবহার করবে তা উল্লেখ করে দিতে হবে। (যেমন: এক কলসি পানিতে সামান্য পরিমাণ ফিটকিরি পানিতে মিশিয়ে দুই থেকে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করে তা থেকে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে পাত্রের উপর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হবে ও তলানি ফেলে দিতে হবে।)
  • ওরস্যালাইন সরবরাহ করতে হবে। সার্বক্ষনিক স্বাস্থ্যকর্মী না থাকলে ওষুধ বিতরণে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তবে কোন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ যেন না দেয়া হয় সেটি খেয়াল রাখতে হবে।
  • পানিতে ডুবে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষায় শিশুদের নজরে রাখুন।
  • শিশু বা প্রাপ্ত বয়স্ক যাদের মৃগী বা খিঁচুনি রোগ আছে তাদের পরিবারের কারো না কারো তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। চারিদিকে পানি থাকার কারণে তাদের ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
  • টিবি আক্রান্ত রোগী যাদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর ওষুধ বা ইনজেকশন নিতে হয় এবং নবজাতক শিশুদের টিকার বিষয়ে আলাদা করে নজর দিতে হবে।
  • আশ্রয়কেন্দ্রে পরিস্কার টয়লেট, নিরাপদ খাবার পানি এবং স্বাস্থ্যবিধিসহ সকলের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
  • এই মুহূর্তে ত্রাণ সরবরাহে পলিথিন, প্লাস্টিক ব্যবহার হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সময় স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

ছবি সূত্র: রূপশ্রী হাজং, দুর্যোগ ফোরাম


Leave a Reply